১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড চেনা মানুষগুলোকে রাতারাতি বদলে দিয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন তার ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। ২০১৩ সালের আগস্টে লন্ডনে বাংলানিউকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে এ মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৩ সালের আগস্টে লন্ডনে বাংলানিউকে দেওয়া সাক্ষাতকারটি পাঠকদের জন্য পুণঃপ্রকাশ করা হলো....
লন্ডন: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড চেনা মানুষগুলোকে রাতারাতি বদলে দিয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন তার ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। ২০১৩ সালের আগস্টে লন্ডনে বাংলানিউকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে এ মন্তব্য করেন তিনি।
বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, মানুষ যে এত দ্রুত বদলাতে পারে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তা প্রথম বুঝতে পারলাম।
তার মর্মস্পশী স্মৃতিচারণে বেরিয়ে আসে ১৫ আগস্ট-পরবর্তী অকথিত অধ্যায়ের অনেক অজানা ঘটনা। দীর্ঘ স্মৃতিচারণে ১৫ আগস্ট-পরবর্তী নিজের সংগ্রামী জীবনের কথা যেমন তুলে ধরেন, তেমনি সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও ঝানু রাজনীতিকের মতো করে ফুটিয়ে তোলেন শেখ রেহানা।
স্মৃতিচারণে ফুটে ওঠে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে খন্দকার মোশতাক আহমেদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের বিদেশে সংবাদ সম্মেলন আয়োজনে অনীহা প্রকাশের ঘটনারও অকপট বর্ণনা দেন তিনি। কথায় কথায় পরিবারের সব সদস্যকে হারানো দুই বোনকে নিরাপত্তা দিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনীহা, ভারত থেকে লন্ডন যাওয়া, বঙ্গবন্ধুকে খুনের ঘটনায় গঠিত আন্তর্জাতিক তদন্ত দলের আতুড়ঘরেই মৃত্যুর হৃদয়ছোঁয়া বিবরণ তুলে ধরেন তিনি। আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন জার্মানিতে সে সময় বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীসহ আরও অনেকের প্রতি।
স্মৃতিচারণকালে নিজের বিয়ে আর ব্যক্তিজীবন পর্বের অনেক না বলা কথাও নিঃসংকোচে বলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
একান্ত স্মৃতিচারণে রেহানা জানান, ১৫ আগস্ট কালরাতের হত্যাকাণ্ডের সময় বোন শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে তিনি ব্রাসেলসে অবস্থান করছিলেন। দুলাভাই ড. ওয়াজেদ মিয়া তখন জার্মানির কার্লসওয়েতে বসবাস করতেন। স্বামীর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বোন শেখ হাসিনা যখন জুলাই মাসের শেষের দিকে জার্মানিতে আসেন, তখন তার সঙ্গে বেড়াতে আসেন তিনি। ১৫ আগস্ট তারা ব্রাসেলসে ছিলেন- এমনটি জানিয়ে রেহানা বলেন, দুলাভাইয়ের ছুটিতে আমরা বেড়াতে আসি ব্রাসেলসে। উঠি ব্রাসেলসে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায়।
সারা জীবন কাঁদতে হতে পারে
শেখ রেহানা বলেন, আমার বয়সী সানাউল হকের মেয়েদের সঙ্গে ওই রাতে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমাদের উচ্ছলতা ও হাসাহাসির তীব্র শব্দে দুলাভাই এক পর্যায়ে এসে ধমক দিলেন আমাকে। বললেন, এত হাসাহাসি ভালো নয়, এতে সারা জীবন কাঁদতে হতে পারে। শেখ রেহানা বলেন, দুলাভাই যত বলেন, আমরা আরও বেশি হাসাহাসি করি। