জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা-– ইউনেসকো। ৩১ অক্টোবর এই স্বীকৃতি দেওয়ার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এতদিন যে ভাষণ ছিল বাঙালির জাগরণ ও আত্মপ্রত্যয়ের অবিনাশী বাণী, এখন তা পরিণত হল বিশ্বসম্পদে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই বজ্রনির্ঘোষ কন্ঠধ্বনি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় মূর্ত রূপ দিয়েছিল। যুদ্ধজয়ে প্রাণিত করেছিল। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ভাষণের কথা আমরা জানি। কিন্তু সেসব ভাষণ ছিল লিখিত। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল অলিখিত। এই ভাষণের পর আন্তর্জাতিক মিডিয়া তাঁকে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স’ বা রাজনীতির কবি হিসেবে অভিহিত করেছিল।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জ্যাকব এফ ফিল্ড কয়েক বছর আগে বিশ্বের সেরা বক্তৃতাগুলো নিয়ে একটি সংকলন গ্রন্থ বের করেছেন। ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার হিস্ট্রি’ নামক ওই গ্রন্থে ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের গত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে যুদ্ধকালে দেওয়া বিশ্বের অন্যতম অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তৃতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ কর্মসূচির আওতায় ৭ মার্চের ভাষণ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় বাঙালির গর্ব ও অহঙ্কারের থলিতে নতুন উপাদান যোগ করল।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব, তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে লেখালেখি আমাদের দেশে কম হয়নি। তারপরও বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা দেখে নিতে পারি কী ছিল সেই ভাষণে। বক্তৃতামঞ্চে উঠেই বঙ্গবন্ধু সমবেত লাখো জনতাকে আপন করে নিয়েছিলেন ‘ভায়েরা আমার’ বলে সম্বোধন করে। তিনি কোনো ভণিতা না করে সরাসরি জনতার কাছে তাঁর উপস্থিতির কারণ তুলে ধরে বলছিলেন,
“আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি– আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে।”
এই তিনটি মাত্র লাইনেই তখনকার অবস্থা বর্ণনা শেষ করে তিনি চলে যান তাঁর পরবর্তী প্রসঙ্গে। বলেন,
“আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়– তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়।”
সংক্ষিপ্ত বয়ান কিন্তু মানুষের বুঝতে কষ্ট হয় না। পেছনের ঘটনা তুলে ধরতেও বেশি শব্দ ব্যবহার করেন না। বলেন,
“নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে।”
এবার বাঙালির অধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতা তুলে ধরেন মাত্র কয়েকটি বাক্যে। অথচ কারও বুঝতে সমস্যা হয়নি। কারণ উপস্থিত জনতার অধিকাংশই ছিলেন এই ইতিহাসের সাক্ষী। বঙ্গবন্ধু ইতিহাস বর্ণনা করেন এইভাবে:
“কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।
আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি
১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয় লাভ করেও ক্ষমতায় বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান দশ বছর আমাদের গোলাম করে রাখল। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেওয়া হল এবং এরপর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হল। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বললেন, তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন, শাসনতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম।
তারপরের ঘটনা সকলেই জানেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা হল, আমরা তাকে ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম। কিন্তু ‘মেজরিটি’ পার্টির নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনলেন না। শুনলেন সংখ্যালঘু দলের ভুট্টো সাহেবের কথা। আমি শুধু বাংলার মেজরিটি পার্টির নেতা নই, সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। ভুট্টো সাহেব বললেন মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন ডাকতে, তিনি মার্চের ৩ তারিখে অধিবেশন ডাকলেন।
আমি বললাম, তবুও আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্ত্বেও কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব, এমনকি তিনি যদি একজনও হন।
জনাব ভুট্টো ঢাকা এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা হল। ভুট্টো সাহেব বলে গেছেন আলোচনার দরজা বন্ধ নয়; আরও আলোচনা হবে। মওলানা নুরানী ও মুফতি মাহমুদসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পার্লামেন্টারি নেতারা এলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা হল। উদ্দেশ্য ছিল আলাপ-আলোচনা করে শাসনতন্ত্র রচনা করব। তবে তাদের আমি জানিয়ে দিয়েছি ৬ দফা পরিবর্তনের কোনো অধিকার আমার নেই, এটা জনগণের সম্পদ।
