১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ নিরীহ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানকে যারা হত্যা করেছিল তারা হল রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসসহ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী দল। এদের পিছনে ছিল পাকিস্তানের সামরিক পোশাক পরা হানাদার বাহিনী। আর তাদেরও পিছনে ছিল আমেরিকা এবং চীন। আর এত বছর পর তারা ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে জামায়াত, জেএমবি ইত্যাদি নামে। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবার এবং সহকর্মীদের সঙ্গে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে। তাঁর মন্ত্রিসভার একাধিক নেতাকেও হত্যা করা হয়।
১৫ আগস্ট ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবসের ছুটি। তাই ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার কোনো খবর কাগজে ছাপা হয়নি। ১৭ আগস্ট কলকাতার মানুষ খবরের কাগজের পাতায় খবরটি দেখতে পান। অবশ্য তার আগেই কলকাতাসহ গোটা পৃথিবী জেনে গিয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর নেই। ক্ষমতা দখল করেছে সামরিক বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিল কর্নেল জিয়াউর রহমান এবং মুজিবের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। এসব তো ইতিহাস।
মুজিব হত্যার পর এদেশে প্রথম শোকসভাটি হয় দিল্লিতে। তাঁর বন্ধু ইন্দিরা গান্ধী সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে শোকসভা করেছিলেন। সেই শোকসভায় ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, “শেখ মুজিব সোনার বাংলা গড়ে তোলার এবং উপ-মহাদেশে শক্তি ও সম্প্রীতি স্থাপনের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। সেখানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব তাঁর পরিবারের লোকজন এবং তাঁর কিছু সহকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। শেখ সাহেব গোটা বিশ্বেই মহান জাতীয় নেতা বলে পরিচিত।
“তিনি দুর্দমনীয় সাহস এবং কঠোর সঙ্কল্প নিয়ে তাঁর জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভারতের জনগণ তাঁকে উপ-মহাদেশের শুভেচ্ছা ও সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তোলার কাজে অগ্রণী মানুষ হিসাবে শ্রদ্ধা করে।”
ঐ শোকসভায় জনসঙ্ঘ ছাড়া (বর্তমান বিজেপি) প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতাই শেখ সাহেবের স্মৃতি-তর্পণ করেন।
১৫ আগস্ট ছিল রবিবার। তার ২৪ ঘন্টা আগেই ‘ইনশাল্লাহ’ বলে ফানুসটি ছাড়লেন জিয়া। জঙ্গি পোশাকের ওপরই গণতন্ত্রের ছাপমারা আলখাল্লা চাপিয়ে বাইরে এসে ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র কায়েম করতে নতুন দলের অভ্যুদয় হল। এটা হল সামরিক আর সাধারণ মানুষের মিলজুল মোর্চা। ১৯৭৭ সালে হঠাৎই গণতন্ত্রের বাঁশিতে ফুঁ দিলেন জিয়া। পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমূল্যে যে মুক্তি অর্জন করেছিল, বারেবারে সন্ত্রাসে, হত্যায় তা অবলুন্ঠিত। মানুষ রুদ্ধশ্বাস, মাটি রক্তাক্ত। তবুও বাংলাদেশের প্রাণসত্তা নিঃশেষ হচ্ছে না। শেখ মুজিব হত্যার পর থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘটনার দিকে শ্যেন দৃষ্টি রাখছিলেন জিয়া। তিনি বুঝতে পারছিলেন, ঐ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা তাঁকে রাখতে হলে গণতন্ত্রের সঙ্গে ডিকটেটরশিপের মতো চির-বিরোধী দুই মেরুর ‘নিকাহ্’ ঘটাতে হবে।
একদিন আগেই প্রধান সহকারী সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে এম জি মেহমুদ এসে জেনারেলের নয়া মোর্চার সম্পাদক হলেন। শুরু হল বাংলাদেশে জিয়া-মার্কা গণতন্ত্রের। স্যাঙ্গাতরা বলল, মার-হাব্বা। কিন্তু গর্জে উঠলেন বেগম জোহরা তাজউদ্দীন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মন্ত্রী।
