চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর বার্তাটি গ্রহণ করেন সিগন্যালম্যান খায়ের

   
সাহাদাত হোসেন পরশ

চট্টগ্রামের হালিশহরে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) ৫ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তরে সিগন্যালম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন আবুল খায়ের। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। নাইট শিফটে উিউটি ছিল তার। রাত ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে ঢাকার পিলখানা থেকে ওয়্যারলেসে একটি বার্তা পান তিনি। বার্তাটি পাঠান সুবেদার মেজর শওকত আলী। সাংকেতিক ভাষায় পাঠানো বার্তাটি পড়ে দ্রুত এর দুটি কপি তৈরি করেন তিনি। একটি মূল, অন্যটি কার্বন কপি। ওই বার্তাতেই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। ওপরে লেখা ছিল- 'মেসেজ ফ্রম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান'। নিচে লেখা- 'দিস মেসেজ পাস টু বেঙ্গলি অফিসার'। বার্তাটি তিনি চট্টগ্রাম ইপিআরে দায়িত্বরত বাঙালি অ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের (পরবর্তীকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন) কাছে হস্তান্তর করেন। রফিকুল ইসলাম সেই রাতে সেক্টর সদর দপ্তরে ডিউটিতে ছিলেন। এই মেসেজের আলোকেই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়। শুধু চট্টগ্রাম নয়, বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা দেশের বিভিন্ন মহকুমায়  আওয়ামী লীগ নেতারা পেয়েছিলেন।

ইপিআরের তৎকালীন সিগন্যালম্যান মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সমকালকে বলেন, 'ওই রাতেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কার্বন কপি থেকে হুবহু আরেকটি নতুন কপি করি। সেটা আবেগ আর ভালোবাসা থেকেই করেছিলাম। যদি কার্বন কপির লেখা মুছে যায়। তাহলে তো অমূল্য এই দলিল হারিয়ে ফেলব। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অনুলিপি শার্টের পকেটে নিয়ে ভারতে চলে যাই। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ১০-১২ বছর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অনুলিপি নিজের কাছে রেখেছি। পরে তা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। এরপর স্মৃতি থেকে আরেকটি কপি করেছি, সেটা এখন সবসময় নিজের কাছে রাখি।'

আবুল খায়ের ২০১১ সালে সুবেদার মেজর হিসেবে সীমান্তরক্ষী বাহিনী থেকে অবসরে যান। বর্তমানে রাজধানীর দক্ষিণখানের গাওয়াইর এলাকায় পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন তিনি।

আবুল খায়ের বলেন, '৪১ বছর সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে চাকরি করেছি। বয়স ৬৫ হয়ে গেছে। কতদিন আর বাঁচব। জীবনের শেষ বেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি পোস্ট অফিসের মাধ্যমে তার কাছে একটি চিঠি লিখেছি। তবে এখনও উত্তর পাইনি।' তার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠিটি পৌঁছলে তিনি অবশ্যই তাকে ডেকে পাঠাবেন। সেই দিনটির অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি।

ইপিআরের সাবেক এই সদস্য জানান, ১৯৭০ সালের জুনে তৎকালীন ইপিআরে যোগদান করেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি নড়াইলের লোহাগড়ার পোদ্দারপাড়ায়। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত বার্তা পাওয়ার পরপরই তার মনে হয়েছে, এটা ফরোয়ার্ড করা কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তবে এসব ঝুঁকি বা ভয়কে কোনো তোয়াক্কা করেননি। কারণ ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই তো বুঝে গিয়েছেন চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

আবুল খায়ের জানান, ২০১০ সালে খোঁজ নেওয়া হয়- স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি কীভাবে টেলিগ্রাম মেসেজ থেকে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের কাছে গেল। তখন জানাজানি হয় তিনিই সেই ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধু তার বিশ্বস্ত লোকজনের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি ইপিআরের তৎকালীন সুবেদার মেজর শওকত আলীর কাছে পাঠান। তিনি ওই সময় পিলখানার ভেতরে দুই নম্বর গেট সংলগ্ন সরকারি কোয়ার্টারে বসবাস করতেন। শওকত ছিলেন অত্যন্ত সুদক্ষ টেকনিশিয়ান। এ ব্যাপারে তিনি বিদেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। তার নিজ উদ্ভাবিত ট্রান্সমিটারও ছিল।

'মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর' বইতে বলা হয়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী আরেফসহ কয়েকজন ছাত্র পিলখানার ২ নম্বর গেটে তৎকালীন ইপিআর সুবেদার মেজর (সিগন্যাল) শওকত আলীর (পরবর্তীকালে শহীদ হন) কাছে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হস্তান্তর করেন। শওকত আলী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পিলখানাস্থ ইপিআর ওয়্যারলেসযোগে টেলিগ্রাফিক মেসেজের মাধ্যমে চট্টগ্রামে কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে পাঠান। চট্টগ্রামে ইপিআরের কর্তব্যরত সিগন্যালম্যান মো. আবুল খায়ের মেসেজটি গ্রহণ করেন। আবুল খায়ের সেই মেসেজ ইপিআরের বাঙালি অ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকের কাছে হস্তান্তর করেন। পিলখানা থেকে পাঠানো বার্তাটি চট্টগ্রামে একটি বিদেশি জাহাজে ধরা পড়ে। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সে ব্যাপারে অবগত হয়। স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি পাঠানোর অপরাধে সুবেদার মেজর শওকত আলীকে তার পিলখানার বাসা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা প্রেরণকারী এই দুঃসাহসী বীর যোদ্ধাকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অমানুষিক নির্যাতন করে। পরে ২৯ এপ্রিল তাকে হত্যা করা হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুবেদার মেজর শওকত আলীর মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সেলিনা পারভীন বলেন, 'স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনি। বঙ্গবন্ধু জানতেন কাকে দিয়ে কী কাজ করাতে হবে। সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যক্তিকে বাছাই করেছিলেন তিনি। আমার বাবা জানতেন পিলখানার ভেতরে বসে এত বড় ঝুঁকির কাজ করলে তিনি অবশ্যই ধরা পড়বেন। সেটা জেনেও তিনি জীবনের ঝুঁকি নিতে পিছপা হননি। ' 

SUMMARY

140-1.jpg