এক অসাধারণ মানুষের সাধারণ কয়েকটি গল্প


১.
১৯৭৫ সালের সাতৈ মে। ৮ দিন আগে পিতা শেখ লুতফর রহমানকে হারিয়েছেন। শোকে মুহ্যমান সে সময়, তবুও নেতা কর্মীদের সকলকে নিয়ে জাহাজে করে রওনা দিলেন টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে, পিতার চেহলাম এর জন্য। রাতের খাবার সেরে সিনিয়র নেতারা যে যে যার কেবিনে চলে গেলেন। কেউ কেউ ডেক এই বিছানা পেতে শুয়ে পড়লেন। জাহাজের ঢুলুনিতে মধ্যরাতে মাহবুব তালুকদার এর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে তিনি অবাক হয়ে যান। তিনি দেখেন তার মাথার নিচে একটি বালিশ। অথচ, সবাই যখন কেবিনে কিংবা ডেকে যার যার মতো শুয়ে পরেছিলেন, তিনি খেয়াল করেছিলেন তার জন্য ঘুমানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। তিনি মাথার নিচে হাত দিয়ে একটা সোফায় টান হয়ে শুয়ে পরেছিলেন যতোদূর মনে পরে। পাশেই এডিসি রব্বানী জেগে ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এডিসি সাহেব, মাথার নিচে বালিশ আসলো কোথা থেকে?’

এডিসি রব্বানী জানালেন, রাতের সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু দেখতে এসেছিলেন, সবার ঠিক মতো শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে কি না। আপনার কাছে এসে দেখলেন, মাথার নিচে হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। বললেন, ‘মাহবুব এইভাবে শুইয়া আছে। একটা বালিশ ওরে যোগাড় কইরা দিতে পারলা না?’ এরপর উনি নিজের কেবিনে গিয়ে নিজেরই একটা বালিশ এনে আপনার মাথার নিচে দিয়ে দেন। মাহবুব সাহেব একইসাথে বিপন্ন ও বিস্মিত হলেন, কারণ তিনি জানতেন যে বঙ্গবন্ধু মাথার নিচে দুইটি বালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারতেন না। তিনি একবার ভাবলেন, বালিশটি ফেরত দিয়ে আসবেন কি না। আবার ভাবলেন, এতোক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন, এখন ডাক দেয়া সমীচীন হবে না।

ভোরবেলা, সূর্য ওঠার আগেই মাহবুব সাহেব দেখলেন, জাহাজের ডেকে একটি চেয়ারে হেলান দিয়ে পা দুলিয়ে দুলিয়ে আবৃত্তি করছেন, ‘নম নম নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি’। মাহবুব সাহেবকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রাত্রে ভালো ঘুম হইছে তো?’ মাহবুব সাহেব বললেন, ‘জ্বি না। ভালো ঘুমাতে পারি নি।‘

– ক্যান? আমি তো তোমার মাথার তলে বালিশ দিয়া গ্যালাম। ঘুম হয় নাই ক্যান?

–  ওই জন্যই তো ঘুম হয় নি। আপনি নিজের মাথার তলের বালিশ আমার আমার মাথায় দিয়ে গেলে ঘুম হওয়া কি সম্ভব? (১)

২.