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই যে আমার এই হাসি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে, তা তখন কল্পনাই করতে পারিনি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ১৫ আগস্ট ভোরে আপার ডাকে ঘুম ভাঙে। তিনি বলেন, তাড়াতাড়ি ওঠো, ঢাকায় গোলমাল হয়েছে। গোলমাল, রাজনীতির কারণে আব্বার জেলে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় স্বাধীনতার আগে আমাদের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা হলেও এই গোলমাল যে তেমন সেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তা বুঝতে অবশ্য আমাদের আরও অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।
আগের দিন খাতির, পরদিন বোঝা
বঙ্গবন্ধু তনয়া বলেন, আগের দিন রাষ্ট্রদূত সানাউল হক সাহেবের বাসায় এসে উঠেছি। আমরা প্রেসিডেন্টের মেয়ে, খাতির-যত্নের কি বাহার। পরদিন পৃথিবীতে আমাদের কেউ নেই। নিঃস্ব অসহায় আমরা দুই বোন তখন সানাউল হক সাহেবের কাছে বোঝা হিসেবে পরিগণিত হলাম। আমাদের সরিয়ে দিতে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন।
রেহানা জানান, সানাউল হক নার্ভাস হয়ে তাদের সরিয়ে দিতে অস্থির হয়ে উঠলেও তার মেয়েরা ছিলেন খুবই আন্তরিক। তারা আমাদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, অভয় দিচ্ছিলেন। জার্মানিতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।
রেহানা বলেন, পরে শুনেছি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকেও টেলিফোন করে সানাউল হক বলেছেন, এসব ঝামেলা আপনি আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন, তাড়াতাড়ি এই ঝামেলা সরান। সানাউল হকের বাড়ি থেকে আমরা বের হয়ে এলাম। তখন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ফেরেশতার মতো আভির্ভূত হয়েছিলেন আমাদের জন্য। ব্রাসেলস ও জার্মানির বর্ডারে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাদের জন্য গাড়ি পাঠালেন। আমরা সোজা 'বন' এ গিয়ে তার বাসায় উঠি।
হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ও তার স্ত্রী দু’জনই আমাদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। দিচ্ছিলেন সাহস ও অভয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমরা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। ফরেন সার্ভিসের লোক হিসেবে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর স্ত্রীর হাইপ্রোফাইল চলাফেরাও তার আঁচলের আশ্রয় থেকে আমাদের বঞ্চিত করেনি। আমাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে তাদের।
কয়েকজন বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি ছেলে বনে হাইকমিশন ভবন ঘেরাও করে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামানোর জন্য চৌধুরীকে চাপ দেয়। আমাদের বের করে দিতেও বলে তাকে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এমন চাপে নতিস্বীকার না করে উল্টো তাদের বলেন, এই ভবন এখনো বাংলাদেশের। ঢাকা থেকে আমি কোনো নির্দেশ পাইনি। তোমরা যদি বেশি ঝামেলা কর আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব। ছেলেরা তখন চলে যায়।
রেহানা জানান, এর পর গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ক্ষমতা দখলকারীদের নির্দেশে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তার বাসায় হাসিনা-রেহানাকে বন্দি করে রেখেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিকরা তখন ভিড় জমায় চৌধুরীর বাসার সামনে। তারা জানতে চায় আসলেই হাসিনা-রেহানা বন্দি কিনা। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তখন আমাদের এসে বলেন, তোমরা কি একটু জানালার কাছে গিয়ে তোমাদের প্রকৃত অবস্থান জানাবে?
