বেইজিংয়ের হাড়কাঁপানো শীতে জবুথবু হয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম কমরেড মাও সে তুংয়ের সমাধির সামনে উৎসুক জনতার লম্বা লাইন। শীত উপেক্ষা করে নানা বয়সের হাজারো মানুষ লাইন ধরে ধীর পায়ে, পরম নিষ্ঠায় এগিয়ে চলেছেন প্রিয় নেতাকে শ্রদ্ধা জানানোর তাগিদে। শীত-গ্রীষ্ম সারা বছর এই একই দৃশ্য চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের কেন্দ্রস্থলে, তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে।
কমরেড মাও সে তুং আধুনিক চীনের স্বপ্নদ্রষ্টা। কৃষক-শ্রমিক-জনতার সফল বিপ্লবে তাঁর হাত ধরেই চীনে কমিউনিস্টরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়। সেই থেকে আজ অবধি চীনাদের অবিচল আস্থা কমিউনিস্ট পার্টির ওপর। মাঝে অবশ্য বদলে গেছে অনেক কিছুই। নব্বইয়ের দশকে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের গণজাগরণ এবং এরপর পরিবর্তিত বাস্তবতায় ‘সংষ্কার’ বাস্তবায়ন ও পরিণতিতে ‘খোলা দুয়ারের’ পরিবর্তিত সমাজতন্ত্রের চর্চায় চীনে শনৈ শনৈ উন্নতি– ঘটেছে এত কিছু।
কমরেড মাওয়েরর দল চীনে আজও ক্ষমতায় ঠিকই, তবে পরিবর্তনগুলো এতটাই প্রবল যে, কমরেড মাও আজকের চীনকে আর চিনবেন না। তারপরও একটা জায়গায় কোনো কিছুর এতটুকু পরিবর্তন হয়নি।
১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে কমরেড মাওয়ের মৃত্যুর পর তাঁর নশ্বর দেহ বেইজিংয়ের কেন্দ্রস্থলে সংরক্ষণ করা হয়। সেই থেকে কমরেড মাও চীনের জাতীয় ঐক্য আর গর্বের প্রতীক। জীবিত মাওয়ের চেয়ে আজকের চীনে তাঁর প্রভাব বেশি বৈ কম নয়।
গত বছরের মাঝামাঝি তাইপেতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল ‘হেপাটাইটিস বি’এর ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ উপস্থাপনের সুবাদে। আগের দুবারের মতো একটুখানি সময় পেতেই ছুটে গেছি তাইপের কেন্দ্রস্থলে জেনারেল সান ইয়াৎ সেনের স্মৃতিসৌধে। চিরবৈরী চীন আর তাইওয়ানের মধ্যে মিল কিন্তু অনেক বেশি। আর হবেই-বা না কেন? বাস্তবে তো তারা একই জাতি। কমিউনিস্ট বিপ্লব-উত্তর চীনে আদর্শিক দ্বন্দ্বের পরিণতিতে গৃহযুদ্ধ এবং তারই পরিণতিতে সান ইয়াৎ সেনের অনুসারীরা তাইওয়ানে পালিয়ে এসে দেশটির গোড়াপত্তন ঘটান। আজও চীনারা তাইওয়ানের উপর তাদের সার্বভৌমত্তের দাবি ছেড়ে দেয়নি। অন্যদিকে তাইওয়ানিজরাও যে কোনো মূল্যে স্বাধীন জাতির তকমা খোয়াতে নারাজ। এই দুই বৈরী প্রতিবেশির এতসব মিল-অমিলের মাঝেও সবচেয়ে বড় মিল বোধকরি একটাই– দুই জাতিরই জাতির পিতা সান ইয়াৎ সেন।
সান ইয়াৎ সেনের মৃত্যু হয় চীনে। সেখানেই তাঁর সমাধি। তাইপের কেন্দ্রস্থলে আছে তাঁর বিশাল এক স্মৃতিসৌধ। সেখানে সান ইয়াৎ সেন নেই। আছে তাঁর প্রমাণসাইজের একটি ভাস্কর্য– আছে তাইওয়ানের সশস্ত্র বাহিনীর চৌকষ দলের সশস্ত্র পাহারা। প্রতি ঘণ্টায় সেখানে আড়ম্বরপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয় ‘চেঞ্জিং অব গার্ডস’। আর বছরে ৩৬৫ দিন নানা বয়সের শ্রদ্ধাবনত তাইওয়ানিজের অবিরাম ঢল সেখানে লেগেই থাকে।
