সিরাজুজ্জামান
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি ভীতির রাষ্ট্র তৈরি করা হয়েছিল। সেই কালো রাতে রাজধানীর তিনটি বাসায় একই সঙ্গে হামলা চালিয়ে যে নারকীয় ও নিকৃষ্ট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। বিপথগামী একদল সৈনিকের ভয়ে সেসময় সবাই তটস্থ ছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাকে টুঙ্গিপাড়ায় মা-বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল তার প্রিয় মা-বাবার পাশেই চিরনিন্দ্রায় শায়িত হবেন। কিন্তু সেই সময়ে ক্ষমতায় থাকা আর্মিরা যে তার ইচ্ছার জন্য তাকে টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করেছিলেন তা নয়। রাজধানীর মতো একটি জনবহুল জায়গায় তার মরদেহ রাখতে ভয় পাচ্ছিলেন তারা। মরদেহ ছিনিয়ে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে বলেও তাদের আশঙ্কা ছিল। অনেকের ধারণা, জীবিত বঙ্গবন্ধুর মতো মৃত বঙ্গবন্ধুকেও ভয় পেত হত্যাকারীরা। এ জন্য তার পরিবারের সবাইকে বানানী গুরুস্থানে দাফন করা হলেও বঙ্গবন্ধুকে নেয়া হয় টুঙ্গিপাড়ায়।
মো. নুরুল আলমের ‘বঙ্গবন্ধুর দাফন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’ বইয়ে এর ইঙ্গিতও রয়েছে। সেসময় গোপালগঞ্জ মহকুমার পুলিশ অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। পরে তিনি এডিশনাল আইজিও হয়েছিলেন। তিনিই বঙ্গবন্ধুর দাফনের সব ব্যবস্থা করেছিলেন।
এ ছাড়া ১৫ আগস্টের ঘটনাবলির ওপর লে. কর্নেল (অব.) এম এম হামি পিএসসি লিখিত ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইয়েও কিছু অজানা তথ্য পাওয়া গেছে। তার ওই বইয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার প্রেক্ষাপট ছাড়া তাদের জানাজার বিষয়গুলো উঠে এসেছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমান যে এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আগেই জানতেন তাও উল্লেখ করা হয়েছে। এই আর্মি অফিসারকে দায়িত্ব দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্যান্যদের দাফন করার। এবং সেটা বনানীতেই হতে হবে। তার ভাষ্যমতে, মুসলিম নিয়ম অনুযায়ী তাদের দাফন করা হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার সময় একটি টেলিফোন কল পান গোপালগঞ্জ মহকুমার পুলিশ অফিসার নুরুল আলম। সেই কলটি বঙ্গভবন থেকে এক আর্মি অফিসার করেছিলেন।
তিনি ‘বঙ্গবন্ধুর দাফন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’ বইয়ে বলেন, ‘১৬ আগস্ট শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে টেলিফোন আসে। ... এবার অপর প্রান্ত হতে বললেন ‘আমি ঢাকার এসপি আব্দুস সালাম বলছি। আপনি এসডিপিও বলছেন? জ্বি বলতেই তিনি জানালেন দুপুরের মধ্যে হেলিকপ্টারে করে শেখ মুজিবের লাশ টুঙ্গিপাড়ায় যাবে। বাবা-মার কবরের পাশে তার লাশ দাফন করে রাখবেন। যাতে কবরের মধ্যে কফিনসহ লাশ রেখে তাড়াতাড়ি মাটি দেয়া যায়। ১৫ মিনিটের মধ্যে লাশ কবর দিয়ে হেলিকপ্টার ফিরে আসবে। হেলিকপ্টার নামানো, লাশ কবর দেয়া এবং ওই লাশ যাতে কবর হতে কেহ উঠায়ে নিতে না পারে তার জন্য সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। গোপালগঞ্জ পুলিশলাইন এবং নিকটস্থ থানা/ফাঁড়ি হতে পুলিশ এনে টুঙ্গিপাড়ায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। যাতে আর্মিরা লাশ তাড়াতাড়ি দাফন করে নিরাপদে ঢাকায় চলে আসতে পারে।’