আমরা তখনই জানালার কাছে গিয়ে সাংবাদিকদের বললাম, আমরা এখানে আশ্রয় পেয়েছি, বন্দি নই। আমাদের কথা শুনে তারা চলে যান।
সঠিক খবরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে
শেখ রেহানা বলেন, আমরা দুই বোন ছাড়া যে আমাদের পরিবারের আর কেউই বেঁচে নেই, এ খবরটি সঠিকভাবে পেতে আমাদের অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। কেউই ঠিকমতো বলতে পারছিলেন না ঢাকায় কি হয়েছে। লন্ডনসহ বিভিন্ন স্থান থেকে টেলিফোন আসছিল। ভিন্ন ভিন্ন খবর দিচ্ছিলেন অনেকে। কেউ বলছেন- মা ও রাসেল বেঁচে আছেন। তারা ওই দিন ছোট ফুফুর বাসায় ছিলেন। কেউ বলছেন- জামাল ভাই সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার, তিনি ব্যারাকে ছিলেন এ জন্য বেঁচে গেছেন, আবার কেউ বলছেন কামাল ভাইয়ের ক্রিকেট টিম নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা, তিনি সেখানে চলে গেছেন, ভাবি চলে গেছেন তার বাবার বাসায়, সুতরাং তারা বেঁচে আছেন। কিন্তু কোনো খবরই সঠিকভাবে কেউ বলতে পারছিলেন না।
প্রেস কনফারেন্স করার অনুরোধ রাখলেন না ড. কামাল
শেখ রেহানা জানান, ড. কামাল হোসেন ওই সময় জার্মানিতে আসেন। তিনিও খুব কান্নাকাটি করছিলেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি তখন দেশের বাইরে সফরে ছিলেন। ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে তার কাছেও সঠিক কোনো খবর নেই।
ড. কামাল হোসেনকে একটি প্রেস কনফারেন্স আয়োজনের অনুরোধ জানিয়েছিলেন স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু তনয়া বলেন, কামাল হোসেন সাহেবকে বললাম- চাচা আপনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী, একটি প্রেস কনফারেন্স করে বিশ্ব মিডিয়াকে প্রকৃত অবস্থা একটু বলুন। আমাদের কূটনৈতিক মিশনগুলোকে ডিফেন্ড করতে অনুরোধ করুন। কিন্তু তিনি আমার অনুরোধের গুরুত্ব দিলেন না। হয়তো ছোট মানুষ হিসেবে এই অনুরোধের কোনো গুরুত্ব নেই বলেই তিনি ভেবেছিলেন। তবে ওই সময় যদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন একটি প্রেস কনফারেন্স করতেন তখন পরিস্থিতি হয়তো অন্যরকম হতো।
৩-৪ মাস পর জানতে পারি কালরাতের বিস্তারিত
অনেক পরে দিল্লিতে আসার পর জানতে পারেন- তারা দুই বোন ছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের আর কেউই বেঁচে নেই। ঘটনার ৩-৪ মাস পর শেখ সেলিম ও আবুল হাসানাত আবদুল্লারা যখন কলকাতা থেকে দিল্লিতে আসেন তখনই তাদের মুখে সেই কালরাতের বিস্তারিত জানতে পারেন তারা।
রেহানা বলেন, আগস্টের ২৪/২৫ তারিখের দিকে আমরা ইন্ডিয়াতে চলে যাই। তখন প্লেনে পত্রিকায় দেখলাম সব শেষ। মা, বাবা, ভাইবোন কেউ বেঁচে নেই আমাদের। এরপরও বিশ্বাস হচ্ছিল না। কেন হবে এমন ঘটনা। পাকিস্তানিরা যেখানে এমন ঘটনা ঘটায়নি, বাঙালিরা কেন করবে। তখনো একটি আশা মনে ছিল, হয়তো অনেকেই বেঁচে আছেন।
এর আগে জার্মানিতে রেডক্রস বলল, তারা জানতে পেরেছে মা ও রাসেল বেঁচে আছেন। তারা ছোট ফুফুর আশ্রয়ে তার বাসায় আছেন। তারা যদি বেঁচে থাকেন তবে রেডক্রস তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পারবে বলে জানায়।
রেডক্রস থেকে বলা হয়, তোমরা ইন্ডিয়া থাকলে এই উদ্ধার প্রক্রিয়া চালাতে আমাদের সুবিধা হয়। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীও সায় দিলেন রেডক্রসের কথায়। আমরা চলে এলাম ইন্ডিয়ায়।
