স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তি ১০ এপ্রিল


বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক কে? এ নিয়ে বিগত প্রায় তিন যুগের তর্ক-বিতর্কে স্বাধীনতা ঘোষণার বৈধতার মূল কথাই সব চেয়ে কম আলোচিত হয়েছে। ফলে এসব বিতর্ক গ্রাম্য ঝগড়ার স্তরেই থেকে গেছে।

স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত আদালতের একটি রায় থাকার পরও এবারের ২৬ মার্চ উপলক্ষ্যে প্রধান প্রধান পত্রিকাতেও স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে সব কলাম ছাপা হয়েছে তাতে স্পষ্ট ওই আলোচনা এখনও চলমান। ‘কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা’ শিরোনামে প্রথম আলোয় যে লেখাটি ছাপা হয়েছে তাতে শোভা পাচ্ছে শুধু জিয়ার ছবি! আদতে স্বাধীনতার ঘোষকের তালাশ একটি ভুল সুড়ঙ্গে ঘুরে মরছে। সবার আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য কে কবে কী বক্তব্য দিলেন না দিলেন ইত্যাদি।

‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ ধারণাটি কী সে বিষয়ে অস্বচ্ছতার কারণেই এমনটি ঘটে চলেছে। বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে গৃহীত হয়। নানা পালাবদল হলেও এই সংবিধানই ধারাবাহিকভাবে শাসনের মূল বিধান হিসেবে রয়েছে। এই সংবিধান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কারা? পাকিস্তানের সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে ’৭০ এর নির্বাচন খ্যাত নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা এই সংবিধান প্রতিষ্ঠা করেন। ’৭১ এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনা বাহিনী গণহত্যায় নামলে পালিয়ে ভারতে গিয়ে এই সাংসদরা গণপরিষদ গঠন করে একটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেন। ’৭১ এর ১০ এপ্রিল এটি গৃহিত হয়। ’৭২ এর সংবিধান এই ১০ এপ্রিলে গৃহিত স্বাধীতার ঘোষণাপত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষণীয়, মার্চে পাকিস্তানি শাসকরা গণপরিষদ অধিবেশন স্থগিত করে তেমনই পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। ৭ মার্চে তার ভাষণে বেতন প্রদানের মতো খুঁটিনাটি বিষয়ে বক্তব্যে স্পষ্ট যে কার্যত তারই শাসন চালু হয়ে গিয়েছিল এই বাংলায়।

৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এটি খুবই পরিষ্কার গণপরিষদ তারা ত্যাগ করছেন না। ভোটের বাক্সে লাথি মারার মতো কোনো হঠকারী পথ তারা নেননি। ভাষণে তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের একজনও যদি কোনো ন্যায্য কথা বলে তা তিনি মেনে নেবেন। আবার বলেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এ দুটো কথায় পাকিস্তান অখণ্ড থাকা বা দ্বিখণ্ডিত হওয়ার চাইতে মূখ্য হয়ে ওঠে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন কায়েম করার অভিপ্রায় যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব এরই মধ্যে কায়েম হয়ে গেছে। শুধু দেশেই নয় তাবৎ বিশ্বেই অধিকারের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় যেটি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শক্তি কেন্দ্র। তবে এই ভাষণ কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল না। বরং স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার মতো সংকট তৈরির ব্যাখ্যাসহ ঘোষণাদানের ন্যায্য অধিকার সেদিন এই ভাষণের বক্তব্যে পাওয়া যায়।

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে সারা দেশেই সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু স্বগৃহ থেকে গ্রেপ্তার হন। আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারা যে যার মতো করে পালিয়ে ভারতে পাড়ি দেন। সেখানে ’৭০ নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা মিলিত হন। ১০ এপ্রিল তারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি গ্রহণ করেন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে পালন করেন আনুষ্ঠানিকতা।

এই ঘোষণাপত্রে নির্বাচিত সাংসদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি শাসকদের গণহত্যা শুরু করার প্রসঙ্গ সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়। ওতে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানে তাদের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠাও করা হয়। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণার বৈধতা প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা ছিল জনপ্রতিনিধিদের হাতে। ঘোষণায় বলা হয়েছে- তারা জনগণের বৈধ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধি, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার জনগণের নেতা। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, নেতা নির্বাচন, স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি সব কিছুই একে একে উল্লেখ করা হয় এই ঘোষণাপত্রে।

তাদের এই ঘোষণাটি সাংবিধানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার হতে পারতো যদি না তারা সেখানে উল্লেখ করতেন, ‘এরা আগেই ২৬ মার্চ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।’ অর্থাৎ তারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত করছেন ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন কী দেননি না স্বীকার বা অস্বীকার করার ক্ষমতা শুধুই ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর বর্তায়। খুব রুঢ়ভাবে বললে বলতে হয়– ১০ এপ্রিলের এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি বাতিল করার ক্ষমতা শুধুমাত্র ’৭০এর নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদদেরই ছিল। নির্বাচিত সাংসদরাও যেমন এই ঘোষণার বিরুদ্ধে দাঁড়াননি, তেমনই বঙ্গবন্ধুও কোনো অস্বীকৃতি জানাননি।

