ষাটের দশকে একুশ যেভাবে পালিত হত


বাঙালি যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন অমর হয়ে থাকবে একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশে এবং বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালি শ্রদ্ধাভরে উদযাপন করবে একুশে ফেব্রুয়ারি। কোটি কণ্ঠে গেয়ে উঠবে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর গাঁথা: “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।”

শুধু বাঙালিরাই নয়, ২০০০ সাল থেকে আমাদের অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। বাঙালি জাতির বুকের রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘের ইউনেসকো অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে প্রতি বছর জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো দিবসটি পালন করে আসছে।

মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। মাতৃদুগ্ধ পান করে শিশু যেমন বেড়ে ওঠে তেমনি মায়ের কোলে থাকতেই মায়ের ভাষায় কথা বলতে শেখে। কিন্তু এই জন্মগত অধিকার রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমাদের পূর্বসূরিদের প্রাণ দিতে হল কেন? সেই ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। তবু সংক্ষেপে তুলে ধরছি সেই করুণ ইতিহাস।

ব্রিটিশ উপনিবেশিকরা ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত উপমহাদেশ ছেড়ে আসার সময় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানের ধর্মের দোহাই দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটায়। ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও আচার-অনুষ্ঠানের কোনো প্রকার মিল না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মেও বন্ধনের ভিত্তিতে এক হাজার মাইল ব্যবধানের পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয়েছিল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র। কিন্তু ধর্মের নামে গঠিত পাকিস্তান যে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র ছিল তা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই।

তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা বাংলা হলেও শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল। কিন্তু আমাদের পূর্বসূরিরা বিশেষ করে, বাংলার ছাত্রসমাজ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ওই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। শুরু হল মায়ের ভাষা রক্ষার আন্দোলন। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর বুকের রক্ত দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র রুখে দিলেন; মায়ের ভাষার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন।

কিন্তু ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালেই থেমে থাকেনি। একুশের পথ ধরে উন্মেষ ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে একের পর এক আন্দোলনের পথ বেয়ে শুরু হয় বাঙালি জাতির স্বাধীকার আন্দোলন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে একুশের মাতৃভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। বাঙালি জাতি বিশ্বপরিসরে বীরের জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

bangabandhu111
একবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের কঠোর পরিশ্রমের প্রশংসা করে মিষ্টি খাওয়ার জন্য ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন
 

সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরের আত্মত্যাগে মহীয়ান অমর একুশের চেতনাই ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীকার আন্দোলনের অনুপ্রেরণার উৎস। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি সমগ্র জাতি নতুন করে শপথ নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ত। পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে অমর একুশে।

আজিমপুর কবরস্থানের পাশে নতুন পল্টন লাইনের বসবাসের সুবাদে কিশোর বয়স থেকেই ষাটের দশকে পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব শাহীর আমলে একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটেছিল আমার। ছোটবেলা থেকেই প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের সঙ্গে আমার ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। ওই সময় ‘নতুন পল্টন লাইন যুব সংসদ’ নামে আমাদের পাড়ার একটি শক্তিশালী সংগঠন ছিল। যুব সংসদের দায়িত্ব ছিল ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে আজিমপুর কবরস্থানের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে যেখানে শহীদদের কবরগুলো রয়েছে, সেই এলাকার আগাছাগুলো পরিষ্কার করে কবরের কাছে যাওয়ার মাটির পথ তৈরি করে শহীদদের কবরগুলো কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে ফুল দিয়ে সাজানো।

১৯৬২ সাল থেকেই তৎকালীন ‘ডাকসু’র (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে যুব সংসদকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কবরগুলো সাজানোর জন্য প্রতিবছর ডাকসু থেকে যুব সংসদকে ২৫ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হত। ওই ২৫ টাকা ব্যয় করেই আমরা যুব সংসদের স্বেচ্ছাসেবকরা মাজারের খাদেমের মতো এই বিশেষ দিনে কবরগুলো সাজানোর দায়িত্ব পালন করতাম। ওই সময় কবরস্থানের রাস্তা ছিল না। এখনকার মতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও ছিল না, ঝোপ-ঝাড়ে ভরে থাকত পুরো কবরস্থান। তাই প্রভাতফেরি করে যারা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসতেন তাদের সুবিধার্থে কবরগুলোর পাশ দিয়ে রাস্তা বানাতে হত।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কবরস্থানের পশ্চিম দিকে কাছাকাছি এলাকায় তিনটি কবরে তিনজন শহীদ শায়িত রয়েছেন। কবরস্থানের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ছিল আরও একটি কবর। তবে কালের বিবর্তণে ওই কবরটি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। প্রভাতফেরিতে আগতদের তিন শহীদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের সুযোগ দেওয়ার জন্য আমরা কবরগুলোর পাশ দিয়ে রাস্তা করে দুপাশে বাঁশের খুঁটি পুতে রশি টেনে দিতাম। ২৫ টাকা দিয়েই আমাদের কবরগুলো সাজানোর জন্য কালো থান কাপড় কেনা আর রাস্তার দুপাশে খুঁটিগুলোর মধ্যে বাঁধার জন্য সুতলি (পাটের সরু দড়ি) কেনা হয়ে যেত। বাঁশ বা খুঁটি আমাদের কিনতে হত না। কবর দেওয়ার জন্য কবরস্থান সংলগ্ন বাঁশ সরবরাহকারী ঠিকাদারের মজুদ থেকে আমরা খুঁটিগুলো নিয়ে আসতাম।