একই দৃশ্য দেখেছি ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটিতেও। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শাসন আর শোষণ থেকে ভিয়েতনামীদের মুক্তির নায়ক সে দেশের জাতির পিতা হো চি মিন। উত্তর আর দক্ষিণে বিভক্ত দুটি ভিয়েতনামকে এক করার নায়কও তিনি। দেশের রাজধানীর নাম তাই তাঁর নামে আর তাঁর সমাধিস্থলও এখানে। বেইজিং কিংবা তাইপের মতো এখানেও সারা বছর দেখা যায় শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের দীর্ঘ সারি।
কমরেড মাওয়ের মৃত্যুর পর তাঁর নশ্বর দেহ বেইজিংয়ের কেন্দ্রস্থলে সংরক্ষণ করা হয়। সেই থেকে কমরেড মাও চীনের জাতীয় ঐক্য আর গর্বের প্রতীক
আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল পাশা– আমরা যাঁকে চিনি ‘আতাতুর্ক’ নামে– আতাতুর্ক তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম নয়। টার্কিশ ভাষায় এর অর্থ, ‘তুরস্কের জাতির পিতা’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়া অটোমান তুরস্ককে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আলোচনার টেবিলে ভাগাভাগিতে ব্যস্ত যখন, তখনই মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে ঘটে তুরস্কের নবজাগরণ। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় আধুনিক, স্যেকুলার, প্রগতিশীল তুরস্ক। কবি নজরুলের ভাষায়: “…হো হো কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই।”
ইস্তাম্বুলের ডলমাবাচি প্রাসাদে লিভার সিরোসিসে ভুগে মৃত্যুর পর মোস্তফা কামাল পাশাকে সমাধিস্থ করা হয় রাজধানী আঙ্কারায়। ২০১২ সালে সুযোগ হয়েছিল আঙ্কারায় যাওয়ার। দেখেছি কামাল পাশার সমাধিসৌধের বিশালত্ব আর বিস্তৃতি। আর দেখেছি শত শত টার্কিশকে; জেনেছি, বছরের প্রতিটি দিন এমনিভাবে তুরস্কের মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তাদের প্রিয় আতাতুর্ককে।
এরদোগানের তুরস্ক আজ অনেকটাই পথভ্রষ্ট। মুসলিম ব্রাদারহুডের অনুসারী এরদোগানের সরকার আজকের তুরস্ককে আতাতুর্কের আমল থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু আতাতুর্কের মৃত্যুদিবসে এরদোগান বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য জন্মদিন পালন করেন না। আর তাই নিকট অতীতেই দেখেছি, এরদোগানবিরোধী অধিকতর মৌলবাদীদের সমর্থনপুষ্ট সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিতে যে জনতা সেনাবাহিনীর ট্যাংকের সামনে বুক পেতে বসফরাসের ওপর নির্মিত ব্রিজ দুটি স্তব্ধ করে দিয়েছিল, তাদের মধ্যে শুধু এরদোগানের সমর্থকরাই ছিল না, ছিল আতাতুর্কে আস্থাশীল উদারপন্থীরা, এমনকি কমিউনিস্টরাও।
আর এত দূরেই-বা যাই কেন? মহাত্মা গান্ধীকে বুলেটে উড়িয়ে দেওয়া নাথুরাম গডসে ছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সদস্য। সেই সংঘ পরিবারেরই ঔরসজাত বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে একবারও দেখি না মহাত্মার মহত্ব চ্যালেঞ্জ করতে। তিনি তো সচ্ছন্দেই মহাত্মাকে গদির পেছনে, মাথার উপরে রেখে দেশ শাসন করছেন। কংগ্রেস ঠেকানোয় তাঁর যত প্রয়াস, তার শিকিভাগও তো দেখি না মহাত্মার বিরুদ্ধে। দিল্লি গেছেন কিন্তু রাজঘাট দেখেননি এমন কেউ কি আছেন? নতুন দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে মহাত্মা গান্ধীর এই সমাধিসৌধে জনতার ঢল কি কখনও থামতে দেখেছেন?
