বাংলা সমাজ ও লোকাচারে বহুল ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রবাদে কবে থেকে দশ সংখ্যাটা এত প্রাধান্য পেয়েছিল সেটা বলা মুশকিল। তবে এই সমস্ত কথার ভাবার্থ কিংবা ভাব সম্প্রসারণ থেকে বেরিয়ে আসে অনুপ্রেরণা ও নতুন ভাবনা। যেমন ধরুন; ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’, ‘দশ দিন চোরের একদিন গৃহস্থের’, ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’, ‘দশের লাঠি একের বোঝা’, ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’, ইত্যাদি। বাঙালিদের মধ্যে দশ সংখ্যাকে সর্বশেষ যিনি ভীষণভাবে স্পর্শ করেছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ ছিল তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ২৮৯ দিন বন্দি থাকার পর পাকিস্তান কারাগার থেকে বেরিয়ে এই দিনে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। সেই থেকে অতীতের সব প্রবাদের হাত ধরে বাংলাদেশের মানুষ পেয়ে যায় একটি কিংবদন্তী ১০এর দেখা।
কেমন ছিল সেদিনের সেই দিনটি, কী কী ঘটেছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি? তার আগে জেনে নেওয়া ভালো যে, কিছুদিন আগেও ঢাকা শহর ছিল সভা-সমাবেশ ও মিছিলের শহর। ১৯৬৯ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি দিনই ছিল ঘর ছেড়ে পথে নেমে আসার দিন। বাঙালিদের জীবনে ঘর এবং রাজপথ ওই দিনগুলোতে একই সুতোয় গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। ঢাকার পথগুলো তখন মানুষে মানুষে হয়ে উঠত উত্তাল ঢেউয়ের মেলা। সময়টা ছিল বাঙালিদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সন্ধিক্ষণ।
ঢাকা শহরের নানান সমাবেশ কেন্দ্র অনেক আগে থেকেই মানুষ একত্রিত হত। বিশেষ করে ঈদের মিছিল, মহররমের মিছিল ও জন্মাষ্টমীর মিছিল দেখতে মানুষের উৎসাহের কমতি ছিল না। কালের বিবর্তনে ঢাকার জনসমাবেশর স্বরূপ অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। ধর্মীয় সমাবেশের পরিবর্তে জাতীয় অহংকারের দিনগুলো কেন্দ্র করে ঢাকা শহরে বড় দুটি সমাবেশ হয়। এদের অন্যতম হল ২১শে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্র করে অমর একুশের প্রভাত ফেরি এবং পহেলা বৈশাখ কেন্দ্র করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই দুটি জনসমাগম এখন ঢাকা শহরের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে মানুষ ধর্মবর্ণগোত্রের বিভেদ ভুলে জাতীয় চেতনায় এক কাতারে অংশ নেয়।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী ২০১২ সালে গণজাগরণ মঞ্চ কেন্দ্র করে পথে নেমে আসার এক অভূতপূর্ব ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশসমূহে দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের এক কাতারে দাঁড় করানোর দীর্ঘস্থায়ী সমাবেশ ঘটিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। যার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের চরম শাস্তির দাবি। এছাড়া ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ পতনের আন্দোলনের সময়ও পথে নেমে এসেছিল ঢাকাবাসী। স্লোগানে স্লোগানে মুখর ছিল ঢাকার রাজপথ। বিশেষ করে ১০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকার রাজপথ ছিল সাধারণের দখলে।
জিয়াউর রহমানের জানাজার দৃশ্য এখনও অনেকে মনে রেখেছেন। ১৯৮১ সালের ৩০মে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতার পালাবদল না হওয়ায় রেডিও-টেলিভিশনে বিরামহীন প্রচার অনেক চাঞ্চল্যকর হয়ে ওঠে। বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে জিয়াউর রহমানকে যেখানে কবর দেওয়া হয়েছিল সেখান থেকে তাঁর লাশ উঠিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসার খবর ছড়িয়ে পড়লে জনসাধারণের মধ্যে কৌতূহল বেড়ে যায়। প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল ঢাকায় ২ জুন।
বয়সে যারা আরও প্রবীণ তারা হয়তো মনে করতে পারেন যে, ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর লেবাননের রাজধানী বৈরুত থেকে যখন তাঁর লাশ ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয় সেদিনকার সেই দৃশ্য। সেদিনও প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল বিমানবন্দর থেকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত।
তবে উল্লেখ করার মতো যে, দিনটি আজও সকলের মনে আছে এবং আগামীতেও ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে সেটা হল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১০ জানুয়ারি। অনেক খলরাজনীতি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাসের পাতা ও বাঙালির মন থেকে মুছে দিতে। কিন্তু আজ বাংলাদেশের নাগরিক মাত্রই জানে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘জয় বাংলা’র পরে যে শ্লোগানটি সকলের বুকে শক্তি জোগাত সেটা ছিল, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’।