সন্ধ্যার আগেই আমরা স্বেচ্ছাসেবকরা কোদাল চালিয়ে মাটির রাস্তা বানিয়ে বাঁশের খুঁটিগুলো পুতে সুতলি বেঁধে দিতাম। সন্ধ্যার পর দল বেঁধে ফুল যোগাড় বা অন্য কথায় ‘ফুল চুরি’র কাজ শেষ করে গভীর রাতে কবরগুলো কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে ফুল দিয়ে সাজাতাম। তার কারণ এই সাজ-সজ্জার কাজ করতে গিয়ে আইয়ুব-মোনেমের ‘আইবি’দের (গোয়েন্দা) সঙ্গে আমাদের লুকোচুরি খেলতে হত। আমরা সন্ধ্যার আগে বাঁশগুলো পুঁতে রশি টেনে দিয়ে চলে আসলে রাতে গিয়ে দেখতাম যে ‘আইবি’র লোকজন বাঁশগুলো তুলে ফেলেছে। আমরা গভীর রাতে আবার ওগুলো ঠিকঠাক করে কবরগুলো কালো থান কাপড়ে আবৃত করে পালা করে সারা রাত পাহারা দিতাম।

এখন ঢাকায় ফুলের দোকানের ছড়াছড়ি থাকলেও তখন ঢাকার কোথায়ও কোন ফুলের দোকান ছিল না। ফুল বিক্রিরও কোনো প্রচলন ছিল না। আমাদের ফুলের প্রধান উৎস ছিল নিউ মার্কেটের পার্ক। নিউ মার্কেটের ঠিক মাঝখানে ছিল একটি সুন্দর পার্ক। আর ফাল্গুন মাসে রং-বেরঙের ফুলে ভরে থাকত ওই পার্ক। এখন ওই পার্কের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওই পার্কে তেরি করা হয়েছে একটি মসজিদ আর সারি সারি দোকান।

ফুলের আরও উৎস ছিল নিউ মার্কেটের পার্শ্ববর্তী পার্টি হাউস বা সদস্য ভবন (পাকিস্তান আমলের এমপি হোস্টেল) এবং রমনা পার্ক। ঢাকা কলেজেও ছিল সুন্দর বাগান। তবে শহীদদের কবরগুলো সাজাতে ফুলের কোনো ঘাটতি হত না। মনে হত, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যই ফেব্রুয়ারি মাসে বাগানগুলো ফুলে ফুলে ভরে উঠত। আর শহীদদের কবর সাজানোর জন্য ফুল আনতাম বলে কোনো বাগানের মালি বা কর্তৃপক্ষ আপত্তি করত না, বরং উল্টো সহযোগিতা করত। গভীর রাতে কবরগুলো ফুল দিয়ে সাজিয়ে আমরা অপেক্ষা করতে থাকতাম প্রভাতফেরির জন্য।

স্বাধীনতার পূর্ববর্তীকালে প্রভাতফেরি প্রভাতেই হত। ভোরের আকাশে সূর্যের লাল আভা ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দূর থেকে ভেসে আসত প্রভাতফেরির অবিনশ্বর গান: “আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।”

Jibon theke Neya - 111
যেসব স্মৃতি এখনও মনে ভাস্বর তা হল, একুশে ফেব্রুয়ারির দিন আজিমপুর কবরস্থানে জহির রায়হানের অমর সৃষ্টি ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির লাইভ সুটিং
 

ভেসে আসত নানা শ্লোগান। ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে থেকে ছাত্র-ছাত্রীসহ সব বয়সের লোকজন বুকে ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’ শ্লোগান-সংবলিত কালো ব্যাজ লাগিয়ে নগ্ন পায়ে মিছিল করে একুশের গান গেয়ে এক এক করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। তবে দল বেঁধে আসত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের আবাসিক হলগুলোর ছাত্র-ছাত্রীরা।

উল্লেখ্য, একুশে ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কেউ আজিমপুর, নিউমার্কেট ও শহীদমিনার এলাকায় জুতো পায়ে হাটত না। মনের অজান্তেই আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এভাবে শহীদদের প্রতি জানাতেন শ্রদ্ধা। তখন রাতের বেলায় কোনো অনুষ্ঠান হত না। স্বাধীনতার পর থেকে রাত ১২টা এক মিনিটে প্রভাতফেরির রেওয়াজ চালু হয়।