মোশতাক ছুরি মারতে পারে জানতেন বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু তনয়া বলেন, প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। যারাই শতাব্দীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডে জড়িত, সবাই তো ছিল বঙ্গবন্ধুর কাছের লোক। তবে মোশতাক যে ছুরি মারতে পারে বঙ্গবন্ধু তা জানতেন। ১৫ আগস্টের অনেক পর খোকা চাচা (বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই) একদিন বললেন- জানিস মিয়া ভাই খোন্দকার মোশতাককে ঠিকই চিনতেন। মোশতাকের হয়ে তার কাছে একবার তদবিরে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, খোকা তুই মোশতাকের জন্য তদবির করতে এসেছিস। আমাকে যদি কেউ পেছন থেকে ছুরি মারে, তা মোশতাকই মারবে।
রেহানা বলেন, এর পরও সহকর্মী বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি আব্বার ছিল অগাধ বিশ্বাস। কারও প্রতি তিনি বিশ্বাস হারাতেন না। এমনো শুনেছি, ঘটনার রাতে ১২টা পর্যন্ত মোশতাক ৩২ নম্বরে ছিলেন। তাদের পরিকল্পিত অভিযান সম্পর্কে কেউ কিছু আঁচ করতে পারছে কিনা, তা অবজার্ভ করতে তিনি ওইখানে ছিলেন। স্বাধীনতার আগে এই মোশতাক যখন জেলে, তখন তার অসুস্থ স্ত্রীর সব দায়-দায়িত্ব নিয়েছিলেন আমার মা। তাকে সুস্থ করে তুলতে বিরামহীন চেষ্টা করেছেন তিনি।
আমার দাদির মৃত্যুর পর মোশতাকের সেই অস্বাভাবিক কান্না এখনো আমার চোখে ভাসে। আব্বাসহ আমরা সবাই ছিলাম শোকে কাতর। কিন্তু একমাত্র মোশতাকই তখন মাঠিতে গড়াগড়ি করে কান্নাকাটি করছেন, যা অনেককেই অবাক করেছে। তখন তো আর বুঝতে পারিনি- আব্বার বিশ্বাসে ঢুকতে এ ছিল তার অভিনয়।
তিনি বলেন, কি আর করা, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তো ব্রুটাস, মীর জাফরদের আবির্ভাব ঘটে, মোশতাকের আগমনও আমরা সেভাবেই দেখি।
তাজউদ্দীন কাকার সঙ্গে আব্বার কোনো দূরত্ব ছিল না
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা বলেন, তাজউদ্দীন কাকার সঙ্গে আসলে আব্বার কোনো দূরত্ব ছিল না। তবে এ নিয়ে অনেক অপপ্রচার আছে।
ওই সময় রাজনীতির গভীরে যাওয়ার বয়স তার ছিল না স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এর পরও যতটুকু দেখেছি আব্বা আর তাজউদ্দীন কাকা ছিলেন এক প্রাণ, এক আত্মা। খোন্দকার মোশতাক হয়তো তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছেন। যে লোক নিজের ৩০ বছরের বন্ধুকে ছুরি মারতে পারে, তার জন্য এমন অপচেষ্টা তো কোনো বিষয়ই নয়।
মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ
মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। বিশ্বাস তো কাউকে না কাউকে করতেই হবে। আমরা যদি সবার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতাম তাহলে ১৫ আগস্টের পর তো দুই বোন ঘরেই বন্দি হয়ে বসে থাকতাম।
তিনি বলেন, কার ভেতরে কি আছে তা বলা মুশকিল হলেও সবার ওপর থেকে বিশ্বাস তো আর হারানো যায় না। যে রাজনীতি ছোট্ট বয়সে নিজেদের কাছ থেকে বাবাকে সব সময় বিচ্ছিন্ন করে রাখত, সেই রাজনীতি যখন চিরতরে পুরো পরিবারকে ছিনিয়ে নিল, তখন আর কীসের রাজনীতি, এমন মনোভাব নিজের ভেতরে কাজ করলেও এক পর্যায়ে এসে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে, পুরো পরিবার নিয়ে গেলেও আল্লাহ কেন তাদের দুই বোনকে বাঁচিয়ে রাখলেন? আমাদের বাঁচিয়ে রাখার পেছনে নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার কোনো উদ্দেশ্য আছে। এ প্রশ্ন মনে উদিত হওয়ার পরই নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা হয়।
