সকালটা শুরুই হয়েছিলো প্রচণ্ড ব্যস্ততার মাঝে। প্রচুর নেতাকর্মী বাড়িতে। এর মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ বার বার ফোন করেও শেখ মুজিবকে পাচ্ছেন না। আগেরদিন এর বক্তব্যের উপর সকালের পেপারে রিপোর্ট এসেছে যে শেখ মুজিব বলেছেন, “আমি আমার দেশবাসীর রক্তের উপর পাড়া দিয়ে পরিষদে যোগ দিতে পারি না”।
তিনি তার ছেলেকে শেখ মুজিবের বাড়িতে পাঠালেন যে করেই হোক মুজিব যাতে তার সাথে যোগাযোগ করেন। মুজিব পরবর্তীতে ফোন করলে তিনি বলেন, “পরিষদ তোমার। ন্যায়ত ও আইনত তুমি হাউজ প্রধান। ওটা আসলে তোমার বাড়ি, নিজের বাড়িতে যাইতে শর্ত করো কার সাথে? ইয়াহিয়া বরং অনধিকার প্রবেশকারী, তার সাথে আবার কিসের শর্ত?”
শেখ মুজিব হেসে উত্তর দিলেন, এতোসব হত্যাকাণ্ডের পরও আমাকে পরিষদে যাইতে বলেন?”
আবুল মনসুর বললেন, “তোমার বাড়িতে ডাকাত পড়েছে , ডাকাতের হাতে তোমার পরিবারের কিছু মানুষ খুন হয়েছে। সে ডাকাত তাড়াবার জন্য তোমাকে সেই পরিবার এর শহীদদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে সে ঘরে তোমাকে ঢুকতে হবে।”
শেখ মুজিব খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “আজকে আমার বক্তৃতা শুনবেন। ময়দান হতে সরাসরি বেতারে সম্প্রচার করা হবে। দোয়া করবেন।”
মনসুর সাহেব তার স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান পরে, সকাল তখন ১১টা। সেখানে ড. ফজলে রাব্বী তাদেরকে জানান, ২ ঘণ্টা আগে তিনি শেখ সাহেবের বাড়ির সামনে হাজার হাজার ছাত্রদের ভিড় দেখে এসেছেন। তাদের দাবি, শেখ মুজিব আজকের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা না দিলে তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়া হবে না। আবার সারা শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে আজকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া মাত্র পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী জনতার উপর গুলি বর্ষণ করবে।
সে সময় শেখ মুজিব তার বাসভবনের লাইব্রেরি কক্ষে তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ড. কামাল হোসেনসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নেন। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু সবাইকে বলেন, ছাত্রজনতার দাবির সাথে তার একমত পোষণ করেছেন এবং বিকেলে রেসকোর্সে চার দফার দাবি পেশ করা হবে।
চার দফার খসড়া তৈরি করেন কামাল হোসেন এবং টাইপ করেন মোহাম্মদ হানিফ। এরপর মূল কপি ও টাইপড কপি মিলিয়ে দেখতে দেয়া হয় ওয়াজেদ মিয়াকে। পরবর্তীতে ওয়াজেদ মিয়ার লেখা বই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, থেকে জানা যায়, বক্তৃতায় ঘোষিত “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” কিংবা, “আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি যার যা আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়”, জাতীয় কিছুই সে কপিতে লেখা ছিল না।
দুপুরের খাবারের পর তিনি পাঞ্জাবী পরে প্রস্তুত হতে থাকেন জনসভায় যাবার জন্য, এমন সময় তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা তাকে ঘরে ডেকে এনে ১৫ মিনিট চুপচাপ বিশ্রাম নিতে বলেন, এসময় তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা তার চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে, মাথা টিপে দিতে থাকে। শেখ সাহেবের সেদিন সামান্য সর্দি হয়েছিল। কাঁথা গায়ে তিনি কিছুক্ষণ শুয়ে ছিলেন। একটা টুল এনে ফজিলাতুন্নেসা