শুক্রবার পনেরো আগস্ট, ১৯৭৫ সাল। ভোর না হতেই হঠাৎ গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। একটানা গুলি। ঘরের জানালা কেঁপে উঠলো। একাত্তরের কথা মনে পড়ে গেলো। তাড়াহুড়ো করে উঠে সবাইকে ডাকলাম।
আমি তখন ধানমন্ডিতে মায়ের বাসায় ছিলাম। হঠাৎ এতো গোলাগুলির শব্দ কেন ? আমার ছোট ভাই বলল বঙ্গবন্ধুর আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাবার কথা। সেখানে কোন রিহার্সাল হতে পারে।
আমি বললাম, তাই বলে একাত্তরের মত গোলাগুলি হবে। আমার স্বামী বললেন, রেডিও আনো। রেডিও খুললে সব জানা যাবে। গুলির শব্দ শুনে আমরা সবাই তখন ঘরের মেঝেতে বসে বসে কথা বলছি। ঘুম কারো চোখে নেই। একটা আতংক সবার মনে, আবার কী হলো ? আবার কী হতে পারে? দেশ তো স্বাধীন। আবার কোন শত্রুরা এলো? মাত্র তো দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন আবার কারা দেশের বিরুদ্ধে লাগলো?
আমি উঠে গিয়ে রেডিও নিয়ে এলাম। রেডিওর নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম, কোথাও কিছু শোনা যায় যদি। ঢাকা কেন্দ্র চালু হবে ছয়টায়। ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ পেলাম ভয়েস অব আমেরিকা। সেখানেই প্রথম শুনলাম বাংলাদেশে ক্যূ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। তারপর পেলাম ঢাকা বেতার কেন্দ্র। একজন কর্কশ কণ্ঠে দম্ভ ভরে বলে উঠলো, আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।
তারপর তারা সামরিক শাসন জারীর ফরমান শোনাল। কারফিউ ঘোষণার কথা শোনাল। একথা শোনায় স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। যে নেতা সারা জীবন সংগ্রাম করলেন, কারাজীবন ভোগ করলেন ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিলেন, বাঙালির স্বাধীকারের জন্য পাকিস্তানের শাসকদেরকে উচিত কথা বলতে ছাড়েন নি তাকে আমরা বাঙালিরাই হত্যা করলাম? তিনি আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছেন, বাঙালি জাতি হিসেবে বিশ্বে আমরা বীরের মর্যাদা পেয়েছি, বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন আজ বাস্তবায়ন হয়েছে, নানা সমস্যা, অভাব ও সংকটের মধ্য দিয়ে তো দেশ এগিয়ে চলেছে, সর্বত্র দেশ গড়ার আবেদন চলেছে। একদিন দেশ তো উন্নত হবে, ঘরে ঘরে শান্তি আসবে। বিপ্লব ও স্বাধীনতার পর সংকট তো থাকবেই। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা তো ষড়যন্ত্র করবেই। তাই বলে জাতির পিতাকে হত্যা করা হবে? এ মেনে নেয়া যায় না। এই ভাগ্যাহত জাতির কোন ভবিষ্যৎ নেই।
বেতারে ঐ কর্কশ কণ্ঠ সারাদিন বাজলো। বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান, ভারত শুনলাম সারাদিন। আমার স্বামী তার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে খবর নিলেন। আজ তো বাইরে যাওয়া নিষেধ। কোন খবরই এখন পাওয়া যাবে না। বিকেলের মধ্যে খবর পাওয়া গেল ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকে একদল সৈন্য ইচ্ছেমতো গুলি ছুড়ে হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধুকে। তার স্ত্রী, তিন ছেলে কামাল, জামাল, রাসেল ও দুই পুত্রবধুও নিহত হয়েছে। শেখ মনির বাসায়, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতির বাসায় গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়েছে। অনেকে আহত হয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গেছে। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে হাসিনা ও রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে গেছে।
আমাদের কুড়ি নম্বর রোডের ওপর কোন গাড়ি চললো না। পাশে সাতমসজিদ সড়কে আর্মীর ভাড়ী ট্রাক চলাচলের শব্দ পেলাম।
সন্ধ্যায় টেলিভিশনে বাসসের বরাতে খবর দেয়া হলো সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে তার গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করা হয়েছে।
আমার দু’চোখ কান্নায় ভরে উঠলো। অনেকক্ষণ কাঁদলাম। কী দূর্ভাগ্য আমাদের। জাতি আজ পিতৃহীন হলো। বাঙালির আর কোন নেতা রইলো না।
হাজার বছর কি অপেক্ষা করতে হবে আর একজন মুজিবের জন্য? এই হত্যার বিচারও কি হবে? তার দুই কন্যাকে সান্তনা দেবার জন্য মা-ভাইদেরও থাকতে দেয়া হলো না। ছোট্ট রাসেলকে তো বাঁচতে দিতে পারতো। সে তো রাজনীতিই বোঝে না। পরদিন খবরের কাগজ এলো, বঙ্গবন্ধুর দাফনের খবর ছোট্ট করে ছাপা হয়েছে। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে গান বাজানো হচ্ছিল। মোশতাক রাষ্ট্রপতি হলো। সে ছিলো খুনীদের পৃষ্ঠপোষক। দেশজুড়ে তখন এক থমথমে অন্ধকার নেমেছে।
বেবী মওদুদ: লেখক ও সাংবাদিক।