আজ বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মদিন। বেঁচে থাকলে হয়তো বুড়িয়ে যেতেন অনেকটাই। অথচ, ৯৯ বছর বয়সেও আমাদের মানসপটে বঙ্গবন্ধু আটকে আছেন ৫৫বছর বয়সেই! এখনও কাঁচাপাকা চুল, গোফ। লম্বা দেহ, আর কী মধুর হাসি। উপরের গল্পটা বলার কারণ বিশেষ কিছু না। বঙ্গবন্ধু যে একজন অসম্ভব রকমের মানবিক মানুষ ছিলেন, সে তো আমরা জানিই! সারা দেশ যখন উত্তপ্ত, আনাচে কানাচে পুড়ছে টায়ার, মিছিলের আওয়াজ আর বারুদের গন্ধে বাতাস যখন ভারী, সেই সময় তেসরা মার্চে, সাতৈ মার্চেও বারবার তিনি বলেছেন, রিকশাওয়ালাদের কে যাতে ভাড়া একটু বাড়িয়ে দেয় সবাই, শ্রমিকদের বেতন যেন আটকে না থাকে। বার বার বলেছেন। নেতা বঙ্গবন্ধুর মাঝে পিতা সত্ত্বাটি সবসময়ই মিলেমিশে ছিল। আমাদের বাবা মায়েরা যেমন আমরা কোনও ভালো কাজ করলে, ‘আমার ছেলে, আমার মেয়ে’ বলে গর্ববোধ করতে পছন্দ করেন, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে খেয়াল করলে দেখবেন, সব সময় বলতেন, ‘আমার মানুষ, আমার দেশের মানুষ, আমার শ্রমিক, আমার কৃষক’। বাংলার মানুষ তথা, তার সন্তানদের জন্য তিনি কেমন পাগল ছিলেন, বলি। ১৯৬৫ সালের কথা। নভেম্বরের ৪ তারিখ। বঙ্গবন্ধু তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। ইত্তেফাক অফিসে মানিক মিয়া ‘রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের’ ডিকটেশন দেওয়া শেষে তার ইজিচেয়ারে শুয়ে গল্প করছিলেন। এমন সময় শেখ মুজিব ঝড়ের বেগে প্রবেশ করেন অফিসে। এসেই বলতে থাকেন, ‘মানিক ভাই, আল্লার দোহাই, আমাকে বিদেশে যাওয়ার একটা ভিসা জোগাড় করে দেন। বাংলার মানুষের উপর এই অত্যাচার ও বঞ্চনা আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি জাতিসংঘে অভিযোগ জানাবো।‘(২)

আমরা যে ৭ মার্চের ঘোষণা শুনি, আর কারও কারও কথায় আমাদের নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয় এই ভেবে যে, বঙ্গবন্ধু বুঝি এক সাতৈ মার্চের ভাষণ দিয়েই মহান নেতা বনে গেছেন, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তা না। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোচড়, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবনের কোনও ম্যাজিক না, এমন না যে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে হঠাৎ করে হিরো বানিয়ে দিয়েছে। সেই ৪৭ এরও আগে থেকে লড়তে লড়তে, লড়াকু মুজিব এর তর্জনি এইদিন পূর্ণতা পেয়েছে, জাদুর কাঠি হয়ে পুরো জাতিকে স্বাধীনতার মোহে মোহগ্রস্ত করেছে। আর তাই, বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে সেই টুঙ্গিপাড়ার খোকাকে জানতে হবে, ফুটবল খেলা মুজিবকে জানতে হবে, ১৯ বছর বয়সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে জেল খাটা শেখ মুজিবকে চিনতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষে পড়া ছাত্র মুজিবকে চিনতে হবে, যে বিশ্ববদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করে ছাত্রত্ব হারালেও মুচলেকা দিতে স্বীকৃতি জানায়নি।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে, যারা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এর রাজনীতির সাথে জড়িত, তারা যদি আজকের দিনে শপথ নেয়, আমি আমার নেতাকে অনুসরণ করবো, তবে এই আজকের দিনটি থেকে বাংলাদেশ একদম বদলে যাবে। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের সবচেয়ে সুন্দর ৩টি দিক তিনি সবার মধ্যে দেখতে চেয়েছিলেন, ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে। তিনি বলেছিলেন, ‘’আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে, আজ আত্মসংযমের প্রয়োজন আছে, আজ আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন আছে। তোমরা, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলরা আজ যারা এখানে বসেছে তারা মনে মনে চিন্তা কর। বুকে হাত দিয়ে খোদার ওপর নির্ভর কইরা বলো যে, আমরা মানুষকে ভালোবাসি, আমরা বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। আমরা ২৫ বছর সংগ্রাম করেছি। আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। আমরা ইতিহাস রাখবো। আমরা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করব। … তাহলেই আওয়ামী লীগের ইতিহাস থাকবে। তাহলে মরেও আমি শান্তি পাব।’

আত্মশুদ্ধি আর আত্মসমালোচনা – এই দুইটি গুণ যে বঙ্গবন্ধুর রক্তে মিশে ছিল, এটি আমরা জানতে পারি ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে। ব্যক্তিগতভাবে, বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সকল ভাষণের মধ্যে এটি আমার অত্যন্ত প্রিয়। এ ভাষণ আমাকে শেখায়, ভুলকে ভুল বলতে। নিজের ভুল স্বীকার করতে এবং নিজেকে উন্নততর করতে, এগিয়ে যেতে। তিনি বলেন,