সেই শেখ মুজিব বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলার মাটিতে ফিরে আসাতেই বিজয়ের আনন্দ শতভাগ পূর্ণ হয়। পাকিস্তানের পিআইএর একটি বিশেষ বিমান রাওয়ালপিন্ডি থেকে উড্ডয়নের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘পাখিটি উড়ে গেছে’।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের পর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাদের প্রেসিডেন্টের কাছে সংকেত পাঠিয়েছিল এ রকম যে, ‘বড় পাখিটাকে খাঁচায় বন্দি করা হয়েছে’। ভুট্টোর এই উক্তি ৮ জানুয়ারি প্রচার হতেই দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসতে শুরু করে ঢাকা শহরে। সেদিন ঢাকার রাজপথে যারা নেমে এসেছিল তারা কোনোদিন ভুলতে পারবে না এই স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। দিনটি ছিল সোমবার। রৌদ্রোজ্জ্বল এই দিনটি সদ্যস্বাধীন দেশের জন্য একটি বিশেষ দিন হওয়ায় সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল।
পাকিস্তানের কারাগার থকে মুক্তি দিয়ে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। প্রথমে ভুট্টো বলেছিলেন তেহরানে যাবার কথা কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজি না হওয়াতে পরে লন্ডনের নাম বলা হলে বঙ্গবন্ধু তাতে সম্মতি দেন। ৯ জানুয়ারি সকাল আটটা ত্রিশ মিনিটে তিনি হিথরো বিমানবন্দরে নামেন। বিমানবন্দরে ফরেন অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসে বলেন, “ব্রিটিশ সরকার আপনাকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছে, তাই আপনাকে ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে ক্লারিজেস হোটেলে (Claridge’s Hotel) নিয়ে যাওয়া হবে।”
এই হোটেলের বলরুমে বসেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রথম প্রেস কনফারেন্সে যোগ দেন। এখানে তিনি বলেন, “আমি আজ মুক্ত অবস্থায় আমার দেশবাসীর সাথে সীমাহীন স্বাধীনতার আনন্দ ভাগ করতে চাই।… মুক্তির মহাকাব্যিক সংগ্রামশেষে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
অবশ্যই এখানেই তিনি সর্বপ্রথম বিশ্বের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ এই অকস্মাৎ ভিজিটের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ছিলেন লন্ডনের বাইরে। পরবর্তীতে (১৯ জানুয়ারি) এক তারবার্তায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিকসনকে লিখেছিলেন, শেখ মুজিবকে বহনকারী বিমানটি অবতরণের এক ঘণ্টা আগে আমরা জানতে পারি যে, তাঁকে লন্ডনে নিয়ে আসা হচ্ছে। ব্যাপারটা এতই গোপনীয় ছিল।
তাতে কী, ইতোমধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা যিনি পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সেই হেরাল্ড উইলসন এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে দেখামাত্র তিনি বলেছিলেন, “গুড মর্নিং, মিস্টার প্রেসিডেন্ট।”
অথচ তখনও ইংল্যান্ড বাংলাদেশকে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বাস্তবতা হল, শুধু ভারত এবং ভুটান ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশকে তখনও স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসেনি। এদিকে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাদ দিয়েই প্রধানমন্ত্রী হিথ তাঁর নিবাস ও কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। তিনি তাঁর অফিসের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে বঙ্গবন্ধুকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেন। এমন কাণ্ড সচরাচর দেখা যায় না।
এভাবেই শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অন্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকারের আনুষ্ঠানিকতা। ব্রিটিশ সরকার ভালো করেই জানত যে, বিদেশের মাটিতে অবস্থানরত প্রবাসী সরকারের সিদ্ধান্তেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন। এ সত্যটুকু জানা সত্বেও পাকিস্তান, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বিরাজমান সম্পর্ক অটুট রেখেও বাংলাদেশের এই মহান নেতাকে তারা পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে দ্বিধা করেনি। এ থেকেই আন্দাজ করা যায় যে, বিশ্ব অপেক্ষা করছিল ভারত অঞ্চলে একজন নতুন নেতার জন্য।
ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গবন্ধু অনুরোধ করেছিলেন যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে যেন বাংলাদেশে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও তাঁকে বহন করার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ৭০৭ বিশেষ বিমান হিথরোতে অপেক্ষা করছিল, তবু তিনি ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর কমেট জেটে করে দেশের পথে রওনা দেন।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, দীর্ঘ ১৫ বছর স্বেচ্ছায় প্রবাসে বসবাসের পর রেজা শাহ পাহ্লভির পতন হলে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী দেশে ফিরে আসতে মনস্থ করেন। তাঁকে বহন করা এয়ার ফ্রান্সের বিশেষ বিমানটিতে খোমেনীর একাধিক সহকর্মী ছাড়াও ১২০ জন দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ছিল। খোমেনীর যাত্রা ঝুঁকিমুক্ত রাখার জন্য এত সাংবাদিক সঙ্গে করে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাঁকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, “দেশে ফিরে যাবার ব্যাপারে আপনার কী অনুভূতি?”
