বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: সংবিধানের ভিত্তি


বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ সারা বিশ্বে অতীব তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক প্রামাণিক দলিল হিসেবে পরিগণিত যাকে অতিসম্প্রতি ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’এর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। ১৯৯২ সালে ইউনেস্কো তার ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’এর স্বীকৃতি প্রদান কর্মসূচী শুরু করে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্বের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক দলিলসমূহকে মানবসভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এই ধারাবাহিকতায় আজ অবধি গোটা বিশ্বে মোট ৪২৭টি প্রামাণিক দলিলকে ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’এর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এই ৪২৭টি প্রামাণিক দলিলের মধ্যে অলিখিত ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে একমাত্র বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি। বাঙালি জাতির জন্য কী অনবদ্য এক অর্জন!

ইউনেস্কো তার ওয়েব পেজে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বর্ণনা করেছে:

The speech effectively declared the independence of Bangladesh. The speech constitutes a faithful documentation of how the failure of post-colonial nation-states to develop inclusive, democratic society alienates their population belonging to different ethnic, cultural, linguistic or religious groups. The speech was extempore and there was no written script.

অর্থাৎ ইউনেস্কোর বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কার্যকর অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে। এই ভাষণ গোটা বিশ্বের উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহের সর্বজনীন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার এক অকাট্য প্রামাণিক দলিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল একটি উপস্থিত-বক্তৃতা অর্থাৎ ভাষণটির কোনো লিখিত রূপ ছিল না।

আমার মতে, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের সংবিধানের এই চার মূলনীতি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথাই বলেছেন। তিনি বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন। তাঁর বক্তৃতায় বাঙালি জাতির উপর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতনের করুণ বর্ণনা দিয়েছেন।

একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি তুলেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্রের প্রতিফলনও আমরা দেখতে পাই। তিনি তাঁর বক্তব্যে একদিকে যেমন বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি জানিয়েছেন, তেমনি অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমজীবী গরিব মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন।

সবশেষে, বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতার সাক্ষর রেখেছেন। তিনি তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার প্রতিষ্ঠায় হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি সবার কথাই বলেছেন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আজ পর্যন্ত বিশ্বের আর কোনো নেতা পারেননি। তিনি ৭ মার্চের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন:

“আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।”

অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকে উদ্ভাসিত।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে সমাজতন্ত্রকে ধারণ করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ভাবনা শাস্ত্রীয় সমাজতন্ত্র ছিল না। আমরা পরবর্তীতে তাঁর অনেক বক্তৃতায় সে ব্যাখ্যা পেয়েছি। তিনি সমাজতন্ত্রকে তত্ত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে শোষণহীন, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অর্থনৈতিক মুক্তি দাবি জানানো হয়েছে, শোষণমুক্ত সমাজের দাবি জানানো হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণে যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক তিনি দিয়েছিলেন সেখানে শ্রমজীবী মানুষের উপর তাঁর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তিনি তাঁর ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার সময় বলেছিলেন:

“গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন।”

পাহাড়সম প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু গরিব দুখী ও শ্রমজীবী মানুষের কথা চিন্তা করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র। যদি তৎকালীন পাকিস্তানে গণতন্ত্রের বিজয় আমরা দেখতেই পেতাম তাহলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আর প্রয়োজনই হত না। সম্পূর্ণ বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকারের ন্যায্য দাবি জানিয়েছেন। তিনি যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। আবার এটাও সত্য যে, বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকশিত রূপ ধারণ করেছেন। গণতন্ত্রের সংখ্যাগত প্রেক্ষিত নয়, বরং তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল গণতন্ত্রের গুণগত মান। ৭ মার্চের ভাষণে তাই তিনি বলেছেন:

“আমি বললাম অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব– এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।”

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বলেছেন:

“এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।”

এই বাক্যটি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নীতির বহিপ্রকাশের একটি অনন্য উদাহরণ। দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে যে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল সেটি যে একটি ঐতিহাসিক ভুল ছিল তার বড় প্রমাণ হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। বাংলাদেশ জন্মের অন্যতম মূল উদ্দেশই ছিল ধর্মনিরেপেক্ষ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যদিও বঙ্গবন্ধুর মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পূর্বে প্রদান করা হয়েছিল তথাপি ৭ মার্চের ভাষণের যে ভাষা তার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রূপকার হিসেবে দেখতে পাই।

আমাদের সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ সংবিধানের পঞ্চম তফসিল দ্বারা আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উপরন্তু, সংবিধানের ৭(খ) অনুযায়ী সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের একটি অপরিবর্তনযোগ্য বিধান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে পঞ্চম তফসিলে উল্লিখিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি আমাদের সংবিধানের একটি অপরিহার্য ও অপরিবর্তনীয় অংশে পরিণত হয়েছে।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ষষ্ঠ এবং সপ্তম তফসিল স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্রের মূল পাঠকে সংবিধানের সঙ্গে সংযোজিত করেছে মাত্র। কিন্তু যেটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই সেটা হল, ১৯৭২ সালের আদি সংবিধান থেকেই এই দুটি বিষয় আমাদের সংবিধানের অন্তর্গত করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্র দুটি আমাদের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলেও স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্র ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী হিসেবে চিহ্নিত করে সংবিধানের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক।

একইভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত রয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি। সুতরাং এই বিষয় নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন ও অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিশলাকা যা প্রজ্জ্বলিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের ওই দাবানলের যার সামনে টিকতে পারেনি শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগিরা। ১৯৭১এর ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ এই ১৮ দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে– স্বাধীনতার সংগ্রামে। এই ভাষণ ছিল আমাদের সেই সময়ে দিশেহারা জাতির জন্য আলোকবর্তিকা স্বরূপ।

আর আজকে এই ভাষণ শুধু বাঙালি জাতির একান্ত ঐশ্বর্য নয়, বরং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্বমানবতার ঐশ্বর্য। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ্ব প্রামাণ্য দলিলের’ অন্তর্গত করার মাধ্যমে বিশ্বমানবতার বিজয় প্রতিষ্ঠিত হল। এগিয়ে যাক বিশ্বসভ্যতা, বিশ্ব মানবতা।

জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধু মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড

তুরিন আফরোজপ্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

SUMMARY

1362-1.png