রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে প্রথম বঙ্গবন্ধু উপাধি ব্যবহার করেন ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। এই কৃতিত্বের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে আছে চট্টগ্রামের সন্তান মুশতাকের নাম। শেখ মুজিব কীভাবে বাঙালির
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তখন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। '৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের গণসংবর্ধনায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ডাকসুর তৎকালীন সহসভাপতি, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও বর্তমান মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসীর পক্ষ থেকে 'বঙ্গবন্ধুু' উপাধিতে ভূষিত করেন।
তবে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন তখনকার ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সাবেক সভাপতি মুশতাক চট্টগ্রামেরই সন্তান। আনোয়ারার ভিংরোল গ্রামে তার জন্ম। বর্তমানে তিনি ঢাকায় ব্যবসা করেন। রেজাউল হক মুশতাক জড়িত আছেন নানা সামাজিক সংগঠনের সাথেও। ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সাবেক সভাপতি তিনি।
সেই ঐতিহাসিক সময়ে শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার স্মৃতিচারণ করেন রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। তিনি বলেন, "১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ 'প্রতিধ্বনি' নামক একটি মাসিক পত্রিকা বের করত। সে পত্রিকার একটি সংখ্যায় আমি 'সারথী' ছদ্মনামে 'আজবদেশ' শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখি। লেখাটার শেষ দিকে 'বঙ্গশার্দূল' শেখ মুজিবের পাশে প্রথম 'বঙ্গবন্ধু' শব্দটি ব্যবহার করি।"
বলাবাহুল্য, তখন থেকেই শেখ মুজিরের নামের সাথে এতদিনের প্রচলিত 'মুজিব ভাই', 'বঙ্গশার্দূল', 'সিংহশার্দূল' ইত্যাদি বিশেষণকে রীতিমতো প্লাবিত করে 'বঙ্গবন্ধু' নামটিই সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 'বঙ্গবন্ধু' নামটি পরবর্তীকালে তার নামের সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে, 'বঙ্গবন্ধু' উচ্চারণ করলে আর শেখ মুজিব বলতে হয় না। একইভাবে শেখ মুজিব নাম উচ্চারিত হলেই 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিটিও চলে আসে অবলীলায়। আজ শেখ মুজিব মানে 'বঙ্গবন্ধু', 'বঙ্গবন্ধু' মানেই শেখ মুজিব।
রেজাউল হক চৌধুরী মুশকাত বলেন, 'শেখ মুজিবের নামের সাথে সুনির্দিষ্ট কোনো বিশেষণ তখনও যুক্ত হয়ে ওঠেনি। বিভিন্ন জনবিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন নামকরণ করলেও কোনোটি তেমন স্বীকৃতি লাভ করেনি। শেখ মুজিবুর রহমান তখনও 'বঙ্গবন্ধু' নামে পরিচিত নন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে তিনি মুজিব ভাই সম্বোধনে পরিচিত। ১৯৬৬ সাল থেকে তার নামের আগে তরুণ সমাজ 'সিংহশার্দূল', 'বঙ্গশার্দূল' ইত্যাদি খেতাব জুড়ে দিতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবের নামের সাথে একটি যথাযথ বিশেষণ যুক্ত করার চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। তখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অসারতা উল্লেখ করে আমি একটি নিবন্ধ রচনা করি।
চার পৃষ্ঠাব্যাপী এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্তি্বকভাবে দুটো পৃথক অঞ্চল হিসেবে পাকিস্তানের দুই অংশের সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্যকে জোরালোভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই নিবন্ধে গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের নামের সাথে প্রচলিত বিভিন্ন বিশেষণের পাশাপাশি সর্বপ্রথম লিখিত আকারে আমি 'বঙ্গবন্ধু' বিশেষণটি ব্যবহার করি।' প্রসঙ্গক্রমে রেজাউল হকের নিবন্ধের উপসংহার অংশটুকু তুলে ধরা হলো :
"পরিশেষে একটি কথা বলা যায়, দুই অংশের পার্থক্য ও অমিলকে স্বীকার করে দুই অংশের পৃথক ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে পাশাপাশি স্থান দিয়ে ও সর্বোপরি পূর্ব বাংলার নয়নমণি-মুক্তিদিশারী, 'বঙ্গবন্ধু', সিংহশার্দূল শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রস্তাবিত ছয় দফা কর্মসূচির বাস্তবায়নের মাধ্যমে আজব ও অভিনব পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি টিকে থাকতে পারে নতুবা নয়।"
১৯৬৭ সালে এসএসসি পাস করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে যান রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। লেখাপড়ার পাশাপাশি উত্তপ্ত ছাত্র আন্দোলন তাকে উজ্জীবিত করে। ওই সময় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম পুত্র শেখ কামালের সাথে সহপাঠী হিসেবে তার পরিচয় ঘটে ঢাকা কলেজেই। ১৯৬৭ সালে রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এবং একই সাথে লেখাপড়ায় ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওই সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল বহুমাত্রিক।
ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের খবর প্রকাশ, বিকাশমান বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক ও শেখ কামাল একটি বুলেটিন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। বুলেটিনের নামকরণ করা হয় 'প্রতিধ্বনি'। সেই বুলেটিনের একটি সংখ্যায় একটি নিবন্ধে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে প্রথম ভূষিত করেন রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক।