খোমেনি উত্তর দিয়েছিলেন, “কিছু না (nothing)।”
যাহোক, তবু লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয়েছিল ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ তেহরান শহরে।
ড. কামাল হোসেন (তিনিও পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়) এবং তাঁর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে দিল্লি বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালে সেখানেও বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও লাল গালিচা সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। তাঁর সম্মানে আয়োজন হয় গান স্যালুটের। এই প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে বিদেশি রাষ্ট্র সম্মান জানাল। একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান (ভি ভি গিরি) সরকারপ্রধান (ইন্দিরা গান্ধী) সেই দেশের মন্ত্রিপরিষদ, তিন বাহিনীর প্রধানদের দ্বারা স্যালুট গ্রহণ, শত শত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং ৩২ দেশের কূটনীতিকদের উপস্থিতি বাংলাদেশের পক্ষে দৃশ্যমান স্বীকৃতির প্রকাশ পেল দিল্লি বিমানবন্দরে। দিল্লি বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু বলেন, “কারও প্রতি কোনো ঘৃণা না রেখেই আমি ফিরে যাচ্ছি আমার দেশে।”
দিল্লি বিমানবন্দরের সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতার পর মোটর শোভাযাত্রা করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লি প্যারেড গ্রাউন্ডে একটি পাবলিক মিটিং এ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর যখন বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ ইংরেজিতে শুরু করেন তখন জনতার সারি থেকে জোর দাবি উঠে বাংলায় ভাষণ দেওয়ার। তিনি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর দিকে তাকালে তিনিও একই অনুরোধ করেন। খুশিতে প্রাণখোলা একটি হাসি দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দিতে শুরু করেন এই বলে, “আমার ভাই ও বোনেরা।”
সঙ্গে সঙ্গে উল্লাস ও করতালিতে সেই ভাষণ স্বাগত জানায় উপস্থিত জনসাধারণ। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের এটাই ছিল সর্বপ্রথম জনসমাবেশে ভাষণ। এই ভাষণে তিনি বলেন:
“আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য ও সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছে চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না… আমাকে প্রশ্ন করা হয় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির সাথে আপনার আদর্শের এত মিল কেন? আমি বলি এটা আদর্শের মিল, এটা নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল এটা বিশ্বশান্তির মিল।”
পাবলিক মিটিং শেষ করে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলো নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতের সৈন্য-প্রত্যাহারের বিষয়টি। তারপর সেখান থেকে আবারও বিমানবন্দর। ভারত সরকার একটা লম্বা বিরতি-যাত্রা প্রস্তুত করে রেখেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেগুলো সংক্ষিপ্ত করে আড়াই ঘণ্টা পরই দেশের উদ্দেশে রওনা দেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির পত্রিকাগুলোর শিরোনাম ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিটি পত্রিকার শিরোনাম, সম্পাদকীয়, সংবাদ ছিল কাব্যিক উপমায় ভরা। দেখে মনে হয়েছিল যেন একজন কবিকে বরণ করতে যাচ্ছে জাতি। বহুল প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকে শিরোনাম ছিল, ‘ওই মহামানব আসে দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে’। দৈনিক পূর্বদেশ লিখেছিল, ‘ভেঙেছে দুয়ার এসেছে জ্যোতির্ময়’। সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর প্রতীক্ষায় ঢাকা নগরী’। ডেইলি গার্ডিয়ান লিখেছিল, ‘Once Sheikh Mujibur Rahman steps out at Dacca Airport the new republic becomes a solid fact.’