আল্লাহর কাছে নিয়মিত ফরিয়াদ
রেহেনা বলেন, বাবা-মার খুনিদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসতে শক্তি প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে নিয়মিত ফরিয়াদ করতাম। মনে হলো- এই খুনিদের ধরার জন্যই হয়তো আল্লাহ আমাদের দুই বোনকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
রেহানা বলেন, ঘটনার পর পর এমনো হতো, অভিমান করে সৃষ্টিকর্তাকে বলতাম- আমাকে নিয়ে কেন আমার ভাইদের বাঁচিয়ে রাখলে না। রাজনীতির কারণে আব্বার অনুপস্থিতির ফলে যে চাচার কাছে ছিল আমাদের সব আবদর, সেই চাচাকেও বাঁচতে দিল না ঘাতকরা। সবার আদরের ছোট্ট ভাইটিকেও নির্মমভাবে হত্যা করল।
মৃত্যুই ডেকে এনেছে চাচাকে
চাচা শেখ নাসেরের কথা বলতে গিয়ে রেহানা বলেন, নিয়তি যে দুই ভাইকে আলাদা করতে চায়নি, তার প্রমাণ আমার চাচার মৃত্যু। ১৪ আগস্ট খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে চাচা প্লেনের সিঁড়িতে যখন উঠলেন, তখনই দুজন কর্মকর্তা গিয়ে তাকে বললেন, প্রেসিডেন্ট আপনাকে বাসায় ফিরে যেতে বলেছেন। চাচা বাসায় ফিরে যান। অনেকের সঙ্গে বসা আব্বাকে গিয়ে বললেন, মিয়া ভাই আপনি নাকি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন? উত্তরে অট্টহাসি দিয়ে আব্বা বললেন, আমাকে ছেড়ে তুই চলে যেতে চেয়েছিলে, দেখ তোকে কীভাবে ফিরিয়ে আনলাম।
রেহানা বলেন, আসলে মৃত্যুই ডেকে এনেছিল চাচাকে।
বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল জয় আর পুতুল
সব হারিয়ে নিজেদের বেঁচে থাকার ইচ্ছাও হারিয়ে ফেলেছিলেন হাসিনা-রেহানা। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল জয় আর পুতুল।
রেহানা বলেন, সারা দিন বিছানায় পড়ে থাকতাম, খাওয়া-দাওয়া কিছুই নেই। জয়-পুতুল যখন কেঁদে উঠত তখন তাদের খাবার দিতে স্বাভাবিক হতে হতো আমাদের।
তিনি বলেন, শুধুই আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতাম। দুলাভাইয়ের এক বন্ধু ড. শহীদ আমাদের কিছু দোয়া লিখে দিয়ে বললেন, কান্নাকাটি না করে তোমরা এ দোয়াগুলো পড়তে থাক। এই দোয়াগুলো পড়তে থাকলাম আমরা। আপাকে সান্ত্বনা দেই আমি, আমাকে সান্ত্বনা দেন আপা। এই আমাদের অবস্থা।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিরাপত্তা দিতে নারাজ
স্মৃতিচারণে রেহানা জানান, বাবা-মার খুনিদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার আশাই তাদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। ইন্ডিয়ায় আসার বেশ কিছু দিন পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে একা একা ঘরে বসে থাকতে তার অনিচ্ছার কথা জানাই। পড়াশুনা শুরু করতে চাই।
এর পর নেহরু ইউনিভার্সিটি, সিমলা ও কলকাতার শান্তিনিকেতনে তার ভর্তির ব্যবস্থা হয় বলে বাংলানিউজকে জানান শেখ রেহানা।
