বিমল সরকার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেকবারই কারাভোগ করেছেন। সবশেষ তার কারাবাস হয় ১৯৭১ সালে। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করার পর টানা সাড়ে নয় মাস তাকে পাকিস্তানের নির্জন কারা প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমাদের বিজয় পরিপূর্ণতা লাভ করে। চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করলেও জাতির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অপূর্ণতা কিন্তু থেকেই যায়। দেশজুড়ে বিজয়ের এত আনন্দ-উল্লাসের মাঝে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুই অনুপস্থিত! শেষ পর্যন্ত বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাক সামরিক জান্তা মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু ওদের রোষানল থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশের মাটিতে তার পা রাখতে সময় লেগে যায় আরও এক সপ্তাহ। ৮ জানুয়ারি পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমান বঙ্গবন্ধুকে বহন করে লন্ডনের উদ্দেশে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করে। ১০ ঘণ্টা পর (বাংলাদেশ সময় ১২টা ৩৬ মিনিট) বিমানটি হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে বারবার বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভ এবং লন্ডন রওনা হওয়ার খবর প্রচারিত হতে থাকলে কেবল দেশবাসীর মধ্যেই নয়, বিদেশে- বিশেষ করে লন্ডনে অবস্থানরত বাঙালি ও বাংলাদেশ সমর্থকদের মাঝেও ব্যাপক আনন্দ ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। কৌতূহলের সৃষ্টি হয় বিদেশি সাংবাদিকদের মাঝে- নতুন দেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব আসলে কেমন। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে এসে তিনি প্রথমে কী বলবেন এবং কী করবেন।
বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বঙ্গবন্ধু উন্নতশিরে প্রবেশ করেন জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন কক্ষে। এ সময় তিনি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে সমবেত অন্তত দু’শ সাংবাদিককে অভিনন্দন জানান। সাংবাদিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই বলেন, ‘আমি বেঁচে আছি, সুস্থ আছি।’ শত শত বাঙালি ও বাংলাদেশ সমর্থক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানায়।
লন্ডনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি আমার জনগণের মাঝে ফিরে যেতে চাই। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নই আমি।’ তিনি বলেন, ‘‘যখন আমার জনগণ আমাকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে সেল-এ বন্দিজীবন কাটাচ্ছি। অবশ্য ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় কখনও প্রকাশ করা হয়নি। একটি খুব খারাপ স্থানে কল্পনাতীত একাকিত্বে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে।
কোনো রেডিও না, চিঠি না, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না।’’ উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে আবেগঘন পরিবেশে পিনপতন নীরবতায় সেই দুঃসহ সময় অতিবাহিত করার বর্ণনা দেন বঙ্গবন্ধু।
সাংবাদিক পরিবেষ্টিত অবস্থায়ই বঙ্গবন্ধু কথা বলেন ঢাকায় তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং পরিবার-পরিজনের সঙ্গে। সংক্ষিপ্ত কথা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। তাজউদ্দীনের কাছে প্রথমেই বঙ্গবন্ধু জানতে চান দেশের মানুষের কথা। তিনি বলেন, ‘হ্যালো, তাজউদ্দীন; আমি সাংবাদিক পরিবেষ্টিত হয়ে আছি। আমি তাদেরকে কী বলব? দেশের মানুষ কেমন আছে? বর্বর পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে যে অগণিত নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছে, এ মুহূর্তে তাদের কথা আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে।’
ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিতে এ সময় আনন্দ-বেদনা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর আবেগ-ব্যাকুলতা যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির আঙিনা ও বাইরে অজস্ত্র মানুষের ভিড়। সবারই কৌতূহল লন্ডন থেকে পাওয়া সবশেষ খবরটি জানতে। একসময় বাবার চিরচেনা গলার আওয়াজটি এসে পৌঁছল আদরের ছোট কন্যা রেহানার (শেখ রেহানা) কানে- ‘মা, কেমন আছ তোমরা?’ দু’-একটি কথা হয় পিতা-কন্যার মাঝে। বঙ্গবন্ধুর নয়নের মণি শিশুপুত্র রাসেল তখন আনন্দে উদ্বেলিত। অবুঝ রাসেলও বুঝে গেছে দীর্ঘদিন পর শিগগিরই তার ‘পাপা’ সবার মাঝে ফিরে আসছেন। বোধকরি সে-ও অনুমান করতে পেরেছিল বাবার ব্যাকুলতা ও মনের অবস্থা। টেলিফোনের রিসিভারটি কানে চেপে ধরে ৯ বছরের রাসেল প্রথমেই উচ্চারণ করে ‘পাপা, আমরা সবাই ভালো আছি।’
সারাক্ষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটে বেগম মুজিবের। নির্বাক হয়ে ঘরে বসেছিলেন তিনি। হয়তো বা শুনছেন ‘লন্ডন-ঢাকা কথোপকথনের’ কোনো কোনো শব্দ, বাক্য, উচ্চারণ, ধ্বনি-প্রতিধ্বনি বা অনুভূতির কথা। টেলিফোনের রিসিভারটি উঠল তার হাতে। ২৮৮ দিন পর বেগম মুজিব আবারও শুনতে পেলেন স্বামীর চিরচেনা সেই কণ্ঠস্বর এবং সদা-অভ্যস্ত সম্বোধনটি (রেণু)। আবেগের আতিশয্যে বেগম মুজিব স্বামীর সঙ্গে সহজভাবে তেমন কোনো কথাই বলতে পারেননি।
পরে তার বাসভবনে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সাংবাদিকদের জানান, লন্ডন থেকে টেলিফোন আসার পর তিনি আবেগে এতই অভিভূত হয়ে পড়েন যে প্রথমবার কথাই বলতে পারছিলেন না। বেগম মুজিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘দ্বিতীয়বার কল আসল। শেখ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন আমি কেমন আছি। আমি বললাম, আমরা ভালো আছি; আপনি কেমন আছেন?’ বেগম মুজিব স্বামীর সঙ্গে এর বেশি আর কিছু বলতে পারলেন না। তিনি তার বড় ছেলে কামালকে (শেখ কামাল) ডেকে রিসিভার দেন বলে জানান।
লন্ডন থেকে ঢাকায় এরূপ ঐতিহাসিক কথোপকথনের পর নয়াদিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ বিকেলে তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেন। দীর্ঘদিন পর স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন তিনি। আর এভাবেই নিরসন ঘটে বঙ্গবন্ধু ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে দীর্ঘ সাড়ে নয় মাস ধরে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মনে বিরাজমান যাবতীয় সংশয়, উদ্বেগ ও ব্যাকুলতার। চরম উৎকণ্ঠার পর দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে গোটা জাতির মাঝে ফিরে আসে পরম আনন্দ ও স্বস্তি।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক