এস এম আব্রাহাম লিংকন
গত ১০ আগস্ট দৈনিকবাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পাতার শীর্ষে একটি ছোট্ট অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশিত হয়। যেখানে জাসদ নেতা বিশিষ্ট সংসদ সদস্য মাইনুদ্দিন খান বাদল বলেছেন, তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার ‘কাফফরা’ দিচ্ছেন। সংবাদটি সাধারণ প্রকৃতির হলেও এর মর্ম অনেক গভীরে। বিশেষত বক্তব্যটি যখন জাসদের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এসেছে। আমরা জানি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একসঙ্গে চলতে না পেরে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ থেকে ফেরা একঝাঁক তরুণ তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে জাসদ নামক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠন করাটাই ছিল মূল রাজনীতি। যখন পাকিস্তানি বোমায় সবকিছু উড়ে গিয়েছিল, সেখানে ব্রিজ, কালভার্ট থেকে শুরু করে শিক্ষা-স্বাস্থ্য, খাদ্য-বস্ত্র সবকিছুর সীমাবদ্ধতা মোকাবেলা করাই ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ। শূন্য হাতে শুরু করা একটি সরকারের পক্ষে চারদিকে ‘নাই আর নাই’— চাহিদা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। ত্রিশ লক্ষ শহীদের পরিবার, এক কোটি শরণার্থী, যাদের ঘরবাড়ি প্রায় বিধ্বস্ত ছিল, যোগাযোগ ব্যবস্থা— সব চাহিদা মেটানো ছিল প্রায় অসম্ভব। এমন দুর্দশাগ্রস্ত পরিবেশ সহজেই অভাবীদের মাঝে একটি ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। সে সময় এ ক্ষোভকে কাজে লাগানোয় জাসদ যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছিল। সমাজতন্ত্র খাদ্য নিশ্চয়তার জন্য মূল তত্ত্ব হলেও অভুক্ত বুভুক্ষ জনতার কাছে সমাজতন্ত্র কিংবা বাকশাল কোনোটাই প্রাসঙ্গিক থাকেনি। নিরক্ষর নাগরিকের কাছে সমাজতন্ত্র অপেক্ষা তাত্ক্ষণিক খাদ্য চাহিদা মেটানোই জরুরি ছিল। জাসদ এই নাজুক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে তটস্থ রেখেছিল। জাসদের ক্যাডারদের মুখে মুখে ছিল রফিক আজাদের সেই কবিতা— ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাব’। জাসদের উগ্রবাণী যুব ও ছাত্রসমাজকে বিপ্লবের নামে ভ্রান্ত রাজনীতির পথে টানতে থাকে। দলে দলে ছাত্র, তরুণ জাসদের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। অন্যদিকে স্বাধীনতার পর বড় দল হিসেবে ন্যাপ মোজাফ্ফর পরিচিত ছিল। ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্র ইউনিয়ন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদে বিজয়ী হয়েছিল। ন্যাপ মোজাফফর, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন বিরোধী দল হলেও তারা বঙ্গবন্ধু সরকারকে সময় দিয়ে সাহায্য করার নীতি গ্রহণ করে। তাদের এ নীতি বিরোধী দলের কাজ বলে প্রশংসিত হয়নি, বরং ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় উঠেছিল তাদের ভূমিকা নিয়ে। এ কথা সত্য, মানবিকতার বিচারে দুর্ভিক্ষে নিপতিত মানুষের কাছে বিপ্লব অপেক্ষা তাত্ক্ষণিক খাদ্য জোগান দেয়া জরুরি ছিল। মানুষ ও দেশকে বাঁচাতে সেদিন সরকারের সঙ্গে ন্যাপ-সিপিবির কাজ করার নীতি সঠিক ছিল। এ সহযোগিতাকে জাসদসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা কটাক্ষ করে বলত, তারা আওয়ামী লীগের বি-টিম।
ন্যাপ-সিপিবি বঙ্গবন্ধুকে ঘিরেই একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চেয়েছিল। তাকে নিয়েই সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেছিল। তাদের সে প্রচেষ্টা ইতিহাসের বিচারে সঠিক ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জাতির পিছিয়ে পড়া ন্যাপ-সিপিবির আশঙ্কাকেই পরস্ফুিট করেছে।