কিন্তু সেই নূরুল আলমের মধ্যে একটি চিন্তা দানা বাঁধতে থাকে। যার মরদেহ দাফন করা হবে তিনি আসলেই বঙ্গবন্ধুর কি না। এ জন্য তিনি মুখ দেখার জন্য জানাজার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করেন।
লেখকের ভাষায় ‘১৬ আগস্ট। মেঘভাঙা রোদের অগ্নিঝরা দুপুর। টুঙ্গিপাড়া যেন হিমশীতল পরিবেশে পিনপতন নিস্তব্ধতায় অপেক্ষা করছে তারই কোলেপিঠে বড় হওয়া বাংলা মায়ের দামাল ছেলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গভীর স্নেহে তার বুকে আশ্রয় দিতে। কয়েকজন ব্যাংক কর্মচারী, চারজন কফিন বহনকারী, কবরের পাশে চার থেকে পাঁচজন কবর খননকারী ও পুলিশ ছাড়া সেদিন পুরো টুঙ্গিপাড়া এলাকা জনমানবশূন্য ছিল। কোথাও লোকজনের চলাচলের সাড়াশব্দ নেই। দোকানপাট, হাসপাতালসহ সবকিছুর দরজা-জানালা বন্ধ।
তিনি ওই বইয়ে বলেন, ... দুপুর দেড়টার দিকে হবে, হঠাৎ হেলিকপ্টারের আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টুঙ্গিপাড়ার আকাশে হেলিকপ্টার দেখা গেল। ... হেলিকপ্টারে করে রাষ্ট্রপতির মরদেহ পাহারা দিয়ে এসেছিলেন মেজর কাজী হায়দার আলীর কমান্ডে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন (যিনি ৭ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানে নিহত) একজন হাবিলদার ও ১০ জন সৈনিক। এ ছাড়া হেলিকপ্টারে ছিলেন দুজন পাইলট। তারা হেলিকপ্টার থেকে নিচে নামেননি। ফ্লাইট লে. শমসের আলী হেলিকপ্টার চালিয়ে এসেছিলেন।’
জানাজা করার জন্য মেজরের কাছে অনুমতি চাওয়ার পর তিনি প্রথমে ক্ষেপে গেলেও পরে রাজি হন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কফিন খোলার মতো কোনো জিনিসই পাওয়া যাচ্ছিল না তখন। সবাই পালিয়েছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দীর্ঘদিনের কাজের লোক বৈকুণ্ঠও পালিয়েছিলেন। পাশের বাড়ির গোয়ালঘর থেকে কাঁচি ও হাত কোদাল সংগ্রহ করে কফিন বক্সের ডালা খুলে মাটিতে রাখেন। মেজর হায়দার বঙ্গবন্ধুর লাশ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য তার আত্মীয়দের খুঁজেন।
লেখকের ভাষায়, লাশ পেঁচানো সাদা কাপড় খুলতেই দেখা যায়, থান কাপড়ের একটি লম্বা টুকরার ওপর লাশ রেখে পায়ের দিক হতে কাপড়টি মাথার দিকে এনে মুড়িয়ে গিট দিয়ে রেখেছে। গিট খুলে মুখ বের করতেই দেখা গেল, বঙ্গবন্ধু যেন চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছেন।’
লাশ গোসলের জন্য পাশের দোকান থেকে ৫৭০ সাবান নিয়ে আসা হয়। কারণ, দোকানে গায়ে মাখার কোনো সাবান ছিল না। এরপর গোসল দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি খুলতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েন মৌলভী সাহেব। পোশাক ভিজে শরীরের সঙ্গে এমনভাবে আটসাট হয়েছিল যে খোলা যাচ্ছিল না। পরে ব্লেড এনে কেটে বের করতে হয়।
লেখকের ভাষায়, ‘দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ঘাড়ের পেছনের দিকের মাংস নেই। হয়ত গুলিতে উড়ে গেছে। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল পাশের আঙ্গুল হতে বিছিন্ন হয়ে সামান্য চামড়ার সঙ্গে ঝুলে আছে। পায়ের গোড়ালির রগ টাকা। লাশ শক্ত না হওয়ার জন্য হয়ত রগটি কেটে দিয়েছে।’