তাঁর বন্ধু ইন্দিরা গান্ধী সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে শোকসভা করেছিলেন
তিনি বললেন, ওটা জঙ্গিবাদীদের পার্টি, খুনিদের দল। তিনি চাইলেন নির্বাচন। সেটা তাঁর একক কণ্ঠস্বর ছিল না। আইয়ুব মন্ত্রিসভার প্রাক্তন সদস্য মুসলিম লীগ নেতা খান আবদুস সবুর খান ওদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবকে যে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, সে কথা কেউ ভোলেনি। সকলেই বললেন– স্বেচ্ছায় যদি গদি না ছাড়, তাহলে এই নিরস্ত্র জনতাই তোমাদের টেনে নামাবে।
সবুর খানের এই হুঁশিয়ারি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কারণ, কেবল বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারকেই হত্যা করা হয়নি। ছাড়খাড় করে দেওয়া হয়েছিল শত শত পরিবারকে। এমনকি সামারিক অফিসারদের পর্যন্ত খতম করে দেওয়া হয়েছিল। আর আশ্চর্যজনকভাবে মুজিব হত্যার পরবর্তীকালে ঘটনাপ্রবাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদার দাক্ষিণ্য জুগিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় প্রশ্ন ওঠে, তাহলে মুজিব হত্যার পিছনে কি কোনো বিদেশি শক্তিই ছিল? থাকলে তারা কারা?
এই সময় একটা ফিকির ফাঁদলেন জিয়া সাহেব। তিনি যে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী, তেমন একটা চোহারা খোলতাই করতে হঠাৎ গেলেন নেপাল সফরে। তাঁর এই সফরের পেছনে দুটো উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, নিজের দেশকে ধোঁকা দেওয়া– ‘দেখছ তো নেপাল আমার ডিকটেটরশিপের পক্ষে’। দ্বিতীয়টা একটা উপরি মুনাফার খোয়াব।
ভারত সম্পর্কে নেপালের খুঁতখুতানি তখনও যায়নি। এই সফরের চালে ভারত থেকেও বেশি সুযোগ-সুবিধা হাতানো যেতে পারে, এটাই ছিল জিয়ার উদ্দেশ্য। তারপর ১৯৮০ সালে তিনি এলেন দিল্লিতে। দিল্লির আমন্ত্রণ পাওয়ার জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের ধরাধরি করেন। সোভিয়েতের অনুরোধেই ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে ভারতে আসার আমন্ত্রণ পাঠান। জিয়াকে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে নৈশভোজে অ্যাপ্যায়িত করেন ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা ছাড়াও কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।
ঐ সভার ছিলেন ইন্দিরা মন্ত্রিসভার প্রবীণ মন্ত্রী বরকত গনি খান চৌধুরীও। তিনি যাওয়ার আগে আমাদের বলেছিলেন, ‘আপনারা বসুন, আমি জিয়ার সঙ্গে বসব না। আমি এখনই ফিরে আসছি।’
ফিরে এসে বরকত সাহেব কলকাতার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ইন্দিরা তাঁর সঙ্গে জিয়ার পরিচয় করাতেই জিয়া তাঁকে করমর্দন করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। বরকত তাঁর সঙ্গে করমর্দন করেননি। তখন জিয়া তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, নির্বাচন করা খুব কঠিন কাজ। বরকত তাঁকে পাল্টা বলেন, ‘আপনি তো সামরিক পোশাক পরে নির্বাচন করেছেন। এভাবে গণতন্ত্র হয় নাকি? আমাদের মতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট করান। আর তাছাড়া আপনি মুজিব হত্যাকারী। আপনি প্রধানমন্ত্রীকে যা-ই বোঝান, আমি আপনাকে মানি না।’
একথা বলে না খেয়েই ঐ ভোজসভা থেকে চলে আসেন বরকত গনি খান চৌধুরী।