স্বাধীনতাবিরোধীরা দেশ স্বাধীনের পর কোণঠাসা ছিল। তারা রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা অবলম্বন বা প্লাটফর্ম খুঁজতে থাকে। জ্ঞাত বা অজ্ঞাতেই হোক স্বাধীনতাবিরোধীদের সে চাহিদা জাসদ অনেকাংশেই পূরণ করেছে। জেলা ও মহকুমা শহরের শান্তি কমিটি, রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থী পরিবারের যুবক ও ছাত্ররা দলে দলে জাসদের প্লাটফর্মে যোগ দেয়। স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সদস্যরা জেলা, থানায় নেতৃত্ব গ্রহণ করে। জাসদের তৃণমূলে এরা বেশ শক্ত ভিত্তি পায়। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগানে জাসদ উচ্চকিত থাকলেও একপর্যায়ে সংগঠনটি মূলত বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীবিরোধী হয়ে পড়ে। যে বক্তব্য নিয়েই জন্ম হোক, একপর্যায়ে জাসদের অলিখিত ও একমাত্র এজেন্ডাই হয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুকে উত্খাত করা। যেটি স্বাধীনতাবিরোধীরা চেয়েছিল। জাসদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের গরম স্লোগান দিয়ে কার্যত বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র অভিমুখী যাত্রাকে বিদ্রুপ ও বাধাগ্রস্ত করেছে। জাসদ ও স্বাধীনতাবিরোধীরা বুঝেছিল, বঙ্গবন্ধুকে রেখে তাদের কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন হবে না। সে কারণে বঙ্গবন্ধুকে হটাতে যা যা করণীয়, তারা সেগুলোর কোনোটিই বাকি রাখেনি। একটি সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে জাসদ আবার সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য গণবাহিনী গড়ে তোলে। যে বাহিনীতে ছিলেন আ স ম রব, সিরাজুল আলম খানের অনুগত সমর্থকরা, যারা মুক্তিযুদ্ধের পর সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দেয়নি। সেসব জমা না দেয়া অস্ত্র রসদ হিসেবে ব্যবহার করেছে জাসদ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাজাকার, আলবদরদের অস্ত্র। গণবাহিনীর সদস্যদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহূত অস্ত্র এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যবহূত রাজাকারদের অস্ত্র অর্থাত্ মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাবিরোধী উভয় পক্ষের অস্ত্রই জাসদ গণবাহিনীর সদস্যদের হাতে ছিল। অস্ত্রের উত্স নিয়ে কোনো বিতর্ক জাসদে হয়েছিল বলে আমাদের জানা নেই। জাসদ অবশ্য সশস্ত্র বিপ্লবের বাইরে ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রাজশাহীর সদরসহ কয়েকটি আসনে বিজয়ী হয়। জাসদ ও গণবাহিনী দেশকে অস্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে যায়। এছাড়া শাসক দল আওয়ামী লীগের কতিপয় বেপরোয়া কর্মী ও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী খন্দকার মোশতাক গং বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে রেখে তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধু থেকে পৃথকীকরণের কাজ সম্পন্ন করে। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন পৃথক সত্তায় বিভাজিত হয়। যে বিভাজন ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে বিনাশের পথে অগ্রবর্তী করে।
জাসদের সূচনাকালে রাজনীতি ও সমকালীন সংকট নিয়ে বিশিষ্ট রাজনীতিক, আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ফজলুল হক মণির একটি বক্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য। তিনি ১৯৭২ সালের ১০ নভেম্বর অনুুষ্ঠিত যুব কনভেনশনে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় সর্ম্পকে ফুটবল খেলার উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ‘এখন ইন্টারভেল চলছে, প্রথম পর্বের খেলায় আমরা বিজয়ী। শেষ পর্বের খেলা বাকি আছে। শেষ পর্বের খেলায় যারা জয় পাবে, তারাই বিজয়ী হবে (সূত্র: ১৯৭১: উত্তর রণাঙ্গনে বিজয়ে, আখতারুজ্জামান মণ্ডল, লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩-১৯৭৫)। জনাব ফজলুল হক মণির বক্তব্যটি ছিল সভায় অংশগ্রহণকারী বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) ও আওয়ামী ঘরানার মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশে। তিনি বিজয়ে আত্মহারা না হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন বিজয় সংহত করতে না পারলে আমাদের জাতির জন্য ঘোর অমানিশা নেমে আসবে। শেখ ফজলুল হক মণির বক্তব্য সত্যে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধুর পরিবারসহ তার নিজের জীবনদানের মাধ্যমে। সেদিন আমরা বিজয় সংহত করতে পারিনি বলেই ১৯৭৫ সালে আমাদের জাতির জীবনে নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা। যে অমানিশার ঘোর জাতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু হত্যার জাস্টিফিকেশন ক্রিয়েটের চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নিতান্তই পারিবারিক ও শেখ কামালের বিতর্কিত কর্মের ফল বলে প্রচারের চেষ্টা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে লক্ষ করা যায়। যদিও শেষ বিচারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা কোনোভাবেই ব্যক্তিগত আক্রোশ বা ক্ষোভের পরিণতি ছিল না। এটি দেশী ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফসল।
আমরা যদি বিবেচনা করি, বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পর কারা লাভবান হয়েছে? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কারা ক্ষমতায় গেছে? ক্ষমতা গ্রহণকারীদের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা এবং সামগ্রিক আচরণ বিবেচনায় নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সৌদি আরব, চীন প্রভৃতি রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যাদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধীদের গভীর সর্ম্পক ছিল। বঙ্গবন্ধু সার্বভৌম ও ক্ষুধামুক্ত রাষ্ট্রের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। তিনি কৌশল গ্রহণে ভুল করলেও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, সে কথা তার পরম শত্রুও বলতে পারবেন না। তিনি শুধু গণতন্ত্র নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বলেই ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ না করে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাকশাল করেছিলেন সমাজতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায়। বাকশাল ছিল একটি পদ্ধতি, সেখানে বহু পার্টি নিয়ে একটি ঐক্য গঠিত হয়েছিল। বাকশালে আমলা, সামরিক বাহিনী, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী সবার অংশগ্রহণ ছিল। বাকশাল শুধু আওয়ামী লীগ ছিল না। বাকশাল ভুল কি সঠিক, তা এখনো বিতর্কের অবকাশ রাখে। বাকশাল পদ্ধতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে শোষণমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য শিল্প-কলকারখানা, শিক্ষাকে জাতীয়করণের (বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষাকে) আওতাভুক্ত করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪-এর মনুষ্য সৃজিত দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি সামলে দেশকে অগ্রসর করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। তিনি জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করলে স্বাধীনতাবিরোধী ও ধনিক শ্রেণী বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। ধনিক শ্রেণী ভেতরে ভেতরে জাসদের রাজনীতিকে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতার প্রশ্নে সমর্থন করতে থাকে। ফলে জাসদ বঙ্গবন্ধুবিরোধী রাজনীতিতে চতুরমুখী সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করতে থাকে। যথা— ১. মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশের জাসদের রাজনীতিতে সংযুক্তি ২. স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থন ৩. ধনিক শ্রেণীর সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ৪. আন্তর্জাতিক সমর্থন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্মল। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল না। অথচ বঙ্গবন্ধুকে অপসারণ করতে না পারলে ধনিক শ্রেণী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের কোনো পরিকল্পনাই বাস্তব রূপ পাবে না। এ উপলব্ধি বঙ্গবন্ধুবিরোধীদের ছিল। সে কারণে তত্কালীন রাজনীতিতে খুনি চক্র ক্যারাম খেলার ন্যায় থার্ড পকেটে খেলতে শুরু করে। যেহেতু তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে ম্লান করা। তার বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ নেই, দুর্নীতির অভিযোগ ছিল না। তিনি পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেননি। তার জ্যেষ্ঠ ছেলে ও মেয়ে উভয়ই মন্ত্রী-এমপি হওয়ার মতো যোগ্য ছিলেন। জামাই দেশের বড় কর্তা হতে পারতেন। এসবের কিছুই তার ছেলেমেয়েরা হননি। বঙ্গবন্ধু ইচ্ছে করলে সবকিছুই করতে পারতেন। তিনি যদি মনে করতেন ছেলেমেয়েকে রাজনীতির উত্তরাধিকার করবেন, তা সহজেই করতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু পারিবারিক রাজনীতি কায়েম করেননি। তিনি গণতন্ত্র চেয়েছিলেন, সেই পথেই ছিলেন। অনেকে অভিযোগ করেন, শেখ ফজলুল হক মণি শেখ সাহেবের ভাগ্নে ছিলেন, তিনি পরিবারেরই সদস্য। অবশ্যই, কিন্তু শেখ ফজলুল হক মণি শেখ মুজিবেব বঙ্গবন্ধু হওয়ার অনেক আগে নিজেই নেতা হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছিলেন। পাক সরকারের বহু হামলা-মামলায় নির্যাতনের নিত্য শিকার ছিলেন তিনি।
তত্কালীন জাসদের বন্ধুরা শেখ কামালের বিরুদ্ধে ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ দিতেন। কথার বিকৃতি ও নোংরা খবর ছড়ানোতে জাসদের বিভ্রান্ত কর্মীদের অবদান ছিল। শেখ কামালের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিকৃতি খবর প্রচারের মূল কারণই ছিল বঙ্গবন্ধুবিরোধী রাজনীতির প্রতিষ্ঠা।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর শেখ কামাল জীবিত ছিলেন না। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা জিয়াউর রহমান নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী ঘিরে রেখেছিল বহু বছর। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তাকে বাড়িটি বুঝিয়ে দেয়া হয়। সেনাবাহিনী-মোশতাক-জিয়া যারা ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশের ‘সূর্যসন্তান’ সেজেছিলেন, তারা তো টাকা পাননি। যদি পেতেন শেখ কামালের নামে কোন ব্যাংকে কত টাকা ছিল, সে ব্যাংকগুলোর (বিদেশী ব্যাংকসহ) নাম ও হিসাবের নম্বর জনগণের কাছে প্রকাশ করতে পারতেন। আমরা জানি, সবই ছিল গোয়েবলসীয় প্রচার। একটি মিথ্যাকে বারবার বললে সত্য হবে— সেই ধান্ধায় তারা এ অপপ্রচার করেছিল। সফলও হয়েছিল কিছুটা। তবে শেষমেশ টেকেনি। কারণ সত্য সোজা, মিথ্যার ডালপালা থাকে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীর নামে মামলা-মোকদ্দমা হয়েছিল, সেসব মোকদ্দমায়ও প্রাসঙ্গিকক্রমে শেখ কামালের যদি অপকর্ম থাকত, তা আসতে পারত। প্রিয় পাঠক লক্ষ করুন, বিগত ফকরুদ্দীন-মইন সরকার তারেক জিয়ার নামে প্রথমে কোনো মামলা করেনি, গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের টাকার উত্স সন্ধান করতে গিয়েই বেরিয়ে পড়ে তারেকের সংশ্লিষ্টতা। যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তদন্তে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিযোগ পাওয়া যায়। তিনি মৃত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী অভিযোগপত্র দাখিল হয়নি, কিন্তু সংশ্লিষ্টতা তো বিচারকালে প্রমাণিত ছিল। অনুরূপ, যদি শেখ কামালের কোনো অপরাধ থাকত, তা কোনো না কোনো মামলায় পাওয়া যেত। দেশে সামরিক বেসামরিক বহু গোয়েন্দা সংস্থা আছে, যাদের নথিতে দেশের