‘সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। সবাই যেন শোকে ও ভয়ে পাথর হয়ে গেছে। পাঞ্জাবির পকেটে চশমার একটি ভাঙা অংশ এবং তামাকের পাইপের একটি অংশ পাওয়া গেছে। ... কাফনের কাপড়ের জন্য যে লোকটি পাটগাতি বাজারে গিয়েছিল সে এখনও ফিরে আসেনি। আর্মি ক্যাপ্টেন এবং হাবিলদার কবরস্থানসহ বাড়ির চারদিকে অস্থিরভাবে ঘোরাঘুরি করেছে এবং কোনোখানে লোকজন জড়ো হচ্ছে কি না তা দেখছে। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন লাশের পাশে এসে বলেন, গোসল শেষ হয়েছে। তাড়াতাড়ি ডেডবডি কববে নিয়ে আসেন, মাটি দিয়ে আমরা এখনই চলে যাব।’
কিন্তু কাফনের কাপড় আনতে যাওয়া ব্যক্তি না আসায় পাশেই শেখ সায়রা খাতুনের আনা রেডক্রস হাসপাতালের রিলিফের কিছু সাদা শাড়ি ছিল। ভিজা কাপড়ের চেয়ে ওই শাড়ি কেটে কাফন তৈরি সহজ হবে। পরে ওই কাপড় দিয়ে কাফন বানানো হয়।
একই বইয়ে তৎকালীন টুঙ্গিপাড়া ওসি আবদুল জলিল শেখ তার স্মৃতিচারণায় লিখেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দূর সম্পর্কের মামা শেখ আব্দুল মান্নান ওরফে পান শেখ ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনি লাশ বুঝে নেন।’
তিনি লিখেন, ‘...বঙ্গবন্ধুর কাপড় কাটার পর তার বুকে ১৮টি বুলেটের গভীর ক্ষত চিহ্ন ছিল, গুলিতে বুক ঝাঝরা হয়ে যায়। ডান হাতের কবজির হাড় ভাঙা, ডান হাতের শাহাদাৎ আঙ্গুলের অগ্রভাগের হাড় নাই। পিঠের মধ্যে একটি বড় গর্তের মতো ক্ষত।’
কর্নেল (অব.) কাজী হায়দার আলী (বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ স্কটকারী) তার স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘..পৌঁছেই পুলিশের ওসি ও ডিএসপিকে জিজ্ঞাসা করি... সবকিছুর ব্যবস্থা আছে? জবাবে বলেন, কবর খোদাই করে রাখা হয়েছে। টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে যেতে হয়েছিল একটা কাঁচা রাস্তা দিয়ে। বাড়িতে ঢুকতে ডানদিকে গোয়ালঘরে গরু বাঁধা ছিল। বাঁ দিকে মা ও বাবার সাধারণ কবরস্থান, তার পাশে নতুন করব তৈরি করা হয়, আর চতুর্দিকে লাগানো টিনের ঘর, শুধু সামনে একটা সাধারণ দালান। ... চারদিকে নিশ্চুপ, কোনো লোক নেই, পুরুষ, ছেলেরা মনে হচ্ছিল কেউ বাড়িতে নেই, সবাই ঘর বন্ধ করে চলে গেছে। আর্মির লোকদের দেখেই হয়তো চলে গেছে। ... খুঁজতে গিয়ে ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স, লাঠি হাতে একজন ভদ্রলোককে পেলাম। তিনি জনাব শেখ আবদুল মান্নান ওরফে পনু মিয়া। সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর চাচা। তাকে মৃতদেহ বুঝিয়ে দিই।
উল্লেখ্য, এই লোকের পরিচয়ে দুইজনের বর্ণনায় একজন বলেছেন বঙ্গবন্ধুর চাচা, আরেকজন বলেছেন বঙ্গবন্ধুর মামা।
লে. কর্নেল (অব.) এম এম হামিদ পিএসসি লিখিত ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইয়ে উল্লেখ করেন, ...‘ এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না, যে ব্যক্তি ও যার পরিবারের নিকট বাংলাদেশ ঋণী সেই পরিবারের সদস্যদের জীবনে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়ার পরও হত্যাকারীরা দেয়নি মৃতের ন্যূনতম অধিকার। একজন মুসলমান মারা গেলে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাকে গোসলের পর কাফন পরিয়ে, জানাজা দিয়ে দাফন করতে হয়। হত্যার দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিহত তার পরিবার ও আত্মীয়দের মরদেহগুলো যেভাবে রাতের অন্ধকারে বনানী কবরস্থানে, গোসল, কাফন ও জানাজা ছাড়া সমাহিত করা হয়েছে তাতে ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতি কিছুই মানা হয়নি।’