বাঙালী স্বাধীকারের সময় চট্টগ্রামে ছাত্র আন্দোলন কেমন ছিল? এই প্রশ্নের জবাবে রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক বলেন, 'জাতির যুগসন্ধিক্ষণে (১৯৬৫ সালে) আমি তখন চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। তারুণ্যের সমগ্র উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে চলমান ঘটনাকে অবলোকন করতাম চরম বিস্ময়ের সাথে। এই বোধ থেকেই জড়িত হই তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের মূল স্ট্রোতধারা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের সাথে। পড়াশুনার পাশাপাশি স্কুল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন এবং একই সাথে ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুবাদে আমি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই চট্টগ্রামের সামগ্রিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে জড়িত হয়ে পড়ি। ঢাকায় গিয়ে সেই সম্পৃক্ততা দারুণ কাজে লাগে।'
রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাকই যে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিলেন তার সাক্ষ্য পাওয়া যায় ১৯৮৭ সালের ৩১ জুলাই দৈনিক 'বাংলার বাণী' পত্রিকায় প্রকাশিত কলামিস্ট ওবায়দুল কাদেরের (ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি ও বর্তমান সেতু ও যোগাযোগমন্ত্রী) এক লেখায়। ওবায়দুল কাদের লেখেন, "মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত হন লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশে, ১৯৬৯ সালে। অবিস্মরণীয় গণবিস্টেম্ফারণের চূড়ান্ত পর্যায়ে সে আন্দোলনের অগ্রণী বাহিনী ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবকে রেসকোর্সের স্বতঃস্টম্ফূর্ত বিশাল জনসমুদ্রে ডাকসুর সহ-সভাপতি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা তোফায়েল আহমদ 'বঙ্গবন্ধু' খেতাবে ভূষিত করেন। সেটা অবশ্য আরও পরের ঘটনা। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কার মাথায় প্রথম 'বঙ্গবন্ধু' শব্দটি এসেছিল। এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে খানিকটা পেছনে যেতে হয়। তখন সম্ভবতঃ ১৯৬৭ সাল। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ 'প্রতিধ্বনি' নামক একটি মাসিক পত্রিকা বের করতো। সে পত্রিকার একটি ইস্যুতে ছাত্রলীগের রেজাউল হক মুশতাক 'সারথী' ছদ্মনামে 'আজবদেশ' নামে একটি লেখা লেখেন। লেখাটার শেষ দিকে 'বঙ্গশার্দুল' শেখ মুজিবের পাশে প্রথম 'বঙ্গবন্ধু' শব্দটি ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে একই পত্রিকায় ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসের ইস্যুতে 'বঙ্গবন্ধু' শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তাবিত পূর্ব বাংলার 'মুক্তিসদন' ৬ দফা শিরোনাম হয়ে আসে। তখন অবশ্য ছোট হেডিংয়ে অখ্যাত এক পত্রিকায় ব্যবহৃত 'বঙ্গবন্ধু' শব্দটি ঢাকার ছাত্র মহলের একাংশ ছাড়া অন্যকারও নজর কাড়েনি। হয়তো স্থান কাল পাত্রের বিবেচনায় সে সময় শেখ মুজিবের নামের সাথে এমন একটা বিশেষণ প্রয়োগের ভাবনাটা তেমন গুরুত্ব পায়নি। ওটা গুরুত্ব পায় ঠিক তখন যখন জাগ্রত বাঙ্গালি জাতির জাগরণের সব স্ট্রোতধারা এক মোহনায় একাকার, যখন গণমোহন মুজিব বিদ্রোহী বাংলার মুকুটহীন সল্ফ্রাট। বলা দরকার, মুজিবের জন্য যুৎসই খেতাব হিসেবে 'বঙ্গবন্ধু' শব্দটি শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান ও '৬৯ এর তরুণ নেতৃত্বের সকলের খুবই পছন্দ হয়েছিল।"
বঙ্গবন্ধুর কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে? এমন প্রশ্নে রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক বলেন, "১৯৬৮ সালে সর্বপ্রথম 'বঙ্গবন্ধু' নামকরণ করার পাশাপাশি আমার উদ্যোগে ও আমার ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু রায়হান ফেরদাউস মধুর সহযোগিতায় ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম 'বঙ্গবন্ধু'র জীবনী বিষয়ে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছিলাম। দেড় ফর্মার পুস্তিকাটির নাম ছিল 'এই দেশেতে জন্ম আমার'। প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন মরহুম কালাম মাহমুদ। বর্তমানে দুস্প্রাপ্য এই পুস্তিকাই 'বঙ্গবন্ধু'র জীবনী বিষয়ক সর্বপ্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত পুস্তিকা। এই পুস্তিকাটি যখন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে দিলাম, তখন খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ আদর করলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু আবেগ আপ্লুুত হয়ে বললেন, 'ছাত্রলীগের ছেলেরা এত সুন্দর প্রকাশনা বের করতে পারে আমার ধারনাই ছিল না'। তিনি আরো বললেন, 'এটা প্রকাশ করতে তোর তো অনেক টাকা খরচ হয়েছে'। আমি ছিলাম নিরুত্তর। অতঃপর বঙ্গবন্ধু পাঁচশত টাকার একটি নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, 'এটি তোর কাছে রাখ'।"
বঙ্গবন্ধুর এই দুর্লভ স্মৃতিই রেজাউল হক মুশতাকের কাছে অমূল্য।