“আমি ফেরেশতা নই, শয়তানও নই। আমি মানুষ, আমি ভুল করবোই। আমি ভুল করলে আমার মনে রাখতে হবে, আই ক্যান রেকটিফাই মাইসেলফ। আমি যদি রেকটিফাই করতে পারি, সেখানেই আমার বাহাদুরি। আর যদি গোঁ ধরে বসে থাকি যে, না আমি যেটা করেছি সেটাই ভালো, দ্যাট ক্যানট বি হিউম্যান বিইং। ফেরেশতা হইনি যে সবকিছু ভালো হবে। এই সিস্টেম ইন্ট্রোডিউস করে যদি দেখা যায় যে খারাপ হচ্ছে, অলরাইট রেক্টিফাই ইট। কেননা আমার মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমার বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে।”(৩)

আর তাই, যদি দশ জন রাজনীতিবিদ, দশ জন অর্থনীতিবিদ, দশজন ছাত্র, দশজন শিক্ষক, দশজন ব্যবসায়ী, দশজন আমলা, দশজন পুলিশ – এমন দশজন করে প্রতিটা সেক্টরের মানুষ যদি নিজেকে রেক্টিফাই করবার সাহস রাখে, নিজের সমালোচনা করবার, নিজের আত্মশুদ্ধি ঘটাবার সাহস করে, চেষ্টা করে, এই দেশটাতে একটা রেভ্যোলুশন ঘটে যাবে! আচ্ছা, আমি যদি বলি, বঙ্গবন্ধু যতোটুকু একজন পলিটিশিয়ান, তার থেকেও বেশি তিনি একজন দার্শনিক, ভুল হবে কি?

৩.

যেহেতু আজকে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, আজকে উনার দূরদর্শিতা নিয়ে আরও একটি গল্প বলা যেতে পারে। এই গল্পটি অন্নদাশংকর রায়ের সাক্ষাৎকার থেকে নেয়া। সাক্ষাৎকারটি ‘ইন্দ্রপাত’ নামে ছাপা হয়েছিলো। সাক্ষাৎকারটিতে খুবই চমকপ্রদ কিছু তথ্য আছে! বিশেষ করে, যারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চায় যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চান নি, এই অংশটুকু তাদের থোঁতা মুখ আরেকটু ভোঁতা করে দিবে, কী দুঃখজনক!

“শেখ সাহেবকে আমরা প্রশ্ন করি, ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এল?’

‘শুনবেন?’ তিনি মুচকি হাসলেন। ‘সেই ১৯৪৭ সালে। তখন আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরতচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙ্গালির এক দেশ। বাঙ্গালিরা এক হলে কী না করতে পারতো। তারা জগত জয় করতে পারতো। They could conquer the world.’

বলতে বলতে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন। তারপর তিনি বিমর্ষ হয়ে বলেন, ‘দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সোহরাওয়ার্দী আর শরত বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাদের প্রস্তাবে। তারা হাল ছেড়ে দেন। আমিও দেখি আর কোনও উপায় নেই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নেই, কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা। সে স্বপ্ন কেমন করে পূর্ণ হবে এই আমার চিন্তা। হবার কোন সম্ভাবনাও ছিলো না। লোকগুলা যা কমিউনাল ! হঠাৎ একদিন রব উঠলো, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দেই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে, যেদিন আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞেস করি, আমাদের দেশের নাম কি হবে? কেউ বলে পাক বাংলা, কেউ বলে পূর্ব বাংলা। আমি বলি- না, বাংলাদেশ। তারপর আমি শ্লোগান দেই, জয় বাংলা। তখন ওরা বিদ্রুপ করে, জয় বাংলা না জয় মা কালী ! কী অপমান ! সে অপমান আমি সেইদিন হজম করি। আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারেনি। জয় বাংলা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙ্গালি জাতির জয়। যা সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে।