তিনি বলেন, ভর্তির সব ব্যবস্থা হলো, কিন্তু পড়ায় তো মন বসে না। শান্তিনিকেতনে আসার জন্য ট্রেনে উঠব, এমন সময় খবর পেলাম পশ্চিমবঙ্গ সরকার বলছে, আমার নিরাপত্তা দিতে পারবে না। আবার ফিরে এলাম আপার কাছে। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় শান্তিনিকেতনে যেতে না পেরে লন্ডনে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। লন্ডনে তখন তার এক চাচা ও ট্রেনিংয়ে আসা তার ফুফা সাবেক আর্মি চিফ জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান অবস্থান করছিলেন।
রেহানা বলেন, ফুফা জেনারেল মোস্তাফিজ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশে আর ফিরবেন না। কারণ চাকরিতে বিভিন্নভাবে তাকে হয়রানি করা হচ্ছিল।
আমি তাকে একটি চিঠি লিখে অনুরোধ করি, ফুফা আপনাকে চাকরিতে ফিরতে হবে। আমাদের অনেক কাজ বাকি, অভিমান করলে চলবে না। ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসতে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। ফুফা আমার কথা রাখলেন। আমার এই চিঠি এখনো আমার ফুফুর কাছে আছে।
ডটার অব লেইট শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে লন্ডনে আসেন শেখ রেহানা। এর আগে দিল্লিতে ব্রিটিশ ভিসা সংগ্রহের কষ্টের কথা জানাতে গিয়ে রেহানা বলেন, একা একা বাসে করে ব্রিটিশ হাইকমিশনে গিয়ে ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করি। সাত দিন পর আসতে বললে হাইকমিশন ত্যাগ করে যখন বের হচ্ছি, ঠিক তখনই এক অফিসার এসে আমার কাছে জানতে চান, আমি শেখ মুজিবের মেয়ে কি না। উত্তরে হ্যাঁসূচক জবাব দিলে তিনি আমাকে ভেতরে নিয়ে একটি রুমে বসতে বলেন। কিছুক্ষণ পর আরেক কর্মকর্তা, সম্ভবত ডেপুটি হাইকমিশনার এসে আমাকে দু'একটি প্রশ্ন করে চলে যান।
বঙ্গবন্ধুকন্যা জানান, তাকে প্রশ্ন করে চলে যাওয়ার পরই আরেক কর্মকর্তা এসে তাকে পরদিন আসার জন্য বলেন। পরদিন ভিসাসহ তার হাতে পাসপোর্টটি যখন দেওয়া হলো তখন তিনি দেখলেন ভিসার উপর লেখা, 'ডটার অব লেইট শেখ মুজিবুর রহমান'।
রেহানা বলেন, এটি দেখে মনটা তখন ভরে গেলেও তাৎক্ষণিক আবার খারাপ হয়ে যায় এই ভেবে যে, বিশ্বব্যাপী এত শ্রদ্ধেয় আমার বাবাকে মেরে ফেলল দেশেরই কজন বিপথগামী।
বিমান টিকিটের জন্য ধরনা
শেখ রেহানা বলেন, ভিসা হলেও লন্ডন যাওয়ার একটি টিকিটের জন্যও অনেকের কাছে ধরনা দিয়েছি। একটি টিকিটের পয়সার জন্য অনেককেই অনুরোধ করলাম, চিঠি লিখলাম। বললাম লন্ডনে এসে চাকরি করে এই পয়সা শোধ করে দেব। কিন্তু কেউই সাহায্যের হাত বাড়ালেন না।
মিসেস গান্ধীই ব্যবস্থা করে দেন
শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বলতে হলো বিষয়টি। মিসেস গান্ধী তখন বললেন, কেন তুমি ইন্ডিয়া ছাড়বে, এখানেই লেখাপড়া কর। আমি তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে আমাকে নিরাপত্তা দিতে রাজি নয় সে বিষয়টি তাকে জানালাম। তিনি বিষয়টি জানতেন না। আমি তাকে বললাম, লন্ডনেই চলে যাই, সেখানে গেলে বিভিন্ন দিক থেকে আমার সুবিধা হবে।
শেষ পর্যন্ত মিসেস গান্ধীই আমার জন্য লন্ডনের একটি বিমান টিকিটের ব্যবস্থা করেন। লন্ডনে এসে উঠি খোকা চাচার বাসায়।
লন্ডনে এসে গাফফার চাচা, এম আর আখতার মুকুলসহ ২-১ জন মানুষের সঙ্গে মাত্র যোগাযোগ হয়। হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকি চাকরি। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার পরিকল্পনাও করতে থাকি। সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় একটি চাকরি। এ সময় টের পাই দায়দায়িত্ব এমনভাবে এসে ভর করেছে আমার ওপর, যা রাতারাতি আমাকে বড় করে তুলেছে। নিজেই নিজের অভিভাবক। লন্ডনে থাকার জায়গা নেই, আশ্রয় নেই, চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি, খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই আমার। আপাকে চিঠি লিখে মাঝে মাঝে পরামর্শ নিই।