তার কাছে এসে বসলেন। বললেন, “সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবার ভাগ্য আজ তোমার ওপর নির্ভর করছে। তুমি আজ একটা কথা মনে রাখবে সামনে তোমার লাঠি পেছনে বন্দুক। তোমার মনে যে কথা আছে তুমি তাই বলবে। অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে। তোমার কথার ওপর সামনের অগণিত মানুষের ভাগ্য জড়িত। তাই তুমি নিজে যেভাবে যা বলতে চাও নিজের থেকে বলবে। তুমি যা বলবে সেটাই ঠিক হবে। দেশের মানুষ তোমাকে ভালোবাসে, ভরসা করে।”
আড়াইটার দিকে শেখ সাহেব রওনা দিলেন। তার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হাজী মোহাম্মদ গোলাম মুরশীদ-এর গাড়িতে করে রওনা দিলেন, গাড়ি চালাচ্ছিলেন গোলাম মুরশীদ সাহেব নিজেই। পেছনে বসেছিলেন মোস্তফা সাহেব ও মহিউদ্দিন সাহেব। ড্রাইভারের পাশের সিটেই শেখ সাহেব বসে ছিলেন। সব সময় যে রাস্তা দিয়ে যান, সেদিন তার ব্যতিক্রম করে বললেন, “ডানে সাতমসজিদ রোড দিয়ে যাও”, ঝিগাতলার কাছে এসে গোলাম মুরশীদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “আজকে কি বলবেন?”, তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আল্লাহ আমার মুখ দিয়ে যা বের করে তাই বলবো।”
রেডিও সম্প্রচার ও ভিডিও
রেডিওতে সম্প্রচারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন রেডিও পাকিস্তান, ঢাকার তৎকালীন ডিরেক্টর আশরাফুজ্জামান খান। ভাষণের দিন মঞ্চে অবস্থান নেন প্রোগ্রাম অরগানাইজার নাসার আহমেদ চৌধুরী (যার সাথে একটি ব্যক্তিগত পোর্টেবল EMI- টেপ রেকর্ডারও ছিলো) ও অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর আহমেদুজ্জামান। মঞ্চের নিচে অবস্থান নেন দুইজন প্রোগ্রাম অর্গানাইজার সামসুল আলম এবং কাজী রফিক। সাভার ট্রান্সমিটার সেন্টারে ছিলেন প্রোগ্রাম প্রডিউসার মীর রায়হান। আশফাকুর রাহমান (প্রোগ্রাম অর্গানাইজার) এবং বাহরাম সিদ্দিকী (প্রোগ্রাম অর্গানাইজার) ছিলেন ঢাকা রেডিও অফিসে।
৭ই মার্চ সকাল থেকেই রেডিওতে প্রচার করা হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা থেকে সম্প্রচার করা হবে। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ শুরু করবেন, তখন ঢাকা অফিস থেকে রেসকোর্সে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর আসে সম্প্রচার বন্ধ করতে। মেজর সিদ্দিক সালেক ঢাকা অফিসে অবস্থানরত আশফাকুর রহমানকে হুমকি দিয়ে বলেন, তারা যদি ভাষণের সরাসরি সম্প্রচার অব্যাহত রাখে, তাহলে রেডিও অফিস উড়িয়ে দেওয়া হবে। “নাথিং অব শেখ মুজিবুর রহমান উইল গো অন দ্য এয়ার আনটিল ফারদার অর্ডার।” সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু নাসার আহমেদ চৌধুরী তার ব্যক্তিগত টেপ- রেকর্ডারে গোপনে ভাষণটি রেকর্ড করতে থাকেন।
অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর আহমেদুজ্জামান দ্রুত একটি চিরকুটে সম্প্রচার বন্ধ হওয়ার ঘটনাটি লিখে ডিরেক্টর আশরাফুজ্জামান খানের পাঠান, তিনি আবার টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্যের হাতে সেই চিরকুটটি দেন। তিনি চিরকুটটি বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠান। ভাষণ তখন মাঝ পথে। চিরকুটটি এক ঝলক পড়ে সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এইমাত্র খবর পেলাম, তারা ভাষণ সম্প্রচারে বাধা দিচ্ছে” এবং এরপরেই বলেন, “…মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোনো বাঙ্গালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙ্গালী টেলিভিশনে যাবেন না…।”