‘জয় বাংলা’ আসলে একটি মন্ত্র। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ বা, দাদাভাই নওরোজীর ‘স্বরাজ’ বা, গান্ধীজির ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বা, নেতাজি সুভাষের ‘দিল্লি চলো’। এ হলো শব্দ ব্রহ্ম। একটি শব্দের বা শব্দের সমষ্টির মধ্যে অসীম শক্তি নিহিত। সে শক্তি অসাধ্যসাধনপটিয়সী।”

– ইন্দ্রপাত, অন্নদাশংকর রায়। (৪)

অত্যন্ত দূরদর্শী হওয়া স্বত্বেও আমাদের দেশে কিছু এলিট শ্রেণির মানুষ আছে, যারা বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে কথা বলবার আগে নাকের ফুটোদ্বয় একটু চওড়া করে ফেলেন, ঠোঁট একটু উলটে যায়, চেহারাতেই একটা অবহেলা চলে আসে। তাদের কথা-বার্তার ধরনটা এমন যে, শেখ মুজিব অজপাড়াগাঁয়ের এক গ্রাম্য ছেলে, সে আসলে পড়াশোনা ভালো জানতো না, পরিস্থিতি তাকে নেতা বানিয়ে দিয়েছে, আর কোনও এক ভাবে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে দেশটা স্বাধীন হয়ে গিয়েছে, এখানে শেখ মুজিবের তেমন কোনও ভূমিকা নেই। লক্ষ্য করলে দেখবেন, এরা মাঝে মাঝে এমনও বলে যে, বঙ্গবন্ধু নাকি ইংরেজি জানতেন না, তাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩ লাখকে ইংরেজিতে ভুলে থ্রি মিলিয়ন বলে ফেলেছিলেন। থ্রি মিলিয়ন বা তিরিশ লক্ষ শহীদের সংখ্যা যে বঙ্গবন্ধু দেশে এসে আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে জানাবার আগেই বহু দেশের পত্র-পত্রিকায় সংখ্যাটি ছাপানো হয়ে গিয়েছে, এর পক্ষে প্রচুর পেপার কাটিং পেশ করা যায় চাইলেই, তবে আমি আলোচনা সেদিকে নিচ্ছি না। বঙ্গবন্ধুকে যারা বুদ্ধি কম, লেখাপড়া কম বলে কিছুটা নিচু করে গ্র্যাটিফিকেশন পেতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্নটি হলো, তারা কি –দফা, বাঙ্গালির মুক্তির সনদ, কখনও খুঁটিয়ে পড়ে দেখেছে? এমন নিখুঁত একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি ইতিহাসে কম দেখতে পাওয়া যায়। আপনি যদি ২য় দফাটি দেখেন সেখানে লেখা আছে যে,

“বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ছাড়া সকল বিষয় অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে। উল্লিখিত দুটি বিষয় ন্যস্ত থাকবে কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে।”

এই ৬ দফা কর্মসূচি দেওয়া হয় ১৯৬৬ সালে, স্বাধীনতারও প্রায় ৫বছর আগে। ২য় দফাটি দিয়েই তাকে চাইলেই দেশদ্রোহী প্রমাণ করে শেষ করে দেওয়া যেতো। অথচ, তিনি এর এতো অসাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এখনকার রাজনীতিবিদদের কাছে তা আমরা আশাও করি না! ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ, আওয়ামী লীগ এর কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি ৬টি দফার বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেন। বঙ্গবন্ধুর দেয়া দ্বিতীয় দফার ব্যাখ্যাটি তুলে ধরছি।

তিনি যুক্তি দেন যে, ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬ সালে যে প্ল্যান দেন, তাতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে বলা হয়েছিল এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই তাতে সম্মতি দিয়েছিলো। দ্বিতীয় দফায় তিনি যোগাযোগ বাদ দিয়েছেন কেন, তারও ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, তিনি বলেন, ‘অখণ্ড ভারতের বেলায় অখন্ড যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো। পেশোয়ার থেকে চাটগাঁ পর্যন্ত এক রেললাইন চলতে পারতো। কিন্তু পাকিস্তানে তা সম্ভব নয়। দুই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য তো নয়ই বরং সম্পুর্ণ পৃথক।

