স্বাধীনতার অখণ্ডিত ইতিহাস ভবিষ্যতের পাথেয়

বাংলাদেশের কিছু রাজনীতিবিদ তাদের বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হতে আমার লেখা ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা-সম্পর্কিত কিছু অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন তার প্রেক্ষিতে এই লেখার অবতারণা।

এ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে জর্জ অরওয়েলের লেখার কথা মনে পড়ছে। তিনি আমার প্রিয় লেখকদের অন্যতম। তাঁর লেখা রাজনৈতিক স্যাটায়্যার-সমৃদ্ধ উপন্যাস বিশেষত Animal Farm এবং 1984 কালোত্তীর্ণতা লাভ করেছে। অনেক যুগের অবসান, প্রাযুক্তিক উন্নতি ও আর্থ-সামাজিক- রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও, তাঁর লেখার সঙ্গে বর্তমান বিশ্বের বহু একনায়কতন্ত্রী রাজনীতি ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা পদ্ধতি– যার কঠোর সমালোচনা তিনি করেছিলেন– তাদের অসামান্য মিল পরিলক্ষিত হয়।

১৯৪৫ সালে প্রকাশিত Animal Farm বইটিতে বিভিন্ন পশুপাখির চরিত্রের মধ্যে দিয়ে একনায়কবাদী, বাকস্বাধীনতা হরণকারী ও সত্যকে নিষ্ঠুরভাবে দমনকারী সমাজের ভয়াবহ চিত্রটি তিনি উপস্থাপিত করেন।

১৯৪৯ সালে প্রকাশিত 1984 বইটিতে তিনি যেন অনেকটা ভবিষ্যদ্বাণীর মতোই বর্ণনা করেন এমন এক বিশ্বের চিত্র যেখানে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হবে মুষ্টিমেয় সম্পদ লুণ্ঠন ও ভোগকারীদের (globalization?) হাতে; যে সমাজে নিজ নিজ স্বার্থরক্ষাকারী অসৎ রাজনীতিবিদ ও তাদের তল্পিবাহক সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীরা জনগণকে বোঝাতে সচেষ্ট হবে যে, দুয়ে দুয়ে পাঁচ। শঠতা ও চাতুর্যের সঙ্গে তারা দিনকে রাত ও রাতকে দিন বানাবার চেষ্টা করবে। তারা যুদ্ধকে শান্তি, স্বাধীনতাকে দাসত্ব এবং মূর্খতাকে বলবে শক্তি। তারা মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করবে।

এ প্রসঙ্গে অরওয়েল লেখেন–

Who controls the past, controls the future, who controls the present, controls the past.

[1984]

অন্যত্র তিনি লেখেন–

The most effective way to destroy people is to deny and obliterate their own understanding of their history.

আমার লেখা ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ বইটি, যার কিছু ঐতিহাসিক প্রসঙ্গকে ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও রাজনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য যেসব রাজনীতিবিদ খণ্ডিতভাবে উপস্থাপিত করছেন এবং তাদের প্রতিপক্ষ যারা আমার বইটি সম্পূর্ণ না পড়েই অথবা বইয়ে উল্লিখিত বিবরণ সত্য হলেও তার মধ্যে কিছু অংশ তাদের পছন্দনীয় না হওয়াতে, তারা কোনো যুক্তি-বুদ্ধির অবতারণা না ঘটিয়ে, তথ্যে কোথায় ভুল তার উল্লেখ না করে, তারা এই লেখকের বিরুদ্ধে যে অশালীন, নির্লজ্জ মিথ্যা প্রচারণা ও ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়েছেন তা জর্জ অরওয়েলের বই দুইটিতে বর্ণিত সেই তমসাছন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

