শেখ মুজিব: ইতিহাসের রাখাল রাজা


১৯৯৫ সালে কানাডার দুজন সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ কানাডা থেকে ক্যুবেক প্রদেশের সম্ভাব্য বিচ্ছেদের আইনগত দিক বিশ্লেষণ করতে যেয়ে লিখছিলেন, “১৯৪৫ সালের পর বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে সফলভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে নিজেকে বিছিন্ন করার কৃতিত্ব অর্জন করে। এ সশস্ত্র সংগ্রামের প্রধান শক্তি ছিল ঐ জাতির সহজাত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে এক অতুলনীয় বিজয় ছিনিয়ে আনে। তিনি যে আস্বাদিত জনসমর্থন পেয়েছিলেন সেটা একটি পশ্চিমা গণতন্ত্রে অভাবনীয়”।

অনুরূপ মতামত যেমন, “শেখ মুজিব এর একমাত্র অপরাধ একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন”- আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে,  যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে যেটা নিরন্তর প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো। 

নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার লেখক পেগি ডারদিন যিনি ১৯৭১ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন তিনি ২ মে ১৯৭১ সালে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে তাড়িত রাজনৈতিক জোয়ার’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। যেটাতে তিনি লেখেন, “সমস্ত মার্চে শেখ মুজিব এবং তার সহকর্মীরা আঁকাবাঁকা গেম খেলেন এবং তাদের লক্ষ্য ও কৌশল স্পষ্ট করতে অস্বীকার করেন। অবশ্য তাদের এটা করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। স্বাধীনতার জন্য একটি খোলা স্ট্যান্ড হতো সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা যেতো। … শেখ মুজিব পূর্ব ও পশ্চিমের এক জাতীয় নেতা হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি, যদিও একটি সর্বপাকিস্তান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ পাওয়ার মতন সংখ্যাগরিষ্ঠতা  জাতীয় পরিষদে তাঁর ছিল।” 

জেনারেল রাও ফরমান আলী অবশ্য বলেন ভিন্ন কথা। “সবশেষে তারা (বাঙালিরা) পাকিস্তান শাসন করার সম্ভাবনা দেখেছিলো। মুজিব (পাকিস্তানের) প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর তাঁর উপদেষ্টারা তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে সামরিক এবং পিপিপির সম্মিলিত বাহিনীর শক্তি তাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা সত্যে পরিণত হতে দেবে না। অতএব, তিনি একটি নতুন জাতির ‘জনক’ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।”

জেমস জে নোভাক (১৯৭০ সাল থেকে যিনি ২০ বছর ধরে বাংলাদেশে বসবাস করেছিলনে) তার সুন্দর বই: ‘Bangladesh: Reflections on the water’  নামের বইতে  রাজনীতিবিদ এবং আমাদের স্বাধীনতার নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের এক উজ্জ্বল চিত্রাঙ্কন এবং তাঁকে উপস্থাপন করেছেন। নোভাক এর ভাষায়, “শেখ মুজিব রাজনৈতিক পরিবেশে এক ধরনের তাৎক্ষণিকতা নিয়ে আসেন। সূক্ষ্ম কূটচাল অথবা খাপছাড়া পদক্ষেপ নিয়ে তিনি জনগণকে ক্লান্ত করতেন না।  সরকারী পদের প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিলনা। যদিও কখনো প্রকাশ্যে বলেননি বা লেখেননি তথাপি তাঁর উত্থানের সময় থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর দিনে তাকে গ্রেপ্তার করা পর্যন্ত সবাই জানতো এবং বুঝতো তিনি স্বাধীনতার পক্ষেই কথা বলছেন। তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে কোন ঘোষণা না দিয়ে তিনি পাকিস্তানিদের ভীত সন্ত্রস্ত করে রেখেছেন। এবং পুরোটা সময় মুজিব চোখ পিটপিটিয়েছেন এবং মিটমিটিয়ে হেসেছেন এবং বাংলা ও বাংলাদেশের কথা বলে গেছেন, যেন চাইলেই ছাদের উপর লাল সবুজের পতাকার পতপত করে উড়ার দৃশ্য উপভোগ করা যেতো”। 