মাথার উপর ছায়ার আশায় বিয়েতে মত
এমন পর্যায়ে যখন অনুভব করছিলাম আমার মাথার উপরে একটি ছায়া দরকার, ঠিক তখনই বিয়ের আলাপ আসে। ড. শফিক সিদ্দিক তখন পড়াশোনার জন্য লন্ডনে।
রেহেনা বলেন, এ প্রস্তাব অবশ্য আব্বা বেঁচে থাকতেই নিয়ে এসেছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। কিন্তু আব্বা বলেছেন, পড়ালেখা শেষ হোক এরপর দেখা যাবে।
আব্বা মারা যাওয়ার পর যখন একই প্রস্তাব আবার এলো তখন বোন শেখ হাসিনা তার মতামতের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন বিষয়টি। কিন্তু নিজের মাথার উপরে একটি ছায়ার আশায় বিয়ের প্রস্তাবটিতে সম্মতি দেই। '৭৭ সালে আমাদের বিয়ে হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আইনজীবীকে খুঁজতে থাকি
রেহেনার মাথায় তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার থমাস উইলিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগের চিন্তা কাজ করছিল। উইলিয়ামকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি করার মনোবাসনা তখন রেহানার মনে।
রেহেনা বলেন, লন্ডনে এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত কমিটি গঠনের চেষ্টা করতে লাগলাম। নোবেল বিজয়ী শন ম্যাবক্রব্রাইট, সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর মতিন চৌধুরী, গাফফার চাচা, ড. কামাল হোসেনসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। অনেক চেষ্টার পর সাক্ষাৎ পেলাম স্যার থমাস উইলিয়ামের। উনি তখন রানীর কুইন্স কাউন্সিলর হয়ে লর্ডস সভার সদস্য। আমি তাকে চিনতাম। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে উনি যখন ঢাকায় গিয়েছিলেন আমি তখন তাকে চা-নাস্তা করে খাইয়েছি। মার সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে বসে থাকতাম। থমাস উইলিয়ামও আমাকে দেখে চিনে ফেললেন। তিনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, দূর থেকে তোমাকে দেখে মনে হয়েছে বেগম মুজিব হেঁটে আসছেন। আমার সঙ্গে তখন ড. সেলিমও ছিলেন। সৈয়দ আশরাফ ভাই যেতে পারেননি কি কারণে জানি।
থমাস উইলিয়াম আমাদের সব ধরনের সাহায্য করতে রাজি হলেন
থমাস বললেন, আমি তোমাদের সব ধরনের সাহায্য করব, কিন্তু নিজে কিছুতে থাকতে পারব না। কারণ আমি এখন কুইন্স কাউন্সিলর। আইনজীবীও ঠিক করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি।
শেখ রেহানা জানান, এর পর ১৯৭৯ সালে তিনি সুইডেন যান। সেখানেই প্রথম শেখ হাসিনার নাম দিয়ে ব্যানার টানিয়ে প্রকাশ্য প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন।
রেহেনা বলেন, আমার তখন পাসপোর্ট নেই। আমার পাসপোর্ট এর আগেই কেড়ে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া একটি ট্রাভেলস ডকুমেন্টস নিয়ে যাই সুইডেন। এর পর আস্তে আস্তে সব এগুতে থাকে। আমরা ইন্টারন্যাশনাল মার্ডার এনকোয়ারি কমিটি করলাম। এখানে দুজন আইনজীবী ঠিক করে দিলেন থমাস উইলিয়াম। এভরি রোজ নামে একজন সলিসিটরও ঠিক করে দিলেন তিনি। থমাস উইলিয়ামের একজন ছেলেও আইনজীবী হিসেবে সম্পৃক্ত হলেন কমিটিতে।
