হাজার বছরের ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, ১৯৭১ এর আগে বাঙালির কোনও নিজস্ব রাষ্ট্র ছিল না। ছোট ছোট রাজারা বাংলাকে নানান খণ্ডে ভাগ করে শাসন করেছে দীর্ঘকাল। তারপরে দেখা গেছে কখনও উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শাসকরা এসে বাংলা শাসন করেছে, কখনওবা শাসক এসেছে উপমহাদেশের বাইরে থেকে। বাঙালির জন্যে, বাঙালি দ্বারা পরিচালিত কোনও স্বাধীন রাষ্ট্রের চিন্তা প্রথমে আসে ব্রিটিশ চলে যাবার আগ মুহূর্তে। ওই সময়ে বাংলার প্রগতিশীল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতারা প্রথম বাঙালির জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গড়ার উদ্যোগ নেন। এর আগে একমাত্র লেখক ও বুদ্ধিজীবী এস ওয়াজেদ আলী বাঙালির জন্যে একটি আলাদা রাষ্ট্রের কথা লেখেন তার একটি লেখায়।
এস ওয়াজেদ আলীর ওই লেখা এবং বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রগতিশীল রাজনীতিকদের ওই উদ্যোগ ছিল বড়ই বিপরীতমুখী একটি সময়ে। কারণ, এস ওয়াজেদ আলী যখন লেখেন সেটা ছিল একক ভারতবর্ষ স্বাধীন করার সংগ্রামের সময়। যার নেতৃত্বে ছিল বাঙালিরা। এমন একটি সময়ে বাঙালির জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের কথা লেখা সত্যিই একটা কঠিন কাজ ছিল। তিনি সেটা করেছিলেন। অন্যদিকে, যে সময়ে পূর্ববাংলা পাকিস্তান আন্দোলনের জোয়ারে ভাসছে, পূর্ববাংলার বেশিরভাগ মুসলিম পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছে ওই সময়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতাদের বাঙালির জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র করার উদ্যোগ ছিল বড়ই অসময়ের উদ্যোগ। তারপরও রাজনীতিকদের রিলে রেসের মতো কোনও না কোনও উদ্যোগ এভাবে শুরু করতে হয়। ওই উদ্যোগ যেদিন নেয়া হয় সেদিন কেউ কি ধারণা করতে পেরেছিলেন-তাদের এই উদ্যোগের মশাল তারা কারো হাতে তুলে না দিয়ে গেলেও তাদের উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক তরুণ কর্মী আপন বুকের পাঁজরে ওই মশালের আলো জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলা শুরু করবে?
বাস্তবে ইতিহাসের এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজ বোঝা যায়, কলকাতা থেকে আপন বুকের পাঁজরে এই বাঙালির রাষ্ট্রের বজ্রানল একলা জ্বালিয়ে নিজ জন্মমাটি পূর্ববঙ্গে ফিরে এসেছিলেন সেদিনের মুসলিম লীগ কর্মী তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান। আর সেই আলোতে পথ চিনিয়ে চিনিয়ে মাত্র বাইশ বছরে তিনি বাঙালিকে তার একটি নিজস্ব রাষ্ট্রের দ্বারে নিয়ে আসেন। তার এই পথ চলার ইতিহাস আজ আর নতুন করে বলার নয়। শুধু সংক্ষেপে বলা যায়, বাঙালির একটি জাতিরাষ্ট্র গড়ার জন্যে মাত্র বাইশ বছরে তিনি বাঙালিকে শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদে ঐক্যবদ্ধ করেননি; বাঙালির আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও অনান্য সকল মুক্তির জন্য তাকে প্রস্তুত করেন। যার ফলে বাঙালিকে তিনি নিজ হাতে একটি রাষ্ট্র গড়ে দিতে পারেন। কয়েক হাজার বছর পথ পরিক্রমায় ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে বাঙালি সেই মাহেন্দ্রক্ষণে এসে দাঁড়ায়।
১৯৭১ আমাদের ইতিহাসে এক বর্ণাঢ্য বছর। কেউ হয়ত বলতে পারেন- যেখানে এত মানুষ মারা গেল, এত মা-বোনের আব্রু ছিন্ন হলো সে বছর বর্ণাঢ্য হয় কীভাবে? ১৯৭১ এ বাঙালির এই মৃত্যু যেমন দুঃখের তেমনি এ এক মহান আত্মত্যাগ। কয়েক হাজার বছরের পথপরিক্রমায় এ ছিল জন্মের বেদনা আর জন্মজরায়ুর রক্তস্রোত ক্ষণ। বাস্তবে সব শহীদের আত্মদান যেমন শোকের তেমনি বিজয়েরও। কারণ, আত্মদানের থেকে বড় কোনও দান নেই এ সৃষ্টিতে। তাই, সব মিলে ১৯৭১ আমাদের জাতীয় জীবনের সব থেকে বর্ণাঢ্য বছর। এই বছরের প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত একেকটি মাইলস্টোন। তবে, এর ভেতর শ্রেষ্ঠ দিনগুলো ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৭ এপ্রিল আর ১৬ ডিসেম্বর। ৭ মার্চ জনসভার মাধ্যমে স্বাধীনতার বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলেন বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, জনগণের নির্বাচিত নেতা হিসেবে আইনত তিনি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অর্থাৎ, ওই মুহূর্ত থেকে আমাদের ভূখ- পাকিস্তানি শাসনমুক্ত একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। এই স্বাধীন রাষ্ট্রকে একটি জাতিরাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামো দেয়া হয় ১৭ এপ্রিল। অর্থাৎ, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু এই ভূখণ্ডের নেতা হিসেবে যে রাষ্ট্রটির স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ওই রাষ্ট্রটি সাংবিধানিক কাঠামো পায় ১৭ এপ্রিল। ওই দিনই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি আমাদের ওই মুহূর্তের সংবিধান আর বাস্তবে সংবিধানের মাতৃজনন কোষ) মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ঘোষণা করা হয়। ওই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর শীর্ষবিন্দু বা আমাদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে, ওই দিনই বাঙালি তার প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলে এবং ওই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অর্থাৎ, কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল বাঙালি প্রথম তার রাষ্ট্র গড়ল এবং ওই রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হলেন বঙ্গবন্ধু মুজিব।
স্বাধীনতার পরে প্রথমে দেশ পুনর্গঠনের ব্যস্ততা পরবর্তীতে প্রতিবিপ্লবীদের ক্ষমতা দখলের কারণে বাঙালি অনেক কিছুই উপলব্ধি করার যেমন সুযোগ পায়নি তেমনি সুযোগ পায়নি তার ইতিহাসের প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যায়ন করার। আজ বলা যেতে পারে, একটি সুস্থির সময়ে গোটা জাতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে এসে তাই আজ আর কোনওমতেই বাঙালির রাষ্ট্র গঠনের দিবসটিকে শুধু মুজিব নগর দিবসের ভেতর ফেলে রাখার কোন সুযোগ নেই। বরং মুজিববর্ষেই ঘোষিত হতে পারে ১৭ এপ্রিল আমাদের রাষ্ট্র দিবস। এই দিনেই বাঙালি যেমন হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম তার রাষ্ট্র বা প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলে তেমনি এদিনেই বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক হন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের অন্যতম লক্ষ্য, বর্তমানের প্রতিটি বাঙালিকে ও অনাগত বাঙালি যাতে তার প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে, জানতে পারে তার জন্মের ঠিকানা, তার গর্ব । যাতে সে তার ভবিষ্যতের চলার পথ করে নিতে পারে। ইতিহাসের এসব কিছু ঠিকঠাক করে দেবার একটি বড় দায়িত্ব আমাদের এ বছর পালন করতে হবে। আমাদের এমন একটি ইতিহাসের সঠিক স্রোতধারা গড়তে হবে যাতে জাতির ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক করে সময় পার করতে না হয়। বরং সেটা এগিয়ে যেতে পারে সাবলীলভাবে। এ কারণে, এই মুজিববর্ষে ইতিহাসের অনেক ভুলে থাকা বিষয় আমাদের সংশোধন করতে হবে। বাঙালির রক্তে ও আব্রুতে কেনা এই রাষ্ট্রকে ঘিরে ও তার স্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে আমাদের ইতিহাসের যত পাতা আছে সব মেলতে হবে। এবারের ১৭ এপ্রিল আমরা মুজিব নগর দিবস হিসেবে পালন করব। কিন্তু মুজিববর্ষে, অর্থাৎ প্রথম রাষ্ট্রপতি বা রাষ্ট্রনায়কের জন্মশতবার্ষিকীতে বাঙালির হাজার বছরের প্রথম রাষ্ট্র গঠনের দিনটি কী আর শুধু মুজিব নগর দিবস হিসেবে রাখা ঠিক হবে? যেহেতু এ দিনই সাংবিধানিকভাবে সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের রাষ্ট্র-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। তাই এ দিনটি ঘোষিত হোক আমাদের রাষ্ট্র দিবস