কিন্তু ভুট্টো হুমকি দিলেন। তিনি বললেন, এখানে এসে ‘ডবল জিম্মি’ হতে পারবেন না। পরিষদ কসাইখানায় পরিণত হবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের প্রতি হুমকি দিলেন যে, পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিলে রক্তপাত করা হবে, তাদের মাথা ভেঙে দেওয়া হবে। হত্যা করা হবে। আন্দোলন শুরু হবে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত। একটি দোকানও খুলতে দেওয়া হবে না।
তা সত্ত্বেও পঁয়ত্রিশ জন পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্য এলেন। কিন্তু পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। দোষ দেওয়া হল বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হল আমাকে, বলা হল আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্যই কিছু হয়নি।
এরপর বাংলার মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। আমি শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য হরতাল ডাকলাম। জনগণ আপন ইচ্ছায় পথে নেমে এল।”
সত্তরের নির্বাচনে জনগণের দেওয়া রায় বানচালের জন্য ইয়াহিয়া-ভুট্টোর কারসাজি তথা ষড়যন্ত্রের তথ্য তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে বলেন,
“কিন্তু কী পেলাম আমরা? বাংলার নিরস্ত্র জনগণের উপর অস্ত্র ব্যবহার করা হল। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই। কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনে দিয়েছি বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে, আজ সে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য। আমার দুখি জনতার উপর চলছে গুলি। আমরা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখনই দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চেয়েছি, তখনই ষড়যন্ত্র চলেছে– আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।”
এবার বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর স্বরূপ উন্মোচনের লক্ষ্যে বলেন,
“ইয়াহিয়া খান বলেছেন, আমি নাকি ১০ মার্চ তারিখে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে চেয়েছি, তার সাথে টেলিফোনে আমার আলাপ হয়েছে। আমি তাকে বলেছি, আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট, ঢাকায় আসুন দেখুন আমার গরিব জনসাধারণকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে।”
নিজের অবস্থানের পক্ষে জনতার সমর্থন আদায়ের জন্য উপস্থিত জনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতিধ্বনি করে তিনি বলেন,
“আমি আগেই বলে দিয়েছি, কোনো গোলটেবিল বৈঠক হবে না। কীসের গোলটেবিল বৈঠক? কার গোলটেবিল বৈঠক? যারা আমার মা-বোনের কোল শূন্য করেছে তাদের সাথে বসব আমি গোলটেবিল বৈঠকে?
২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস (সাইদুল ইসলামের ডিজিটাল আর্ট)
তেসরা তারিখে পল্টনে আমি অসহযোগের আহ্বান জানালাম। বললাম, অফিস-আদালত, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করুন। আপনারা মেনে নিলেন।
হঠাৎ আমার সঙ্গে বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে একজনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সমস্ত দোষ আমার ও বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দোষ করলেন ভুট্টো– কিন্তু গুলি করে মারা হল আমার বাংলার মানুষকে। আমরা গুলি খাই, দোষ আমাদের– আমরা বুলেট খাই, দোষ আমাদের।”
জনতাকে তাতিয়ে তুলে জনতার নেতা তুলে ধরলেন তাঁর শক্ত অবস্থানের কথা। বললেন,
“ইয়াহিয়া সাহেব অধিবেশন ডেকেছেন। কিন্তু আমার দাবি: সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব পরিষদে বসব কী বসব না। এ দাবি মানার আগে পরিষদে বসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, জনগণ আমাকে সে অধিকার দেয়নি। রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি, শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে ২৫ তারিখে পরিষদে যোগ দিতে যাব না।”
বঙ্গবন্ধুর কাছে মানুষ সেদিন সরাসরি স্বাধীনতার ডাক শুনতে চেয়েছে। সেই ডাক শোনার প্রতীক্ষায় যখন সবাই চঞ্চল তখন বঙ্গবন্ধু আচমকা সমবেত সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন,
“ভাইয়েরা, আমার উপর বিশ্বাস আছে? আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো; মনে আছে? আজও আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।”
বঙ্গবন্ধুর যেমন জানা মানুষ সেদিন তাঁর কাছে কোন কথাটি শুনতে চায়, আবার একই সঙ্গে ইয়াহিয়া-চক্রের ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও তিনি জানেন। তাঁর একটি ভুল পদক্ষেপ কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে তা তিনি জানেন। তাই তিনিও কৌশলে আশ্রয় নেন। কতগুলো দিকনির্দেশনা দেন:
“আমি বলে দিতে চাই, আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারী অফিস যাবেন না। এ আমার নির্দেশ।
