ওরা আসেনি কেউ এগিয়ে


ওরা আসেনি কেউ এগিয়ে-সেনাবাহিনী রক্ষীবাহিনী গোয়েন্দা রাজনীতিবিদ সবার কাছেই যায় বঙ্গবন্ধুর ফোন

যার হাত ধরে বাংলাদেশের জন্ম সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন দেশে এদেশীয় খুনিদের হাতেই জীবন দিতে হলো। চার দশক পরও মীমাংসিত হলো না, জাতির জনককে রক্ষা করতে না পারার দায় আসলে কার। সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, গোয়েন্দা নাকি রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা ছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়। নাকি আন্তর্জাতিক কোনো চক্রান্তের দোসর হয়েছিল এখানকার কিছু সুবিধাভোগী, সেটাও ইতিহাস পরিষ্কার করতে পারেনি। খুনিরা যে বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই তাদের পরিকল্পনা করে তৎকালীন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছে, এটা পরিষ্কার। কিন্তু শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তাদের ভূমিকা কী ছিল, বিপথগামীদের কন্ট্রোল করতে না পারার দায় সত্যিকার অর্থে কার তা নিয়েও পাওয়া গেছে শুধু পরস্পরকে দায়ী করা কিছু বক্তব্য। ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে জাতির, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ হারিয়েছে তার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানকে।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের আগের দিন ১৪ আগস্ট বিকাল ৪টায় খুনি ডালিমকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে মোটরসাইকেলে চড়ে ঘুরতে দেখা গেছে। ডালিম চলে যাওয়ার পর বিকাল সাড়ে ৫টায় খুনি ক্যাপ্টেন হুদাকেও বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাশে মোটরসাইকেলে ঘুরতে দেখা গেছে। অর্থাৎ হত্যা মিশনের সদস্যরা কীভাবে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকবে, কীভাবে অপারেশন শেষ করবে তা ঠিক করতেই তারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অবস্থান এবং আশপাশ রেকি করে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা কেউ ঊর্ধ্বতনদের জানালেন না কেন? না সেনাবাহিনী, না রক্ষীবাহিনী, না পুলিশ না রাজনৈতিক কেউ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কাউকে জানালেন না কেন?