বাংলাদেশ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করেছে তাঁর আগমন দৃশ্য। কোলকাতার আকাশবাণী ধারাবিবরণী দিয়েছে। বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসও বিশেষ বুলেটিন প্রচার করেছিল। বাংলাদেশ বেতার থেকেও ধারাবিবরণী দেওয়া হচ্ছিল। হেলিকপ্টারে উড়ে উড়ে ছবি তুলেছিল সাংবাদিকেরা। বাদ্যযন্ত্র আর ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখর ছিল আকাশ-বাতাস।
তেজগাঁও বিমানবন্দরে সিকিউরিটির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল বাংলাদেশে সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশসহ ভারতীয় সেনাবাহিনী। এরপরও লোকের ভিড় ঠেকানো তাদের জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। খুব সংক্ষিপ্ত গার্ড অব অনার পর্ব শেষ করে একটি খোলা ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছান। তাতে সময় লেগে যায় দুই ঘণ্টারও বেশি। লক্ষাধিক লোকের স্রোত বয়ে গেছে সেদিনের তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ঢাকার রাজপথে।
স্বাধীনতার বিজয় আনন্দ এই দিনেই পূর্ণতা লাভ করে। অতীতের সব জনসমাবেশ ১০ জানুয়ারির জনস্রোতের কাছে ম্লান হয়ে যায়। তখনও অনেকে নফল রোজা করে যাচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আশায়। তাদের সেই নফল রোজার সমাপ্তি ঘটে এই দিনে। এই দিন বাংলার মানুষ নতুন করে বাঁচতে শেখে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে অনেক কেঁদেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিমানের সিঁড়ি থেকে শুরু করে রেসকোর্স ময়দানে আর একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়ার মুহূর্তেও তিনি সাদা রুমাল দিয়ে ঘন ঘন চোখ মুছেছেন। পূর্বপ্রস্তুতিহীন এক ব্যক্তির পরপর দুটি অলিখিত ভাষণে রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদৃষ্টি এবং ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনায় ভরা, এমনটি পাওয়া খুবই বিরল। ৭ মার্চ ১৯৭০এর পর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ একই স্থানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেই দুটি ভাষণই আজ ঐতিহাসিক। সম্ভবত এই দুর্লভ সৌভাগ্য আর অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতার কপালে জুটেনি। শব্দচয়ন, দর্শন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মানবিক দিক, রাজনৈতিক লক্ষ্য সব দিক দিয়ে বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ব্যাক টু ব্যাক ভাষণ আমাদের সম্পদ।
আজ হতে শত বছর পর যদি কেউ বঙ্গবন্ধুকে জানতে ইচ্ছে পোষণ করে তবে তাঁর এই দুটি ভাষণই সেই ইচ্ছে পূরণে অনেকখানি কাজ করে দিবে। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠন ও টিকিয়ে রাখার যে চ্যালেঞ্জ জাতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনে (বঙ্গবন্ধুর ডাক নাম ছিল খোকা) বাঙালি জাতি নতুন করে প্রেরণা ও আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল এই দিনে।
সাদা রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘ভাই ও বোনেরা’– তারপর প্রায় ৪০ মিনিটের বক্তৃতার মাঝে মাঝে অনেকবার সেই সাদা রুমাল দিয়ে চোখ মুছেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন মুগ্ধ ভক্ত হয়েও বাঙালি জাতির সাহস ও ত্যাগের মহিমায় গর্বিত হয়ে তিনি তাঁর প্রিয় কবিকে এই দিনে আক্রমণ করে বসেন। কবির বাণী খণ্ডন করে তিনি বলেছিলেন, “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন সাত কোটি বাঙালিরে হে বঙ্গজননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি। কবিগুরুর কতা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ।”
অর্থাৎ যে বাঙালি এতদিন কবিগুরুর আশ্রয়ে সাধারণ মানুষ হয়ে বেঁচেছিল বঙ্গবন্ধু সেই বাঙালিকে কবিগুরুর কাছ থেকে তুলে এনে বীর বাঙালির মর্যাদা দিয়ে নিজ দলভুক্ত করে নিলেন (“আমার বাঙালি আজ মানুষ”)। এছাড়াও সেদিন তিনি শক্রকে বলেছিলেন, “তোমাদের প্রতি আমার আক্রোশ নেই।”
এরই সঙ্গে স্বদেশী মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং চিরদিন স্বাধীন থাকবে। বাংলাদেশকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সেদিনের সেই ভাষণের প্রতিটি কথার ভাব সম্প্রসারণ করে আমাদের ভাবনা জগতকে আরও ধারালো করতে হবে। আমাদের ভাবনা করতে হবে প্রসারিত। সেজন্য দরকার তাঁর ভাষণ সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা।
দশ মাস আগে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী হিসেবে বন্দি করে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দশ মাস পর সেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতি পদমর্যাদায় তিনি বাংলার মাটি স্পর্শ করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির মর্যাদায় তাঁকে গান স্যালুট দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতির শপথ না নিয়েও বিদেশি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছিলেন তিনি।
বিমানবন্দর থেকে জনতার নেতাকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হল জনতার কাতারে, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। যেখানে অপেক্ষায় ছিল দেশের জনসাধারণ। একটি পরিষ্কার ঘোষণা তিনি দেশের মানুষকে সেদিনে শুনিয়েছিলেন। আর সেটা হল, “আমি বাঙালি। আমি মানুষ। আমি মুসলমান। একবার মরে দুইবার মরে না…এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা। স্বাধীন বাংলা। বাঙালি আমার জাতি। বাঙলা আমার ভাষা। বাংলার মাটি আমার স্থান।”
এমন একজন নেতা আমাদের ছিল সে কথা কি আমরা সবাই জানি?
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম
আকতার হোসেনলেখক