যাইহোক, তাঁর ছয় দফা থেকে এক দফায় রূপান্তর একটি দিন বা একটি মাসে ঘটে নি। নোভাক এর কথায়, “মুক্তিযুদ্ধের বহু আগেই, মুজিব পূর্ববাংলাবাসীদের মনে সাফল্যের সাথে এই বোধ সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন যে তারা পাকিস্তানি আগ্রাসন ও অবিচারের শিকার। এর ফলে আন্দোলনরত বাঙালিরা সব সময় এক ধরনের নৈতিক স্বস্তিতে থেকেছে যে, তারা নির্দোষ এবং যা করছে তা ন্যায্য। তাঁর বিশ্বাস যাই হোক না কেন, তাঁর ব্যক্তিত্বই তাঁকে তার যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিনত করেছিল। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন ধূমকেতুর মত। বস্তুত তিনি ছিলেন এক সজ্ঞাত শক্তি, যার  ব্যক্তিত্ব এবং কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ মানসের গভীরতম প্রদেশকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ছিলেন এক নৌকা যাতে চেপে জনগনের আকাঙক্ষা বয়ে যেতে পারতো।”   

বহুদিন আগে সক্রেটিস যেমনটা বুঝেছিলেন তেমনি রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবও বুঝেছিলেন যুক্তি এবং আবেগের সংমিশ্রণের। নোভাক এর কথায়, “মুজিব সামরিক এবং মার্শাল পাকিস্তানি পাঞ্জাবিদের তুলনায় বাংলা সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের বোধকে সব সময় উস্কে দিয়েছেন। এটা করতে যেয়ে তিনি বাঙালি কবিদের কবিতা দিয়ে পাকিস্তানের মহান কবি ইকবালের কবিতাকে প্রতিস্থাপিত করেছেন। জনগণকে উদ্দীপ্ত করার জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন কাজী নজরুলের উদ্দিপনাময় গান এবং কবিতা। অকৃত্রিম বাঙালি মনের সূক্ষ্ম এবং শৈল্পিক গুণাবলী এবং সেই মনের নৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে কবিতার ভূমিকা কী তা মুজিব বুঝেছিলেন। এটা বিশ্বাস করা হয়, ‘বাংলাদেশ কখনোই কিছু বিশ্বাস করে না যতক্ষণ না একজন কবির দ্বারা তা উচ্চারিত হয়।’

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ইকবালের সমকক্ষ বাঙালি কবি। তার চেয়ে বড় যেটা, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলার সন্তান, ফলে ইকবালের চাইতে অনেক বেশি প্রিয়। মুজিবের এই কবিতা কৌশল এত ফলপ্রসু হয়েছিল যে, এক পর্যায়ে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথের গান ও সাহিত্য, গাওয়া এবং পাঠ করাকে দেশদ্রোহিতা আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বলার অপেক্ষা রাখেনা, এটাই মুজিব চেয়েছিলেন। অন্যদিকে উদ্দিপনাময় গান ও কবিতার কারণে বিদ্রোহের পূর্বক্ষণে নজরুল হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী বাহিনীর কাব্যিক কণ্ঠস্বর ।”   

তাঁর কঠোর পরিশ্রম, সরলতা এবং সত্যবাদিতার কথা উল্লেখ করতে যেয়ে নোভাক লিখেছেন, “পশ্চিমা ধ্যান ধারণায় অভ্যস্ত মুসলিম লীগাররা ঢাকা অথবা চট্টগ্রামের চেয়ে লন্ডনে থাকতে এবং দেশি নৌকার তুলনায় অ্যারোপ্লেনে ভ্রমণ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। একইভাবে তারা ভোট প্রার্থনা বা ভোট অর্জনের চাইতে ভোট কিনতেন। অন্যদিকে শেখের রীতি ছিল কঠোর পরিশ্রম। অক্লান্তভাবে তিনি জেলায় জেলায়, মহকুমা মহকুমায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মাঠের পর মাঠ হেঁটে মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, মানুষদের সংগঠিত করেছেন।

তাদের চা, ভাত, ডাল, লবণ ভাগ করে খেয়েছেন; নাম মনে রেখেছেন, তাদের সঙ্গে মসজিদে নামাজ আদায় করেছেন, ফসলের মাঠে প্রখর রোদে ঘর্মাক্ত হয়েছেন, কেউ মারা গেলে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে কেঁদেছেন এবং কুলখানিতে উপস্থিত থেকেছেন। শেখ মুজিব অন্যের আবেগ অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হতেন আন্তরিকতার সঙ্গে, আচরণ করতেন সহানুভূতির সঙ্গে এবং হাত বাড়িয়ে যা স্পর্শ করতেন তা গলফ ক্লাব বা ক্লাবের চেয়ার নয়, জনগণের ঘর্মাক্ত ধূলিমলিন হাত।