এছাড়াও, ঢাকা বেতারের পক্ষ থেকে ছিলেন তৎকালীন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য এম এ খয়ের। তিনি ছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম করপোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আর চেয়ারম্যান ছিলেন এইচ এম সালাউদ্দিন, টেকনিক্যাল চিফ ছিলেন এন এইচ খন্দকার। তারা সিদ্ধান্ত নেন, যেভাবেই হোক তারা এই বক্তৃতা রেকর্ড করবেন। আবুল খায়ের এমএনএ-র তত্ত্বাবধানে মঞ্চের নিচে এ এইচ খন্দকার সম্পূর্ণ ভাষণের কথাই রেকর্ড করতে সক্ষম হলেন। বেতারের কর্মকর্তারাও ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করতে না পারলেও এটির পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড করাতে তারা সক্ষম হন, যা পরদিন বেতারকর্মী এবং জনগণের দাবির কারণে বেতার থেকে প্রচারিত হয়।
ভিডিওতে ছিলেন এম এ মবিন ও সহকারির দায়িত্ব পালন করেন তার সাথী তৌহিদ, জুনায়েদ এবং খলিল নামে ৩ জন। ৪ অথবা ৫ মার্চ তারা খয়ের সাহেবের সাথে, যিনি তৎকালীন সরকারের ফিল্ম ডিভিশনের (ডিএফপি) কর্মকর্তা ছিলেন, তার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ করেন। এইচডি ক্যামেরা দিয়ে সাইলেন্ট মুডে ভাষণটি রেকর্ড করা হয়েছিল আর একটি মাইক সাউন্ড প্যানেলে জুড়ে দেয়া হয়েছিলো।
৭ মার্চের ভাষণ- ঐতিহাসিক এক মহাকাব্য
“ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন ও বোঝেন …”
একেবারে স্বচ্ছ ও খাঁটি বাংলা ভাষায়, সহজ শব্দ সংবলিত এই ভাষণটি কিভাবে ঐতিহাসিক এক মহাকাব্যে পরিণত হয়ে উঠলো, যারা এ ভাষণটি শুনেছেন, তারা জানেন। ১৯ মিনিটের এই ভাষণে আছে বাঙ্গালীর পরবর্তী প্রতিটি পদক্ষেপের ইঙ্গিত। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, যুদ্ধের – সবকিছুর সবুজ সংকেত।
তিনি ভাষণে বলেন, “গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু… সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন… ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না।” অর্থাৎ, এই যে অসহযোগ, এ মুহুর্তে আমাদের অর্থনীতি কি হবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়ে দিলেন তিনি।
কে এম শফিউল্লাহ সাহেব বলেন, ৭ মার্চেই যদি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেয়া হতো, আমরা সারপ্রাইজড হয়ে যেতাম। কিন্তু যেভাবে দেয়া হয়েছে, সে কারণে আমরা মেন্টালি একটি প্রিপারেশন নিতে পেরেছি। আর না হলে ক্যানটনমেন্টের সবাই মারা যেতো, কিন্তু এই সময়ের কারণে ট্রুপস থেকে শুরু করে সবাই কিছুটা হলেও মেন্টালি প্রিপেয়ার হতে পেরেছে এবং বুঝতে পেরেছে কে আমাদের পক্ষে আর কে বিপক্ষে। “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে…” এই কথার প্রেক্ষিতে আমি, জেনারেল জিয়া, কর্নেল অলি, কর্নেল এম আর চৌধুরী চিটাগাং স্টেডিয়ামে ৮ মার্চে প্রথমবারের মতো একত্র হই এবং শুভপুর ব্রিজ থেকে হিলট্যাক্টস পর্যন্ত ডিফেন্সে থাকবো এবং হিলট্র্যাক্ট হবে আমাদের বেইজ ক্যাম্প, আর শুভপুর হবে ইনিশিয়াল ডিফেন্স। সাঙ্গু খুলে দেয়া হবে, বর্ডারের সাথে যোগাযোগ করে। ইফ দে স্ট্রাইক, উই উইল স্ট্রাইক ব্যাক, বাট উই উইল নট স্ট্রাইক ফার্স্ট – এ সিদ্ধান্ত নেই।
