বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা আসলেই কঠিন। তাঁকে ঘিরে এত এত আয়োজন আর আওয়ামী শোক বা উচ্ছ্বাসের কারণে চুপ থাকাটাই শ্রেয়। তাছাড়া একজন মানুষের জীবন ও আদর্শ ঠিকভাবে চেনা-জানা বা অনুসরণের বাইরে রেখে লেখালেখি মূলত মাতম। তবে এখন আবার এটাই দস্তুর। আওয়ামী লীগ যখন দেশশাসনে ছিল না, যখন ধারণা করা হয়েছিল যে, তারা আর কোনোদিন দেশ চালানোর সুযোগ পাবে না তখন রাজপথে তাদের শক্তি দেখেছি আমরা। সে শক্তির উৎস ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের তখনকার রাজনীতি একদিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আরেকদিকে বঙ্গবন্ধু দুয়ে মিলে হয়ে উঠেছিল আলোকবর্তিকা। আজ আর তা নেই।
কীভাবে কেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল সে ইতিহাস আমাদের সবার জানা। আমরা ধারণা করেছিলাম, আওয়ামী লীগ কখনও দেশশাসনে এলে প্রকৃত ঘটনা, প্রকৃত খুনী আর ইতিহাসের কথা জানা যাবে। বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল।
শেখ হাসিনার অকুতোভয় নেতৃত্বে খুনিদের বিচার হয়েছে, ফাঁসিও হয়েছে। এরপর বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে ‘একাত্তরের জল্লাদ’ নামে পরিচিত রাজাকারদের ফাঁসি হয়েছে। তফাৎ এই, এদের ফাঁসির পর কিছু কিছু মানুষের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখে গিয়েছে। তাদের শহীদ হিসেবে উল্লেখ করে ফলক লাগানোর ছবিও দেখেছি আমরা। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিষয়ে কেউ সহানুভূতি দেখিয়েছেন এমন ঘটনা ঘটেনি। কারণ ওই হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তীতে ৩ নভেম্বরের জেল-হত্যাকাণ্ডের পর দেশ যে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে সেটাই আজ যাবতীয় সমস্যার মূল কারণ। এই ঘটনা মানুষ বুঝতে পেরেছে। তারা এ-ও জানে, আগামী একশ বছরেও পদ্মাপাড়ে মুক্তিযুদ্ধের মতো কোনো বিশাল ঘটনা ঘটবে না। আর এ জাতিতে কোনো বঙ্গবন্ধুর জন্ম হবে না।
তার এই জানা বা বোঝা যে কতটা বাস্তব সেটা আমরা টের পেলেও বঙ্গবন্ধুর দল বোঝে না।
সময়ের সঙ্গে সব কিছু বদলায়, এটাই প্রকৃতি ও ইতিহাসের নিয়ম। আওয়ামী লীগকেও বদলাতে হবে বৈকি। কিন্তু এভাবে?