প্রশ্ন আছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাকে হত্যা করা হলো কিন্তু প্রতিরোধে কেন একটিও গুলি হলো না? ক্লু আছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে। একাধিক সাক্ষী জানান, সেদিন ৩২ নম্বরে দায়িত্বে থাকা সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ার্দার ১৫ আগস্ট ভোর সোয়া ৪টার দিকে এসে গার্ড পরীক্ষা করার পর প্রত্যেকের কাছ থেকে অস্ত্রের গুলি নিয়ে যান। পুরান গুলির বদলে নতুন গুলি দেওয়ার কথা বলে সবার গুলি একত্র করেন কিন্তু আর নতুন গুলি দেওয়া হয়নি। ওয়াহাব জোয়ার্দার তার জিপে উঠে চলে যান। প্রশ্ন হলো, সামরিক-বেসামরিক দায়িত্বশীল কেউই এটি দেখল না কেন? নাকি সেই সময় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দায়িত্বে থাকা পাকিস্তান ফেরত সব কর্মকর্তার সমন্বয় হয়েছিল পরিকল্পিত ভাবেই? বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের জন্য বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জামিল ছাড়া আর কারও দায় এড়ানোর সুযোগ আছে কিনা সেটাও বড় ধরনের প্রশ্ন। কারণ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে। ১৯৭৫ সালের স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুর রহিম ও পুলিশের আইজি তছলিম উদ্দিনের ভূমিকা নিয়েও আছে প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধুর আশপাশে থাকা রাজনৈতিক নেতৃত্ব এত বড় চক্রান্ত কিছুতেই রুখতে পারবেন না, এটা মানা যায় না। এত নামি রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও দায় এড়ানোর সুযোগ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ নিছক অভিমানে তারা বঙ্গবন্ধুকে একা ফেলে দূরে চলে দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের সুযোগ করে দিলেন কেন? নিশ্চয়ই এই ব্যর্থতা অনেককে কুরে কুরে খাচ্ছে। যে রক্ষীবাহিনীকে অনেক আদর যত্নে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল, তারাই বা কী করলেন? বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রক্ষীবাহিনীর প্রতিক্রিয়া না থাকাও অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। বলা হয়ে থাকে নানান অপকৌশলে রক্ষীবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, রক্ষীবাহিনীর মতো অত্যাধুনিক অস্ত্রধারী বাহিনীকে এত সহজে শুধু কথার কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করা কি সত্যিই সম্ভব? নাকি তারা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত রেখেছিলেন? গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পটভূমি হিসেবে খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ আর একদলীয় শাসন বাকশালকে দায় দেওয়ার এক ধরনের প্রয়াস আছে অনেক দিন ধরেই। সে সময় বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপুষ্ট একটি দৈনিকে খাদ্য সংকটের বিশাল হেডলাইনের খবর প্রকাশ হতে হতে একদিন উত্তরবঙ্গের বাসন্তী নামের এক নারীর ছেঁড়া জাল পরা ছবি ছাপা হয়। অর্থনৈতিক অবস্থার দুর্দিনে রোল তুলে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। ব্যর্থ রাষ্ট্রের তিলক পড়ে বাংলাদেশের ওপর। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কয়েক দিন পর সেই ছবির ফটোগ্রাফার নিজেই স্বীকার করেন, ছবিটি ছিল সাজানো এবং নারীর মস্তিষ্ক ছিল বিকৃত। তাহলে প্রশ্ন হলো, বঙ্গবন্ধুর সন্তানতুল্য সেই সম্পাদকও কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরির দায় এড়াতে পারেন?
ঐতিহাসিক নানান বক্তব্য ও গ্রন্থ থেকে এটা পরিষ্কার যে, ৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় চার মাস আগেই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সতর্ক করেছিলেন। এরপর সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আর সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু একে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কোনো বাংলাদেশি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে না এমন আত্মবিশ্বাস থেকেই এই শঙ্কাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু কথা উঠেছে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর তৎকালীন গোয়েন্দা বাহিনী কী করেছে, তাদের ভূমিকা কী ছিল? কারণ সাধারণভাবেই সামরিক গোয়েন্দাদের কাছে নিজস্ব বাহিনীর আগাম তথ্য ভান্ডার থাকার কথা। অথচ অন্তত দুই ডজন আত্মজীবনীতে এ তথ্য পাওয়া গেছে যে, খুনি ডালিম ও রশীদরা প্রায় এক বছর আগে থেকেই হত্যার পরিকল্পনা করে আসছিল এবং এই পরিকল্পনা নিয়ে তারা তৎকালীন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পরবর্তীতে খুনি ফারুক রশীদ ১৯৭৬ সালে সানডে টাইমস ও বিদেশি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জে. জিয়ার মদদ দেওয়ার কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিন পর খুনি চক্র জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে পদোন্নতি দেয়। শুধু জিয়াই নয় জেনারেল ওসমানী, খালেদ মোশাররফ, জেনারেল এরশাদ, কর্নেল তাহেরসহ আরও অনেকের ঐতিহাসিক ভূমিকাই ছিল সন্দেহজনক। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সম্পর্কে লেখা এক বইয়ে গবেষক অলোক রায় লিখেছেন, অভ্যুত্থানের আগে সে বিষয়ে আলোচনার জন্য জিয়ার বাসায় ফারুক, রশীদ ও জেনারেল ওসমানী বৈঠক করেছিলেন। এ খবর পাওয়ার পর র-এর প্রধান কাও এসে কথা পর্যন্ত বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, খুনিদের এত এত প্রস্তুতির বিষয়গুলো সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দাদের ও সেনাবাহিনীর তৎকালীন নেতৃত্বের অজানা থাকার কথা নয়। তৎকালীন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর সঙ্গে সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর কথাও হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু আটকানো যায়নি।

সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় পুলিশ বাহিনী ও রক্ষীবাহিনী ছিল নিষ্ক্রিয়। অনেকেই বলে, অর্ডার দিলেই রক্ষীবাহিনী কাজ করত। আসলে তা নয়, রক্ষাবাহিনী ট্যাংক দেখেই ভয় পেয়েছিল। সহসাই যে আক্রমণ করবে সে প্রস্তুতি তাদের ছিল না। এটা তাদের ব্যর্থতা। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সিআইয়ের লোক ছিল। তারাও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল। সেনাবাহিনীর কমান্ড যদি দ্বিধাবিভক্ত না থাকত, সেনাবাহিনীতে সবাই যদি দেশপ্রেমিক থাকত, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করা যেত। যদিও উপসেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান জানতেন, নিচের লেভেলের কিছু কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করছেন। সামরিক বিধিতে আছে, এই ধরনের কোনো ষড়যন্ত্র যদি কোনো অফিসার বা সদস্য করতে চায় সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করা এবং কোর্ট মার্শালের আওতায় আনা দরকার ছিল। স্বাধীনতাবিরোধী যারা, গোলাম আযমের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধারের নেতৃত্বে ছিল তারাও এই ঘটনায় জড়িত ছিল। রাজনীতিবিদরাও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তৎকালীন সময়ে যুবলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে কোন্দল প্রকাশ্যে চলে আসে। সে কোন্দলের সুযোগও ঘাতকরা গ্রহণ করেছে। তারা যদিও একত্রিত থাকত, তাহলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত, সেটাও সম্ভব হয়নি। তখন আওয়ামী লীগের কমিটি ছিল না। রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ-বাকশাল যে অবস্থায় ছিল তারা ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের মতে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ একটি সম্মিলিত ব্যর্থতার ফল। এর দায়দায়িত্ব অনেককেই নিতে হবে। আর এর ক্ষতিপূরণ দিয়ে যেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

SUMMARY

1410-B3.jpg