মজার ব্যাপার হলো, যোগাযোগ বলতে শুধু রাস্তা ঘাট, রেললাইন বোঝায় যায় না। টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, এমন কি আজকের ইন্টারনেটও কিন্তু যোগাযোগ এর মাধ্যম। বঙ্গবন্ধু এই জায়গাটাও নোটিস করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘রেলওয়েকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ট্রান্সফার করে বর্তমান সরকার এটি স্বীকার করেছেন, একইভাবে টেলিফোন-টেলিগ্রাফ পোস্টাফিসের ব্যাপারেও এ সত্য স্বীকার করতে হবে।‘

সবচেয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা লেগেছে আমার কাছে, প্রদেশ আর স্টেট এর ব্যাপারটি। এই জায়গাটি আমি একেবারে হুবুহু বঙ্গবন্ধুর স্পিচ থেকেই তুলে দিচ্ছি –

“আরেকটা ব্যাপারে ভুল ধারণা সৃষ্টি হইতে পারে। আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে ‘প্রদেশ’ না বলে ‘স্টেট’ বলিয়াছি। ইহাতে কায়েমী স্বার্থ শোষকেরা জনগণকে এই বলিয়া ধোঁকা দিতে পারে বরং দিতেও শুরু করিয়াছেন যে, ‘স্টেট’ অর্থে আমি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ বা স্বাধীন রাষ্ট্র বুঝাইয়াছি। কিন্তু তাহা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র বড় বড় ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রোভিন্স’ না বলিয়া ‘স্টেট’ বলা হইয়া থাকে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকে ফেডারেশন অথবা ইউনিয়ন বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মানি, এমন কি আমাদের প্রতিবেশি ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাহাদের প্রদেশসমুহকে ‘স্টেট’ ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী আসাম ও পশ্চিম বাংলা ‘প্রদেশ’ নয় ‘স্টেট’। এরা যদি ভারত ইউনিয়নের প্রদেশ হইয়া ‘স্টেট’ হওয়ার সম্মান পাইতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে এইটুকু নামের মর্যাদা দিতেইবা কর্তারা এত এলার্জিক কেন?” (৫)

বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা ও নিজ এর বক্তব্যের এতো অসাধারণ যুক্তি, ক্ল্যারিফিকেশন দেখে, কতিপয় এলিট শ্রেণির ওই লোকগুলোর নিশ্চয়ই খুব দহনানুভূতি হয়। পাশ্চাত্যের শিক্ষায় শিক্ষিত, ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ, তৎকালীন মুসলিম লীগ পরিবারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়েও, গ্রামের কাদামাটি থেকে উঠে আসা, জনগণের রাখাল রাজা বনে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকে মূলত তারা সহ্য করতে পারে না, হিংসার কারণে। এ হিংসায় নিজেরা তো জ্বলেছেই, তাদের বংশধরেরা আজও জ্বলে।

৪.

জনগণ, বিশেষ করে শিশুদের প্রতি ভালোবাসার দুইটি গল্প বলে আজকের লেখা শেষ করি। প্রথম গল্পটা ১৯৭৩ সালের। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা প্রদর্শন এ বেড়িয়েছেন তিনি। ২৩ ডিসেম্বর গেলেন বরগুণায়। সকাল থেকে লাখ লাখ মানুষ কলেজ মাঠে ভিড় জমিয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে দেখবে বলে। প্রথম হেলিকপ্টার এসে নামলো। সেখান থেকে নামলেন সাংবাদিক মার্ক টালি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা তিনি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরের হেলিকপ্টার থেকে নামলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে দেখে লক্ষ লক্ষ জনতা শ্লোগান দিতে থাকে, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। নিরাপত্তায় ছিলেন সহকারী তোফায়েল আহমেদ, দেহরক্ষী মুন্সীগঞ্জের মহিউদ্দীন, বরগুণার মন্ত্রী শাহজাদা আব্দুল মালেক খান। হঠাৎ দেখা গেল, নিরাপত্তা বলয় ভেঙ্গে হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধুর দিকে ছুটে আসছে! বঙ্গবন্ধুও জনতার দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। দেহরক্ষী মহিউদ্দিন এবং এসডিও সিরাজউদ্দিন আহমেদ দৌড়ে বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার গতিরোধ করে। বঙ্গবন্ধু মহিউদ্দীনকে ক্ষুব্ধ হয়ে সরিয়ে দেন, এবং চিৎকার করে বলেন, “Let them kill me!” (৬) কী অবিশ্বাস্য ভরসা ছিল তার বাংলার মানুষের প্রতি! কী অদ্ভুত ভালোবাসা তিনি বেসেছিলেন এ দেশের মানুষকে, তার সন্তানদেরকে।

