আগস্ট মাস আসলেই বাঙালিকে আত্মসচেতন হতে হয়, হিসাব-নিকাশে বসতে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতি হিসেবে বাঙালি কি হারিয়েছে। যার উত্থান হয়েছিল সুদীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে তার পতন ঘটানো হলো কয়েক মিনিটের মধ্যে। কাক ডাকা ভোরে মার্টার ও গুলির শব্দে ঘুম ভাঙল ঢাকা শহরবাসীর। সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ বেতার থেকে ঘোষণা দেয়া হলো শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। আমি তখন এলিফ্যান্ট রোডে একটা বাসায় সপরিবারে অবস্থান করছি। অজু করে ফজরের নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখন সংবাদ শুনে আঁতকে উঠি। গোলাগুলির শব্দ শুনেছিলাম আগেই। শহরে গোলাগুলির শব্দ নতুন কিছু ছিল না। কিন্তু সে গুলি যে বাংলাদেশের বক্ষ বিদীর্ণ করেছে তা তো ভাবতেই পারিনি। ৩২ নম্বরের নিরাপত্তা বিহীন সেই বাড়ি কয়েকটা পুলিশ যে বাড়ি পাহারা দিত সেখানে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিপদগামী কিছু সদস্য। ওই মহান বাড়িতে ঢুকে পড়েছে এমন একজনকে হত্যা করতে, যার জন্ম না হলে বাংলাদেশেরই জন্ম হতো না। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে যিনি নিজ সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন।
বারবার ফাঁসির কাষ্ঠে উঠেও বাঙালির জয়গান গেয়েছেন। যিনি দেশের মানুষের জন্য জীবনের তোয়াক্কা করেননি, সেই দেশের মানুষই তাঁর জীবন নিতে এসেছে। যেটুকু সময় ছিল তিনি টেলিফোনে পুলিশ প্রধান, সেনাবাহিনীর প্রধান ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানকে বিষয়টা জানিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ আসেনি তাকে রক্ষা করতে। খুনিরা তার বাড়ির সিঁড়িতে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করল সেই মহামানবকে। যার ভালোবাসাই ছিল একমাত্র সম্পদ। তিনি ভাবতেও পারেননি যে তারা তাকে হত্যা করবে। সে সময়ে তিনি বিরদর্পে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘কি চাস তোরা।’ তখন মুহুর্মুহুর গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত বঙ্গবন্ধুর দেহটি ঝরে পড়ল সিঁড়ির ওপর। তার পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হলো ওই সিঁড়ি। অনেকেই বলেছেন, ঐ রক্ত নাকি সিঁড়িতে বাংলাদেশের মানচিত্র আকারে বিস্তৃত ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যিনি বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলা ভাষার জন্য এত ত্যাগ ও তিতিক্ষা সহ্য করেছেন তাকে সেই দেশের মানুষেই এভাবে হত্যা করল। শুধু তাকে নয় একে একে হত্যা করা হলো তার বাড়ির সব সদস্যকে। ওই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তাকে অনেকেই সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তার উত্তর ছিল কখন ‘কোন বাঙালি আমাকে হত্যা করতে পারবে না।’ তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে, কাজটি তিনি করেছেন তা খুব সহজ ছিল না। সা¤্রাজ্যবাদ, উপনিবেশিক শক্তির স্বার্থ ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করার যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন, সে কারণেই তাঁর জীবনের ওপর আঘাত। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুব স্বাভাবিক ছিল না। সাম্প্রদায়িক ও অধার্মিকতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান পাকিস্তানি শাসকরা ও বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র কখনো মেনে নিতে রাজি হয়নি। ধর্মরাষ্ট্রকে জাতি রাষ্ট্রে পরিণত করতে খুব সহজ কাজ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান নামক পাকিস্তানের প্রদেশটির ভাগ্য নিয়ন্ত্রক ছিল। প্রতিক্রিয়াশীল মুসলীম লীগ, জামায়াত-শিবির চক্র তারা কখনো চায়নি যে, বাঙালি মুসলমানেরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র সত্তা পাক। পূর্ব পাকিস্তানকে তারা শোষণের চারণ ভূমি হিসাবে মনে করতো। তাঁর অপরাধ ছিল কেন তিনি বাংলাদেশে স্বাধীন করলেন? কেন পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত করলেন? কেন তিনি সা¤্রাজবাদী পুঁজির স্বার্থতে বিঘ্নিত করলেন? কেন তিনি পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি করলেন? সমগ্র পাকিস্তানভিত্তিক বিজয়ী হয়েও তিনি কেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করলেন? কেন তিনি পাকিস্তানি জাতিসত্তা থেকে বাঙালি জাতিসত্তা পৃথক ও রাষ্ট্র পতিষ্ঠা করলেন?