সম্রাট আকবর শত বছর আগে বুঝেছিলেন কী অদ্ভুত এই জনপদের জনগণ। যেখানে নদীতে সকালে জোয়ার আর বিকালে ভাটা হয়, ঘুরে যায় নদীর প্রবাহের দিক, সেই জনপদে থিতু হতে চাননি তিনি। তাই সেনাপতি মান সিংকে নির্দেশ দিয়েছিলেন দ্রুত বাংলা ত্যাগ করতে। তারও হাজার বছর আগে মহামতি আলেকজান্ডার জেনে গিয়েছিলেন কী ‘বিচিত্র’ এই উপমহাদেশের লোকগুলো। আর তাঁর হাজার বছর পরে বাঙালি বিষয়ে কবিগুরু বলেন:
“সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।”
আর তাই মাও সে তুং, সান ইয়াৎ সেন, হো চি মিন, মোস্তফা কামাল পাশা আর মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধ নিজ নিজ জাতীয় রাজধানীতে হলেও আমাদের বঙ্গবন্ধু শুয়ে আছেন টুঙ্গিপাড়ায়। অথচ জাতির জনকের রক্তে যাদের হাত কলঙ্কিত, জাতির পতাকা যারা চায়নি, একাত্তরে এ দেশের জন্মের বিরুদ্ধে যারা ছিল সক্রিয়-সোচ্চার, তাদের অনেকেই শান্তিতে শায়িত আমাদের গণতন্ত্রের পাদপীঠ জাতীয় সংসদ ভবনের আশেপাশে!
গোপালগঞ্জের প্রত্যন্ত জনপদ থেকে উঠে আসা শেখ মুজিবুর রহমান আপন মহিমায় হয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির যেসব কুলাঙ্গার মনে করেছিল তারা ‘বঙ্গবন্ধু’কে শেষ করে দিয়েছে, ‘রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমান’কে যারা টুঙ্গিপাড়ায় ফেরত পাঠিয়ে সুখস্বপ্নে বিভোর ছিল, তারা অর্বাচীন; তাদের প্রজ্ঞার শূন্যতার জন্য শুধুই করুণা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আজ শুধু গোপালগঞ্জের ‘মুজিব ভাই’ নন, তিনি বাঙালি জাতির নয়নমনি– বাংলাদেশের জাতির পিতা। বাংলাদেশ শুধু একটি দেশ নয়, এটি পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী প্রতিটি মানুষের আরাধ্যভূমি। এই উপমহাদেশে কত জাতি, কত ভাষা, কিন্তু নিজের দেশ আছে কি সবার কাছে? আছে বাঙালির। আর বাঙালির এই দেশটির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু, এই দেশটির রূপকারও তিনি। বাংলাদেশের জাতির পিতার শেষ ঠিকানা তাই হওয়া প্রয়োজন রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে।
বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা গত আট বছরে এই জাতিকে অনেক গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছেন। বিচার হয়েছে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের, একাত্তরের ঘাতকদেরও। মুছে গেছে আমাদের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র বদনামও। আমরা এখন খাদ্যশস্য রপ্তানি করি, আমদানি নয়। নিজের টাকায় বানাই পদ্মা সেতু।
জাতির পিতার জন্মদিন সামনে রেখে জননেত্রীর কাছে প্রত্যাশা, জাতির পিতাকে রাজধানীতে ফিরিয়ে এনে বাঙালি জাতিকে আরেক গ্লানি থেকে মুক্তি দিন।
জাতির পিতা জাতির পিতার সমাধি টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধু
মামুন-আল-মাহতাবসহযোগী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়