গরিবের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য রিক্সা চলবে, ট্রেন চলবে আর সব চলবে।
ট্রেন চলবে– তবে সেনাবাহিনী আনা-নেওয়া করা যাবে না। করলে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তার জন্য আমি দায়ী থাকব না।
সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্ট, জজ কোর্টসহ সরকারি, আধাসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো বন্ধ থাকবে। শুধু পূর্ব বাংলার আদান-প্রদানের ব্যাংকগুলো দুঘণ্টার জন্য খোলা থাকবে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা যেতে পারবে না। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে। তবে, সাংবাদিকরা বহির্বিশ্বে সংবাদ পাঠাতে পারবেন।”
পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন,
“এদেশের মানুষকে খতম করা হচ্ছে, বুঝে-শুনে চলবেন। দরকার হলে সমস্ত চাকা বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
মূল ঘোষণায় যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু জনগণকে ভবিষ্যৎ নির্দেশনা দেন একজন দক্ষ সমরনায়কের মতো। তাঁকে গ্রেপ্রো করা হতে পারে, তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে না পারেন, কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রাম চলবে। আন্দোলনের একটি সম্ভাব্য রূপরেখাও তুলে ধরেন। বলেন,
“যদি একটিও গুলি চলে তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলবেন। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা তাদের ভাতে মারব– পানিতে মারব। হুকুম দিবার জন্য আমি যদি না থাকি, আমার সহকর্মীরা যদি না থাকেন, আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।”
সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,
“তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ কিছু বলবে না। গুলি চালালে আর ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাঙালি মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতে পারবে না।”
আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষে তাঁর আরও কিছু নির্দেশনা:
“শহীদদের ও আহতদের পরিবারের জন্য আওয়ামী লীগ সাহায্য কমিটি করেছে। আমরা সাহায্যের চেষ্টা করবো। আপনারা যে যা পারেন দিয়ে যাবেন। সাত দিনের হরতালে যে সব শ্রমিক অংশগ্রহণ করেছেন, কারফিউর জন্য কাজ করতে পারেননি– শিল্পমালিকরা তাদের পুরো বেতন দিয়ে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন অফিসে দেখা না যায়। এ দেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। আপনারা আমার উপর ছেড়ে দেন, আন্দোলন কীভাবে করতে হয় আমি জানি।”
সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না (সাইদুল ইসলামের ডিজিটাল আর্ট)
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অভিজ্ঞ কাণ্ডারি। বিপদ কোন কোন দিক থেকে আসতে পারে সেটা তাঁর অজানা ছিল না। তাই বলেছিলেন,
“কিন্তু হুঁশিয়ার, একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আত্মকহলের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।
রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যদি আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচার না করে তবে কোনো বাঙালি রেডিও এবং টেলিভিশনে যাবেন না।”
চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়ার আগে তিনি পাকিস্তানিদের শেষ সতর্কবার্তা দেন এইভাবে:
“শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভাবনা আছে, তা না হলে নেই। বাড়াবাড়ি করবেন না, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”
জনগণের উদ্দেশে বলেন,
“প্রস্তুত থাকবেন, ঠাণ্ডা হলে চলবে না। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন। আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। শৃঙ্খলা ছাড়া কোনো জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না।
আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।”
একেবারে শেষে এসে তিনি উচ্চারণ করেন সেই চূড়ান্ত বাক্যটি:
“এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
এই বজ্রকণ্ঠ ঘোষণাই ছিল আসলে আমাদের, বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ঘোষণা। তাঁর এই ভাষণ বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের কালজয়ী অনন্য দলিল, এখন তা, মফিদুল হকের ভাষায়– বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক।
শেষ করছি কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে:
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
৭ মার্চের ভাষণ ইউনেসকো একাত্তরের ৭ মার্চ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ পাকিস্তানি শাসন বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষ বিশ্বসম্পদ ভাষণ
বিভুরঞ্জন সরকারসাংবাদিক ও কলামিস্ট।