জনগণ কী বিশ্বাস করে, কী চায় তা তিনি জানতেন এবং তাদের বোধগম্য ভাষায় সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারতেন। জনগণও এটা জানতো বলে তারা বিশ্বাস করতো তাঁর মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই।”   

গণহত্যা, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং অনুচ্চারিত দুঃখভোগের নয় মাসে, শেখ মুজিবের নাম লক্ষ লক্ষ মানুষের অন্তরে রাতদিন প্রজ্বলিত হয়েছিল এবং তিনি  হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের জনগণের এক উপদেবতা। জেনারেল রাও ফরমান আলীর ভাষায়, “বাংলাদেশের জনগণের ৯০ শতাংশ শেখ মুজিবের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা দ্বারা বিমোহিত হয়েছিলো এবং তারা বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য তাদের জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল।” 

বিবিসির বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের পৃথিবীব্যাপী জরিপে তিনি যখন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হন তখন বিবিসি শ্রোতাদের মতামতের সংক্ষিপ্ত সার ছিল নিম্নরূপ: “তিনি ছিলেন বাঙালি জনগণের অন্ধকার আচ্ছন্ন যুগের আলোর বাতি ঘর। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বাঙালিদের স্বার্থের জন্য আপসহীনতা শুধু বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে নয়, সারা বিশ্বের বাঙালিদেরকে প্রথমবারের মতন ঐক্যবদ্ধ করে এবং তিনিই তাদের জাতীয়তা দিয়েছেন। সারা পৃথিবীর বাঙালি, যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লালন করেন, তারা এক ব্যক্তির নেতৃত্বের কাছে এই জাতীয়তার জন্য ঋণী এবং তিনি শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কেউ নন।” 

অ্যারিস্টটল লিখেছেন, বিয়োগান্তের নায়ক হওয়ার কারণ তার “ত্রুটিময় বিবেচনা” বা তার নেতৃত্বের “দুঃখজনক ত্রুটির” কারণে। তার দৈবদুর্বিপাক, যতটুকু তার ভাগ্যে প্রাপ্য তার চেয়ে অনেক বেশি।

মুজিব প্রকৃতপক্ষে এক বিয়োগান্তক নায়ক। 

তুরস্কের জাতীয় বীর কামাল আতাতুর্ক একটি তুর্কি প্রবচন প্রায়ই উদ্ধৃত করতে অনুরাগী ছিলেন: “ইতিহাসে নির্মমতা ছাড়া যিনি তাকেই নির্মমতার শিকার হতে হয়”।

বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব এস এ করিম তার “Sheikh Muijib: Triumph and Tragedy” গ্রন্থের এপিটাফে উপসংহার টেনেছেন এভাবে, “মুজিব তার নিজের আগে তার দেশের মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি যদি ব্যর্থ হয়ে থাকেন তবে তার কারণ তিনি একটি রাষ্ট্রের এক কঠিন সময়ে  নির্মমতার সাথে শাসন করতে পারেনি। কিন্তু শাসক হিসাবে তাঁর ব্যর্থতা তাঁর মানবিক সত্তার  জাঁকজমককে কোনদিনও হ্রাস করবে না।  তিনি তার দেশের মানুষের অন্তরে অনাদিকাল ধরে বেঁচে থাকবেন।”  

নোভাক এর বই থেকে একটি উদ্ধৃতাংশ দিয়ে এ নিবন্ধের ইতি টানছি। নোভাক এর কথায়, “তিনি ছিলেন সহজ-সরল একজন মানুষ, নিজের জাতির ও জনগণের জন্যে যাঁর ছিল কিছু সহজ সরল বিশ্বাস। কিন্তু তিনি তাদের জন্য যা করতে চেয়েছিলেন তা করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। দেশের মানুষ তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি; তারা তার ভিতর থেকে সব সময় ভালোটাই বের করে এনেছেন। তবুও তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা – না একজন নিখুঁত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নয়, তাঁর জনগণের জন্য তাঁর নিখাদ ভালবাসার জন্যে। একজন মানুষ যতদূরে উঠতে পারে তিনি ততদুরই উঠেছিলেন। আমাদের ক’জন এর চেয়ে ভালো করতে পারতো?”  

SHEIKH MUIJIB: TRIUMPH AND TRAGEDY জেমস জে নোভাক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী

মোজাম্মেল খানঅধ্যাপক এবং সিনেটের স্পিকার, শেরিডান ইনস্টিটিউট অব টেকনলোজি, টরন্টো, কানাডা

SUMMARY

1375-B3.jpg