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা সত্ত্বেও তারা তাকে হত্যা করেনি। সাড়ে তিন বৎসর তারা তাকে সময়ও দিয়েছিল। ভেবে ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশীর্ষ সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান নেবেন না। সা¤্রাজ্যবাদীর পুঁজির স্বার্থতে বিঘ্নিত করবেন না। দেশকে স্বয়ং ভার না করে সা¤্রাজ্যবাদী পুঁজির ওপর নির্ভরশীল হবেন। মুজিব যাতে স্বাধীন বাংলাদেশ সঠিকভাবে পরিচালনা করতে না পারেন সে জন্য তারা একের পর এক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ছিল। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ অবশ্যই সা¤্রাজ্যবাদ সৃষ্ট। বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেয়া খাদ্য জাহাজ অন্যদিকে ধাবিত করে বাংলাদেশের মানুষকে অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করা হয়। হাজার হাজার মানুষ ঐ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর জন্য বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা মারাত্মকভাবে সক্রিয় করা হয়। ৫ জন সাংসদকে হত্যা করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ করা হয়। আত্রাই থেকে সরকারের বিরুদ্ধে টিপু বিশ্বাস যুদ্ধ ঘোষণা করে। সর্বহারার নামে সিরাজ শিকদার হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে। এ ধরনের জঙ্গিবাদী তৎপরতার মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে চেয়ছিল। যে শেখ মুজিব স্বাধীন দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম নন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি তাঁর বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। ঠিক তখনই তাকে হত্যা করা হলো। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়া অসামান্য অবদান রেখেছে। তাই দেশস্বাধীন হওয়ার পর এই দুটি দেশে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিশেষ করে তখন সোভিয়েত সিস্টেম ছিল সমাজতান্ত্রিক। তাই বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রীয় ৪ মৌলনীতির ১টি সমাজতন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন তখন সা¤্রাজ্যবাদী চক্র চক্রান্ত শুরু করল।
তাদের ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। অপরদিকে ভারতের অবস্থান ছিল সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী। ভারত তখন ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার বিশ্বাসযোগ্য মিত্র। তাই বঙ্গবন্ধু যখন সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেন তখন সা¤্রাজ্যবাদ মনে করল বাংলাদেশকে তিনি একটা সমাজতান্ত্রিক দেশে রূপান্তর করবেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিকে তারা টানিং পয়েন্ট মনে করে বঙ্গবন্ধুকে আর কোনো সুযোগ না দিয়ে ভারাটে খুনি দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। প্রথমে তারা চেষ্টা করেছিল আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর খুনি মুশতাককে দিয়ে পার্লামেন্ট ও সরকার দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার অনুমোদন করিয়ে নিত। কিন্তু সাংসদদের প্রতিরোধের মুখে তা খুনি মুশতাক তা করতে পারেনি। তখনই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী জাতীয় চার নেতাকে জেলাখানায় হত্যা করা হলো ও তথা কথিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায় বসিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করা হলো। মুশতাক বঙ্গবন্ধুর হত্যার অনুমোদন সংসদে করিয়ে নিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে তাকে জেলে পাঠানো হলো এবং জেনারেল জিয়াই প্রকৃত অর্থে ক্ষমতার চাবিকাঠি নাড়াতে শুরু করলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড তাই কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের কোনো নেতা ২/১ জন ছাড়া সফল হতে পারেননি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন করার মতো সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী এমন একটা কাজ করার পর স্বগৃহে কয়েক পুলিশ পাহারা থাকা সঠিক ছিল বলে মনে হয় না।
আসলে সা¤্রাজ্যবাদ শক্তি সে দিন যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে চিহ্নিত করেছিল তা সঠিক ছিল না। বঙ্গবন্ধু কোনো দেশ অনুকরণ করে যে দেশের প্রচলিত সিস্টেমকে নিজ দেশে আমদানি করতে চেয়েছিলেন সা¤্রাজ্যবাদীর এই হিসাব সঠিক ছিল না। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন তার দেশে এমন এক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে যা না ছিল পুঁজিবাদী, না ছিল সমাজতান্ত্রিক। তিনি সংসদে আইন পাস করে সমাজ বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন তার সমাজ বিপ্লবে ব্যক্তি সম্পত্তির মালিকানা বা ব্যক্তি স্বতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করা হয়নি। বরং গণতন্ত্র সম্মত এক প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থাকে তিনি পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার লক্ষ্য। পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের সমন্বয়ে তিনি এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। গণতন্ত্র বিবর্জিত রেজিমেন্টে সমাজ বিনির্মাণে তার লক্ষ্য ছিল না। এই ব্যবস্থাকেই তার দলের লোকরা মুজিববাদ বলে অবহিত করেছিল। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ই ছিল এর মূল লক্ষ্য। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর এই মতবাদ বিশ্বের তৃতীয় মতবাদ হিসেবে পরিচিতি পেত।
ডা. এস এ মালেক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।