এমন কোনো রীতি বা বিধান নেই যে স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিও, টেলিভিশন অথবা জনসম্মুখে দিতে হবে। একটি স্বীকৃত স্বাধীনতার ঘোষণার মৌলিক বিষয়টি হচ্ছে এর ঘোষকের এ কাজের কর্তৃত্ব। সেই কর্তৃত্ব প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতারা সঠিকভাবেই ধারাবাহিকতাসহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সে সময়ের পার্লামেন্ট যখন নিশ্চিত করে যে শেখ মুজিব ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তখন আর চট্টগ্রামে শেখ মুজিব যে ঘোষণাটি পাঠান সেটি আর মূখ্য কিছু থাকে না। তাই চট্টগ্রামের বেতার থেকে নানা জনের স্বাধীনতার ঘোষণা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র প্রতিরোধের মতোই উদ্দিপনা সৃষ্টির মতো ইতিহাসের এক একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা মাত্র। সেগুলোর কোনোটিই স্বাধীনতার ঘোষণা নয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাটি কীভাবে চট্টগ্রামে গেল সেটি প্রমাণে বা অপ্রমাণে বিগত দিনের শ্রম নিয়োগ ছিল অর্থহীন।

এই ঘোষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ব্যক্তি মুজিব বা আওয়ামী লীগ নেতা মুজিব নন বরং জনপ্রতিনিধিদের মনোনীত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাটি গৃহীত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে প্রবাসী গণপরিষদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটির বৈধতা প্রদানে সুচিন্তিত পন্থাই অনুসরণ করা হয়েছিল সেদিন। ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির কসোভোর স্বাধীনতা ঘোষণার ওপর আন্তর্জাতিক আদালতের মতামতটি লক্ষ্য করলে এটি স্পষ্ট হয়। যেখানে আন্তর্জাতিক আদালতের দীর্ঘ মতামতে ঘোষকের কর্তৃত্বের ওপর আলোকপাত করতে দেখা যায়। ওরাও স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে গিয়ে জনগণের প্রতিনিধি বলে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

স্বাধীনতার ঘোষণা বিতর্কে বিএনপি ও তার সমমনারা দাবি করেন মেজর জিয়া নিজেকে সরকার প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। অন্যরা বলেন, জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন। প্রথম আলোর উল্লেখিত প্রবন্ধে বলা হয়েছে– জিয়া নিজেকে Provisional head of the Swadhin Bangla Liberation Government হিসেবে ঘোষণা দেন।

যিনি নিজেকে সরকারপ্রধান হিসেবে দাবি করে ঘোষণা দিলেন তিনিই আবার মুজিবনগর সরকার গঠনের পর সেই সরকারের একজন সেনা কর্মকর্তার চাকুরে হলেন! তবে কী নিজের ঘোষণাটির মর্মার্থ অনুধাবন করতে অপারগ ছিলেন জিয়া? নাকি এটিকে তার মুজিবনগর সরকারের কাছে আত্মসমর্পন হিসেবে বিবেচনা করা হবে? যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা প্রধানও হতে পারলেন না তারই নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে গলা ফাটানো কেন!

কোনো দেশের ক্রান্তিকালে একাধিক রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় নামতে পারে। অনির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তিও ক্ষমতা দখলে এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাবশালী ঘটনাই ঘটেনি।

কসোভোর ওই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে মতামতে আন্তর্জাতিক আদালত বলছে, বিগত কয়েক শতকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে যতগুলো অঞ্চল থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ততগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়নি। মূল কথাটি স্বাধীনতা অর্জন করা। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। রাষ্ট্র গঠনে তারা ব্যর্থ হলে তাদের ১০ এপ্রিলের ঘোষণাটি যেমন মূল্যহীন হতো বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন বলে তাদের দাবিটিও অর্থহীন হয়ে পড়তো।

এমন প্রশ্নও ওঠে– পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বাংলাদেশের সংবিধান রচনার বৈধতা কোথায়? স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার, যুদ্ধ করার, দেশ স্বাধীন করার এখতিয়ার যদি এই সাংসদের থাকে তবে সংবিধান রচনার কর্তৃত্ব থাকবে না কেন? কসোভোর স্বাধীনতার ঘোষণা যদি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘণ না হয়ে থাকে তবে মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাও তার ব্যতিক্রম নয়। যদিও পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। দেশভাগের পর যে অংশটুকু নিয়ে পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয় সে অঞ্চল থেকে নির্বাচিত বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি ও আসাম লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি এই দুই অ্যালেম্বলির জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই সেদিন এই নতুন দেশের অ্যাসেম্বলি গঠন করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব যারা অস্বীকার করেন তাদের বলি– ইতিহাসে কারো অবদান স্বীকার করলেই তার রাজত্ব চিরস্থায়ী হয় না। মহাত্মা গান্ধী ও জিন্নার ছবি তাদের নিজ নিজ দেশে মর্যাদার সঙ্গেই টাঙানো রয়েছে।

১০ এপ্রিল ১৯৭১ ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ঘোষণা

মুজতবা হাকিম প্লেটোসাংবাদিক

SUMMARY

1394-1.jpg