আজ আমরা দেখি আওয়ামী লীগে ত্যাগী নেতাদের মূল্য নেই। জাসদ বাসদ বা বাম নেতারা যারা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বলত না, যারা তাঁর মৃত্যুর পর লাশ বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিতে চেয়েছিল বা আনন্দে নেচেছিল তারাই মুখর। তারাই আজ আওয়ামী লীগের মাখনভোগী। আমি বলব, এ জন্যে দায়ী আওয়ামী লীগ। তাদের নেতারা সঠিক ইতিহাসের কথা বলেন না। তারা সত্যাশ্রয়ী হলে পঁচাত্তরের পর যাঁরা দলের হাল ধরেছিলেন তাদের কথা বলতেন।
তিনজনকে খুব মনে পড়ে। জোহরা তাজউদ্দীন, অাবদুর রাজ্জাক ও মিজানুর রহমান চৌধুরী। তখন বঙ্গবন্ধুর নাম বলাও পাপ। তাঁর দল বা চার নেতার কথা উচ্চারিত হলে কারাগার নিশ্চিত। মানুষ বরাবর এক ধরনের। তাদের মনে করিয়ে দিতে হয়। সেই কাজে নেমেছিলেন এঁরা। অাবদুর রাজ্জাক গর্জন করতেন। সন্ধ্যার মায়াবী অালোয় জোহরা তাজউদ্দীনের কান্না মানুষের চোখে জল এনে মাটি ভিজিয়ে দিত। মিজান চৌধুরীর বলা কবিতায় যখন ‘শিশুকে মেরেছ কেন’ উচ্চারিত হত বাঁধ ভেঙে পড়ত সবার ধৈর্যের। একটু একটু করে শোককে শক্তিতে পরিণত করেছিলেন এঁরা। না দল, না অামরা কেউ মূল্যায়ন করিনি এঁদের। কেউ মনেও রাখে না সে দিনগুলোর কথা।
তবু সেই দুঃখের দিনগুলোতেই খাঁটি মানুষ খাঁটি নেতা অার ত্যাগের মহিমা ছিল দেশে। আজ যারা বড় বড় কথা বলেন তারা সেদিন কাদের সিদ্দিকীর ভূমিকা পালন করেননি। আজ পথহারা কাদের সিদ্দিকী সেদিন একমাত্র নেতা যিনি ভারতে গিয়ে গেরিলা যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। জীবনের একটা বড় সময় তিনি এই ঘটনায় পিতার মৃত্যু মেনে নিয়ে মাংস খেতেন না। সেসব কি মিথ্যা?
আমরা কি ভুলে গেছি আওয়ামী লীগের সব বড় নেতাই মোশতাকের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেছিলেন? যাঁরা করেননি সেই চার নেতা বা তোফায়েল আহমেদরা কি দল থেকে তার স্বীকৃতি বা সম্মান পান আসলে? যেদিকে তাকাই শুধু মোসাহেবী আর স্তুতি। অথচ বঙ্গবন্ধুকে যারা জানেন তারা মানবেন তিনি এসব পছন্দ করতেন না।
আমাদের মনে আছে স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামের পোলো গ্রাউন্ড ময়দানের এক জনসভায় অকারণে মাইক আঁকড়ে তাঁর নামে স্লোগান দিতে থাকা এক সাংবাদিক তাঁর হুমকি বা ধমকের চোটে মাটিতে বসে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। এমন অজস্র ঘটনা আছে যেখানে তিনি এসব বিষয় তুচ্ছ করে দেখতেন। তবে দিলখোলা বলে অনেক আমানুষকেও প্রশ্রয় দিতেন– যেমন মোশতাক।
বিষয়টা খুব ভাবনার। আওয়ামী লীগ প্রচ্ছন্ন দুশমন বা ঘাতক হিসেবে জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে যতটা সোচ্চার মোশতাকের ব্যাপারে ততটাই নীরব। এর কারণ কী? মোশতাক গংদের ষড়যন্ত্র আর আমেরিকা পাকিস্তানের ইশারা ছাড়া কি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব ছিল? সে জায়গাগুলো লবিং, আন্তর্জাতিক প্রেসার বা দলীয় কারণে নিস্তেজ করে রাখলে ভবিষ্যত ছেড়ে কথা বলবে না।
মোশতাক এদেশের মীরজাফর। ঘরের শত্রু বিভীষণ। তাকে চিহ্নিত না করলে দলের ভেতরকার মোশতাকরা ধরে নেবে তারাও নিরাপদ। এটা কি তিনি দলের নেতা ছিলেন বলে ছাড় দেওয়া? অথচ এই মোশতাকই লিখিত ভাষণে খুনিদের ‘সূর্যসন্তান’ বলে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর শাসনভার গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগ চোখে ঠুলি পড়লেই এ সত্য মিলিয়ে যাবে না। যুগে যুগে কাছের মানুষরাই পারে দল বা দেশকে ডুবিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র সফল করতে। এটা স্বীকার করা মানে নিজেদের আগামীর পথ সুগম করা। বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তির জন্যও এটা জরুরি।