সে সময় পুলিশের সাব ডিভিশনাল অফিসার হিসেবে কর্মরত মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমি পরবর্তীতে পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে খবর পেয়েছি যে, পাকিস্তান আর্মি ও এয়ারফোর্স প্রস্তুত ছিলো অ্যাটাক করবার জন্য। যদি শুধু বলা হতো, এখন থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, সাথে সাথে এয়ার স্ট্রাইক শুরু হয়ে যেতো, সেখানকার লাখ লাখ মানুষ মারা যেতো। যেটা বায়াফ্রাতে হয়েছিলো, সেখানকার নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলো যে আজ হতে বায়াফ্রা স্বাধীন, নাইজেরিয়া থেকে সিসিড হলো। সাথে সাথে সেনাবাহিনী আক্রমণ করলো। পাকিস্তান আর্মি কোনদিন বলতে পারবে না যে আমরা বিদ্রোহ করেছি তাই অ্যাকশন নেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পলিটিকেলি ডিফেন্স করেছেন, যার কারণে সারা বিশ্ব দেখেছে যে বাঙ্গালীদের উপর যুদ্ধ চাপানো হয়েছে, তাদের গণহত্যা করা হচ্ছে, দে আর ফাইটিং ফর সারভাইভাল। বঙ্গবন্ধুর থেকে বড় পলিটিশিয়ান কে, যে এমন একটা অবস্থা তিনি আগে থেকেই অনুধাবন করতে পেরেছেন এবং পাকিস্তানকে সরাসরি সুযোগ দেননি আক্রমণের।”
এমনই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার চুড়ান্ত পরিচয় শেখ মুজিব দিয়েছিলেন, ৭ মার্চের ভাষণে। সে ভাষণে তিনি জনতার কর্তব্য কী হবে, সে নির্দেশনাও দিয়েছেন, “এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সংগে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন।”
একটি জাতির জন্মের জন্য চূড়ান্ত নির্দেশনা তিনি দিয়ে গেলেন এই বলে, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা … এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
মিটিঙ এর শেষদিকে তিনি বললেন, “জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আমি আপনাদের সাথে বেইমানী করি নাই। প্রধানমন্ত্রিত্ব দিয়াও আমাকে নিতে পারে নাই, ফাসিকাষ্ঠে আসামী করেও আমাকে নিতে পারে নাই। যে রক্ত দিয়ে আপনারা আমাকে একদিন জেল থেকে বাহির করে নিয়ে এসেছিলেন, এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম, আমার রক্ত দিয়ে আমি রক্তের ঋণ শোধ করবো, মনে আছে? আমি রক্ত দিবার জন্য প্রস্তত। আমাদের মিটিং এখানেই শেষ, আসসালামু আলাইকুম। জয় বাংলা”
মার্চের ৩ তারিখ শেখ সাহেব দেশবাসীকে বলেছিলেন, চলমান হরতালে রিকশাওয়ালা ভাইদেরকে ভাড়া সামান্য বাড়ায়ে দিতে, যাতে তাদের খেয়ে পড়বার রিজিক উঠে আসে। প্রচন্ড মানবিক শেখ সাহেব, ৭ মার্চের ভাষণেও বললেন, “যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন”। সব কাজ শেষে, সন্তানের খেয়াল নিতে তিনি কখনোই ভুলেন নাই। জাতির পিতা তিনি না হলে, জাতির পিতা কে?
সে রাতে পরিবারের সকলের সাথে খেতে বসেন শেখ সাহেব। বলেন, ‘আমার যা বলার ছিল আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোন মুহূর্তে গ্রেপ্তার করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দুবেলা আমার সঙ্গে খাবে।’
সূত্র
১) ডকুমেন্টারি – দা স্পীচ
২) শেখ হাসিনা’র কলাম “আমার মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব”, বাংলাদেশ প্রতিদিন
৩) আসিফুর রেজা সাগর এর কলাম, “আমার যা বলার ছিলো জনসভায় তা বলে দিয়েছি”, দৈনিক ইত্তেফাক (৭ই মার্চ, ২০১৫)
৪) নাসার আহমেদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত ব্লগ (https://nasarchoudhury.wordpress.com)
৫) অভিনয় কুমার দাশ সম্পাদিত সংকলন গ্রন্থঃ বঙ্গবন্ধু
৬) আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর – আবুল মনসুর আহমদ
৭) স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল-পত্র (দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ৭০৫-৭০৬)