মুজিব হত্যার এক বছর পরই জিয়া জাতিসংঘে ফারাক্কার পানিবন্টন নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন। বাংলাদেশের ঐ অভিযোগের উত্তর দেওয়ার জন্য তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী এই বরকতকেই পাঠিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রায় ৫৬ দিন রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দপ্তরে বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতাকে ফারাক্কার গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার আগেই ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। আর সেই সঙ্গে ছিল সংবাদমাধ্যমের ওপর সেনসরশিপ। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কলকাতার মিডিয়া যেভাবে প্রচার করতে চেয়েছিল তা আসলে করা যায়নি। কারণ তখন সংবাদ লিখে তা ‘পাস’ করিয়ে আনতে হত রাইটার্স রিল্ডিং থেকে। সেখানে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের কড়া নির্দেশ ছিল, বাংলাদেশ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা যাবে না।
শেখ মুজিব হত্যার পর থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘটনার দিকে শ্যেন দৃষ্টি রাখছিলেন জিয়া
আগস্ট মাসের ২০/২১ তারিখে আমাদের সম্পাদক স্থির করলেন, আমি, আমার এক সহকর্মী ও একজন চিত্রসাংবাদিক ঢাকায় যাব পরিস্থিতি রিপোর্ট করতে। সব জায়গাতেই গুপ্তচর থাকে। আমাদের অফিসের এক গুপ্তচর এই খবরটি সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে জানিয়ে দেয়। সেদিন রাতেই আমার দুই সহকর্মীর গাড়িতে পুলিশ আসে পাসপোর্ট সিজ করতে। কিন্তু আমরা পাসপোর্ট দিইনি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের দ্বিতীয় হাইকমিশনার প্রবীন কূটনীতিক শমর সেন কলকাতায় ছিলেন পারিবারিক কাজে। ১৫ তারিখই তাঁর ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। সেদিনই তিনি ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তাঁর বাড়িতে একটি পার্টির আয়োজন করেছিলেন। রেডিওর মাধ্যমে তিনি খবর পেয়েছিলেন, জিয়া-খোন্দকার জুটি ক্ষমতা দখল করেই ভারতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছেন। শুধু বিমান নয়, সড়কপথেও তিনদিন যাতায়াত বন্ধ ছিল।
সেদিন কলকাতায় খুব ঝড়জল চলছে। ১৭ তারিখ খোন্দকার মোশতাক আহমেদ সমর সেনকে ফোন করে বলেন, ‘আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন।’
তিনদিন পর তিনি সড়কপথে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পেট্রাপোল সীমান্তে আমি তার আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। সীমান্তে দাঁড়িয়ে সমর বাবু বললেন, খোন্দকার তাঁকে ফোন করেছিলেন।
সন্ধের দিকে ঢাকায় পৌঁছে তিনি যান রাষ্ট্রপতি ভবনে। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন জিয়া, খোন্দকার ও আরও কয়েকজন অফিসার। তারা বলেন, এই নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিক ভারত। জবাবে সমর সেন তাঁদের বলেছিলেন, ‘আপনারা ক্ষমতা দখল করেই ইন্দিরা-মুজিবের যাবতীয় চুক্তি বাতিল করেছেন কেন? তাই আমাদের ভাবতে হবে আপনাদের স্বীকৃতি দেওয়া যাবে কি না।’
এক অফিসার বলেন, ‘আমেরিকা আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে।’
জবাবে সমর বাবু বলেন, ‘আমেরিকা আপনাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল।’
এরপর একটু নরম হয়ে জিয়া বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি মেনে চলবে।’
কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে সমর সেন বলেছিলেন, ‘আগে আপনারা লিখিতভাবে সে কথা জানান। তারপর আমি দিল্লির সঙ্গে কথা বলব ‘
আবার ঘুরে এসেছে ১৫ আগস্ট। আমাদের মতো প্রবীণদের মনে ফিরে আসছে সেদিনের স্মৃতি। তার আগের নয় মাস আমরা মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছি। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এখন সেই দিনের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। আগেই উল্লেখ করেছি সিঁদুরে মেঘের কথা। আর পোশাক-নাম-চরিত্র বদল করা আল বদর, আল শামসদের কথা।
১৫ই আগস্ট জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
সুখরঞ্জন দাশগুপ্তআনন্দবাজার পত্রিকার সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি; কলামিস্ট