আইনজীবীদের ঢাকা যাওয়ার টিকিটের পয়সা সংগ্রহ করা হলো প্রবাসী ভাইবোনদের কাছ থেকে। সাধ্যানুযায়ী সবাই দান করলেন এই তহবিলে। ঢাকায় রাজ্জাক ভাইরাও আনুষঙ্গিক সবকিছু ঠিক করে রাখলেন।
ভিসা না দিতে হাইকমিশন বন্ধ করে দেওয়া হয়
রেহানা জানালেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ঢাকা যাওয়া হয়নি এই টিমের। আইনজীবীরা যেদিন ভিসার জন্য হাইকমিশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, সেদিন পুরো হাইকমিশনই বন্ধ করে রাখা হয়। এটি ১৯৭৯ বা '৮০ সালের কথা।
এর পরও হতাশ না হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত ও বিচারের দাবিতে তৎপরতা চালাতে থাকেন শেখ রেহানা।
তিনি বলেন, সুইডেন থেকে ফিরে আসার পর লন্ডনে আমার সাক্ষাৎ হলো মালেক উকিল, সামাদ আজাদ ও ড. কামাল হোসেন সাহেবের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে নিয়ে আমি ওয়েস্ট মিনিস্টারের কাছে একটি রেস্টুরেন্টে প্রেস কনফারেন্স করলাম, আওয়ামী লীগ নেতা আতা খান সাহেবের রেস্টুরেন্টে। ওই প্রেস কনফারেন্সে আমি একটি লিখিত বক্তব্য রাখলাম। সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের জবাব দিলেন ড. কামাল হোসেন।
রেহানা জানান, এর পর ১৯৮০ সালের দিকে শেখ হাসিনা যখন লন্ডন আসেন তখন পার্টি নেতা-কর্মীসহ অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ হয় তাদের। বিয়ের পর ১৯৭৭ সালের শেষের দিকে লন্ডনে তার প্রথম খোঁজ পান আওয়ামী লীগ নেতা গোস খান, খালেদা দবির ও তৎকালীন ন্যাপ নেতা নিখিলেশ চক্রবর্তী।
বিচার দাবির ক্যাম্পেইন নিয়ে কত বিদ্রূপ
রেহানা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করে আমরা ক্যাম্পেইন শুরু করলাম। এই ক্যাম্পেইন নিয়েও কতজন যে কত বিদ্রূপ করল। লন্ডনে আসার পর চাকরির জন্য যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, তখন কত পরিচিতজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, সবাই এড়িয়ে যেতে চায়। চাকরি নিলাম একটি লাইব্রেরি ও পাবলিশার্স কোম্পানিতে। এর পর তো অনেক পথ পাড়ি দিলাম।
চেনা লোকজন চোখ ফিরিয়ে নিল
শেখ রেহেনা আরও বলেন, আমাদের বাসায় রাত-দিন আসা-যাওয়া করত এমন ব্যক্তিও রাস্তায় দেখা হলে চোখ ফিরিয়ে নিত। অবশ্য কেউ কেউ সাহায্যও করেছেন। এর মধ্যে একজন শিপিং করপোরেশনের বড় অফিসার এ জেড আহমেদ আমাকে খুবই সাহায্য করেছেন। আব্বার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রুহুল কুদ্দুস ও মঈনুল ইসলাম সাহেবও আমার খোঁজখবর নিয়েছেন নিয়মিত। রুহুল কুদ্দুস ও তার স্ত্রী আমার বিয়ের সময় খাবার রান্না করেন। আর বিয়ের উকিল ছিলেন মঈনুল ইসলাম সাহেব। তারা আমার মুরবি্ব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তখন।
আরেকজন ভদ্রলোক ড. শহীদুল্লার নাতি মনসুরুল হক, তাকে আমরা হীরু মামা বলে ডাকি- তিনিও আমার জন্য অনেক করেছেন। উনি এখনো বেঁচে আছেন, আমার সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে। এই হীরু মামার সঙ্গে পথ চলতে আমার পরিচয়। হীরু মামা ও আহমেদ আঙ্কেল এই দুজন আমার জন্য অনেক করেছেন। আসলে এতিমের জন্য আল্লাহই কাউকে না কাউকে পাঠিয়ে দেন, এ দুজন আমার জন্য সেরকমই ছিলেন।