সন্ধ্যা থেকে শুরু করে রাতভর স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের কখনও ক্লান্তি আসত না। ভোরের আলো ফুটে ওঠার পর থেকে প্রভাতফেরির ঢল নেমে আসলে আমাদের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যেত। মাটির রাস্তার বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে আমরা মিছিলকারীদের গাইড হিসেবে কাজ করতাম। যারা শহীদদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতাম তারা অভ্যাগতদের কবরগুলো সনাক্ত করে দিতাম। যেমন বলে দিতাম, এটা শহীদ বরকতের কবর, এটা শহীদ শফিউরের কবর।

প্রভাতফেরি শুরু হওয়ার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই শহীদদের কবরগুলো ফুলে ফুলে ভরে উঠত। কারণ প্রভাতফেরিতে যারা আসতেন তাদের অনেকেই নিজ বাগানে ফোটা ডালিয়া বা গাঁদা ফুল নিয়ে আসতেন। আর যাদের বাগান নেই, তারা লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল নিয়ে আসতেন। এখনকার ঢাকা গাছশূন্য হয়ে প্রায় ফাঁকা হয়ে গেলেও তখন কিন্তু ঢাকা শহরে গাছগাছালির কোনো কমতি ছিল না। ঢাকাজুড়ে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছগুলোতে যেন ফাগুনের আগুন ঝড়ত। সারা ঢাকা রঙিন সাজে সজ্জিত হত।

নতুন পল্টন লাইন যুব সংসদের পক্ষ থেকে বছরের পর বছর মহান একুশে ফেব্রুয়ারির এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেসব স্মৃতি এখনও মনে ভাস্বর তা হল, একুশে ফেব্রুয়ারির দিন আজিমপুর কবরস্থানে জহির রায়হানের অমর সৃষ্টি ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির লাইভ সুটিং। শহীদদের কবরগুলোতে আনোয়ার হোসেন, নায়করাজ রাজ্জাক, ববিতা ও সুচন্দাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। এই জীবন থেকে নেওয়া ছবিই সারা বাংলাদেশের মানুষকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছিল। স্বাধীকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উজ্জীবিত করেছিল।

আরও মনে পড়ে একবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের কঠোর পরিশ্রমের প্রশংসা করে মিষ্টি খাওয়ার জন্য ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। মনে পড়ে, ভীড় এড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধু দক্ষিণ দিকের গেটের পরিবর্তে নতুন পল্টন লাইন হাই স্কুলের কাছের পশ্চিম দিকের গেট দিয়ে বের হয়েছিলেন।

মিছিলগুলো কবরস্থানের উত্তর গেট দিয়ে প্রবেশ করে আমাদের তৈরি মাটির পথ দিয়ে শহীদদের কবরগুলোতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে কবরস্থানের দক্ষিণ দিকের গেট দিয়ে বের হত। সবাই দক্ষিণ গেটের বাইরে গিয়ে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করতে থাকত। একটা পর্যায়ে শুরু হত সর্বদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর মিছিল। এই মিছিল একুশের ভিন্ন রূপ ধারণ করত। মিছিলের ভাষা ছিল প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের। ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘আইয়ুব শাহী নিপাত যাক’, ‘স্বৈরাচার ধ্বংস হোক’ প্রভৃতি শ্লোগানে গর্জে উঠত ছাত্রসমাজ, সঙ্গে যোগ দিত আপামর জনসাধারণ। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে দীপ্ত শপথে বলিয়ান ছাত্রসমাজ ঢাকার আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলত।

প্রকৃতপক্ষে প্রতিবছর একুশের দিনে নতুনভাবে শপথ নিয়ে ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেছে। আন্দোলনের প্রেরণা যুগিয়েছে একুশ। একুশ মানেই সংগ্রাম, একুশ মানেই অনাচার, অত্যাচার, কূপমণ্ডুকতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন।

একুশের চেতনা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল বহির্বিশ্বেও। সমগ্র বাঙালি জাতি যখন একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঊনসত্তরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালিরাও পিছিয়ে ছিল না। দেশমাতৃকার স্বাধীকার আন্দোলনে প্রবাসী বাঙালিরাও এগিয়ে আসে। আর সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ঊনসত্তরের ২১ শে ফেব্রুয়ারি লন্ডনে আত্মপ্রকাশ করে বাঙালির মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক জনমত’ ।

একুশের অমর শহীদদের মহান আত্মত্যাগ বিশ্বদরবারে বাঙালি এবং বাংলাদেশের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। একুশ আজ বিশ্বজনীন রূপ নিয়েছে।

একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন মহান শহীদ দিবস

আবু মুসা হাসানসাবেক কূটনীতিক ও সাংবাদিক

SUMMARY

1381-1.jpg