আজকাল এমন পরিবেশ সবাই আওয়ামী লীগ। যতদিন দলের হাতে শাসনভার ততদিন তারা দলকে ঘিরে, নেত্রীকে ঘিরে থাকবে। এভাবে তারা বঙ্গবন্ধুকেও ঘিরে রেখেছিল। যখন তিনি নেই এরাও আর নেই। সেই দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিবে এনেছিলেন এদেশের সুশীল সমাজ। বঙ্গবন্ধু পরিষদের ব্যানারে ঢাকা চট্টগ্রাম সিলেটসহ বড় বড় শহরের শোক মিছিলগুলো ছিল মানুষের ভরসা ও শক্তির উৎস। তাদের কথা কেউ বলে না। কেউ জানে না সামরিক শাসনের বেড়াজাল ভেঙ্গে কী করে তারা আন্দোলন করেছিলেন।
সংস্কৃতি ও শিল্পের সেই রুদ্ররুপ আজ উধাও। এখন নেতার নামে দালালি আর লঙ্গরখানা খুলে ভোজনের নামে বিরিয়ানি বিতরণের শোকানন্দ আমার মতো অনেকের কাছে ভয়ের ব্যাপার। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই কোলাহল বা চাপের কাছে সংস্কৃতি হার মেনেছে। সামনের দিনে প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়েছে।
এটা নিশ্চিত জানি তিনি অমর। আমাদের দেশের কোনো নেতা কোনো শক্তির সাধ্য নেই তাঁকে অপমান করে টিকে থাকে। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের কাল কেক-কাটা। ভুয়া জন্মদিন পালন করে তিনি মানুষের মনে যে ঘৃণার জন্ম দিয়েছেন তার মাশুল দিতে হচ্ছে তাঁকে। দলও প্রায় শেষের পথে। অথচ তাদের রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরী বা আবদুর রহমান বিশ্বাস কৌশলে বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিয়ে টিকে গিয়েছিলেন।
এসব সত্য জানার পরও আওয়ামী লীগ মানে না। তাদের মাতমে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি রক্ত টগবগ করানোর শক্তি হারাতে বসেছে। তাদের অতিউৎসাহে বঙ্গবন্ধুকে মনে মনে ভালোবাসার বাইরে আর কিছু করার উৎসাহ হারাচ্ছে মানুষ। অথচ কত কাজ বাকি। তাঁর আন্তর্জাতিক ইমেজ তাঁকে নিয়ে গবেষণা এসব এখনও অধরা। টাকা-পয়সা বানানোর ধান্দায় যা শুরু হয় তা আর শেষ হয় না।
আর একটা কথা মানতেই হবে, তিনি জাতির জনক। তিনি সবার। সে কারণে শুধু আওয়ামী লীগের মাতমে তিনি থাকবেন আর কারও অধিকার নেই এটা মানা যায় না। এই বাংলাদেশের শ্যামল মাটি তাঁর রক্তধারায় ভিজে যাওয়া পবিত্র মাটি। আমি জানি রাত ঘন হলে আগস্টের মায়াময় দেশে তিনি নীরবে এসে দাঁড়ান। কেউ তাঁকে দেখে না বটে তিনি সব দেখেন। তিনি জানেন কে কেন কী করছে। হয়তো বজ্রকণ্ঠে আর একবার বলার জন্য মুখিয়ে থাকেন, ‘যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে’।
বাংলাদেশের তারুণ্যর জানা দরকার উপমহাদেশে এমন নেতা আগে আসেননি। সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা সহজ জীবনের বড় মানুষ বঙ্গবন্ধুকে আমরা যেন দলের বেড়াজালে, সাম্প্রদায়িকতায় বা কোনো ষড়যন্ত্রে ছোট না করি। তিনি না থাকলে ইতিহাস ঘোর অন্ধকার। আর এটাও মানতে হবে যে, তিনি সূর্য, বাকিরা ছিলেন চাঁদ-তারা– যাঁরা সবাই মিলে আমাদের আকাশ। এখন যা দেখছি তাতে আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালি রবীন্দ্রনাথের একটি গানের লাইন মনে পড়ছে:
তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে কোলাহল।
জয়তু বঙ্গবন্ধু।
১৫ আগস্ট কাদের সিদ্দিকী খন্দকার মোশতাক আহমেদ জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন
অজয় দাশগুপ্তকলামিস্ট।