পরের গল্পটি, তাঁর শেষ জন্মদিন এর। শেষ জন্মদিনে শিশুদের জন্য গণভবন উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তিনি। তখনও অবশ্য তিনি জানতেন না, এটাই তাঁর শেষ জন্মদিন। বাচ্চাদের নিয়ে গণভবনে খেলা করেছেন, পুকুরে নিয়ে গিয়েছেন মাছ দেখাতে, গান করেছেন। (৭)


শিশুদের সাথে বঙ্গবন্ধু একেবারেই শিশু হয়ে যেতেন। সরদার ফজলুল করিমের একটি প্রবন্ধ থেকে একটু উদ্ধৃত করছি।

“সেবার শেখ সাহেব তার এক সহকর্মীর বাড়িতে গেলেন বেড়াতে। বাড়ির উঠানে পা দিতে না দিতেই ৫-১০ বছর বয়েসি শিশুদের একটা দল তুমুল মিছিল আর শ্লোগান শুরু করে দিলো! কাঠির মাথায় কাগজ লাগিয়ে, মাথায় নিশান লাগিয়ে হুলস্থুল অবস্থা ! ছোট্ট উঠানে চক্রাকারে ঘুরছে আর বলছে – “তোমার নেতা, আমার নেতা – শেখ মুজিব, শেখ মুজিব”, “ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”, “ইয়া হিয়া খানের মুসলমানি, এক পোয়া দুধে তিন পোয়া পানি” ঘুরে ফিরে আবারও, তোমার নেতা আমার নেতা – শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। শিশুদের এই কাহিনী দেখে শেখ সাহেবের মন আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে যিনি নি:শঙ্ক চিত্তে চিৎকার করেছেন, আমি বাঙ্গালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। তিনি শিশু মোর্চার সামনে দাঁড়িয়ে কৃত্রিম ভয় পাওয়ার ভঙ্গী করে তাদেরকে বললেন, “আরে বাবা! তোদের নেতা শেখ মুজিব! এমন বিচ্ছুদের নেতা হওয়ার সাহস আমার নাই।” (৮)


শুভ জন্মদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ মাটি, এ দেশ, এ দেশের নদী, জল, বৃক্ষ – সবকিছুতে মিশে আছেন আপনি। মিশে আছেন বাঙ্গালি জাতিসত্ত্বার মাঝে। মিশে আছেন স্বাধীন দেশের বাতাসে জন্ম নেয়া শিশুর প্রথম কান্নার চিৎকারে। কী কোমল সে কান্না, কী ভালোবাসা সে নতুন জন্মের কান্নায়!

সূত্র
১. বঙ্গভবনে পাঁচ বছর, মাহবুব তালুকদার
২. মজিবরের বাড়ি, মুনতাসির মামুন (সাক্ষাৎকার – গাফফার চৌধুরী কর্তৃক গৃহীত)
৩. ইতিহাসের আলোয় শেখ মুজিবুর রহমান, মুনতাসির মামুন
৪. ইন্দ্রপাত, অন্নদাশংকর রায়। (গ্রন্থ: বঙ্গবন্ধু, সম্পাদনায়- অভিনয় কুমার দাশ)
৫. ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ ৬ দফার ৫০ বছর, হারুন-অর-রশিদ
৬. Let them kill me: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সিরাজউদ্দীন আহমেদ (গ্রন্থ সংকলনঃ অগ্রপ্তহিক, আগস্টঃ ২০১৮)

৭. পেপার কাটিং কৃতজ্ঞতা:
ক. International Crimes Strategy Forum
খ. Center for Bangladesh Genocide Research (ধন্যবাদান্তে: মাহমুদুল হক মুনশি বাঁধন ভাই)

৮. বঙ্গবন্ধু (প্রবন্ধ: সরদার ফজলুল করিম, সম্পাদনায় অভিনয় কুমার দাস)

SUMMARY

1373-B4.jpg