যে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা উল্লেখ থাকার কথা, কিন্তু শাসক হিসেবে জিয়া-মোশতাক-এরশাদ কিংবা বিচারপতি সায়েম এমনকি হালের বেগম খালেদা জিয়া কেউই কোনো নথিদৃষ্টে শেখ কামালের বিরুদ্ধে প্রচারিত মুখরোচক কথাগুলোর অস্তিত্ব পাননি। দেশে হাজার হাজার গবেষক, যাদের অনেকেই জামায়াত বিএনপি, জাসদ প্রভৃতি দলের সমর্থক, তারা তো নিজেদের আনীত তথাকথিত বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করতে পারতেন! শেখ কামাল নিহত হয়েছেন, তার ব্যাংক হিসাব তো মরেনি, ব্যাংকের টাকা তো তিনি কবরেও নিয়ে যাননি। একজন মানুষও তার মৃত্যুর পর বললেন না শেখ কামালের ব্যক্তিগত কর্মে তিনি ও তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা সাধারণত দেখি, কোনো সরকারের দ্বারা যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হন, পরের সরকারের সময় তিনি অনেক ফায়দা লাভ করেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ রকম একজনও তো তাদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন বলে কোনো খবর এই ৩৭-৩৮ বছরে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। আজকের যুগের মতন অন্তত একজন জজ মিয়া তারা আবিষ্কার করতে পারতেন। শেখ কামালের বিরুদ্ধে সে রকমও দেখি না। আসলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হলে কাকে ক্ষতিপূরণ দেবেন? যদি শেখ কামাল সত্যই লুটতরাজ করতেন তাহলে বাড়িতে বা ব্যাংকে টাকা-সোনাদানা থাকার কথা ছিল। সেসব গেল কই? আমরা পত্রিকায় পড়েছি, কেউ কেউ জিয়াউর রহমানকে হজরত ওমরের (রা.) সঙ্গে তুলনা করেছেন কর্মে ও সততায়। শেখ কামাল যদি মন্দ হয়ে থাকেন, তবে মৃত্যুর পর ৩২ নম্বরে হাজার-হাজার ভরি হীরা-জহরত পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর জব্দতালিকা অনুযায়ী সেসবের কিছুই নেই কেন? তাহলে কি ক্ষমতাসীনরা তা আত্মসাত্ করেছেন? তিনি যদি সত্ হয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই সেসব টাকা-সোনাদানা তার মেরে দেয়ার কথা নয়, ৩২ নম্বরেই থাকার কথা। যদি সেসব থাকত তাহলেও অন্তত সহজেই প্রমাণ করা যেত শেখ কামাল মন্দ লোক ছিলেন। আসলে বঙ্গবন্ধুবিরোধীরা তাকে হত্যা করার আগে তার সুনামকে বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেন, যে ষড়যন্ত্রের প্রথম ও প্রধান শিকার শেখ কামাল। শেখ কামাল একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি অন্য অনেকের মতোই ’৭১-এ কলকাতায় বিলাসী জীবনযাপন করতে পারতেন। তিনি সে পথে হাঁটেননি। নিত্য সহযোগিতা করেছেন কর্নেল ওসমানীর সহকারী হিসেবে। দায়িত্বের প্রতি অবহেলার কথা তার শত্রুরাও বলতে পারেন না। তার পরও স্বাধীনতাবিরোধীরা শেখ কামালকে আক্রমণ করেছিল বঙ্গবন্ধুকে নিঃশেষ করবে বলে। শেখ কামালকে সে লক্ষ্যেই সমালোচনার মুখোমুখি করা হয়। এটি ছিল খুনিদের থার্ড পকেটে ক্যারামের রিবন টানার খেলা।
আমরা বাঙালি জাতি নিজেদের ভুলটা অনেক পরে বুঝি। যে কারণেই দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়ে না। জাসদকে ব্যবহার করেই স্বাধীনতাবিরোধীরা নিজেদের লক্ষ্য বাস্তবানের পথ তৈরি করেছিল। জাসদ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছে, বাদল ভাইরা চট্টগ্রামে মিছিলের চেষ্টা করেছেন সত্য, কিন্তু সেদিন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার রাজনীতি থেকে তারা বিরত ছিলেন। তাদের আবেগের সুযোগ নিয়েছে খুনি চক্র। যে কারণে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে জাসদের রাজনীতির নিরাকরণ হয়েছে। এই ৪০ বছরে জাসদের জন্মের সময় উচ্চারিত দফাগুলোর কোনোটাই কায়েম হয়নি। অথচ জাসদকে আজ জাদুঘরে খুঁজতে হয়। অন্যদের কী অভিমত জানি না, তবে আমি ধন্যবাদ জানাই জাসদের শীর্ষ নেতৃত্বকে, যারা বলছেন, তারা আজকে বঙ্গবন্ধু হত্যার কাফফারা দিচ্ছেন।
লেখক: আইনজীবী, কলাম লেখক ও সাবেক রাকসু নেতা