সম্প্রতি বিএনপি সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জামালপুরের জনসভায় (২৭ সেপ্টেম্বর,, ২০১৪) ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ বইটি হতে আমার লেখার উদ্ধৃতি [৫৯-৬০ পৃষ্ঠা] দিয়ে বলেছেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে এনেছিলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেননি। তিনি সচেষ্ট থাকেন এই কথা প্রমাণ করতে যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।
তিনি সচেষ্ট থাকেন এই কথা প্রমাণ করতে যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি
তিনি সচেষ্ট থাকেন এই কথা প্রমাণ করতে যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি
ভিডিও বক্তব্যের লিংক–

http://www.youtube.com/watch?v=eOev2douY3o

বক্তব্যে তিনি অনুল্লিখিত রাখেন আমার বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে উল্লিখিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাকি অংশগুলির বর্ণনা। বঙ্গবন্ধু আমার বাবা বা দলকে স্বাধীনতা ঘোষণা না দিলেও তিনি যে ভিন্ন মাধ্যমে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন তা তথ্য এবং সাক্ষাৎকারসহ আমার বইতে স্পষ্ট উল্লিখিত।

[১৪৭-১৪৮, ২৭৪-২৯১, ৩০১-৩১০ পৃষ্ঠা]

বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন তার একমাত্র জীবিত সাক্ষী, বঙ্গবন্ধুর পারসোনাল এইড হাজী গোলাম মোরশেদ, যিনি ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন হতে গ্রেফতার হন, তাঁর এবং প্রকৌশলী শহীদ নুরুল হক যিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে খুলনা হতে ট্রান্সমিটার এনেছিলেন ঘোষণা দেবার জন্য, ওনার স্ত্রীর সাক্ষাৎকার আমার বইতেই প্রথম ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে।

বইতে আরও উল্লিখিত যে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ২৬ মার্চ দুপুরে এবং সেই সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন [১৪৭ পৃষ্ঠা] এবং ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে পরবর্তী ঘোষণা দেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান [৭১ ও ১৪৭ পৃষ্ঠা] ।

আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার যা বইতে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকারে উদ্ধৃত হয়েছে তা হল–

“অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। অতএব ঐ দিন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা কার্যকরী হবে।’’

[২৬১ পৃষ্ঠা]

গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচিত হয় বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তিতে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে ১০ এপ্রিলের বেতার ভাষণে উল্লেখ করেন–

“২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরোধ করবার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।”

[বইয়ের ৩৯৭ পৃষ্ঠায় ১০ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনের দিনটিতে তাজউদ্দীন আহমদের সম্পূর্ণ ভাষণ উল্লিখিত হয়েছে]

বেগম জিয়া তার সেদিনের বক্তব্যে আরও বলেন–

“জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা না দিলে দেশ স্বাধীন হত না। শেখ সাহেব জেল থেকে বের হত কিনা সেটাও সন্দেহ ছিল।”

তার এই বক্তব্য ইতিহাস-নির্ভর নয়। এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করে তখন জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারও স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য তারা অপেক্ষা করেনি। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা নিঃসন্দেহে জনগণের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু বিশ্ব ইতিহাস এটাই বলে যে, স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেই তো একটি দেশ স্বাধীন হয়ে যায় না। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ধাপে ধাপে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়ে স্বাধীনতার দুয়ারে পৌঁছেছিল দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ফলে।

[৭১ পৃষ্ঠা]

স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন ছিল সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব যা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সহকর্মীরা দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান ও তার সহযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন সেই বেসামরিক প্রথম বাংলাদেশ সরকারের সফল নেতৃত্বেই। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছিলেন মূলত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও একই সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঐকান্তিক কূটনৈতিক এবং সামরিক কৌশল ও কর্মতৎপরতার জন্য। তাজউদ্দীন আহমদ জানতেন যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সাফল্যের ওপরেই নির্ভর করবে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি।

[১১৫, ১১৭-১১৮ পৃষ্ঠা]

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অবিসংবাদিত নেতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপামর জনগণের জন্য স্বাধীনতার প্রেরণা ও প্রতীক এবং তাঁর আজীবনের বিশ্বস্ত সহকর্মী, দূরদর্শী নেতা ও সুদক্ষ প্রশাসক তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন স্বাধীনতার সফল বাস্তবায়ক, এই সত্যটি দলমত নির্বিশেষে সকলকেই মেনে নিতে হবে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের স্বাধীনতার প্রেরণা ও প্রতীক, তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন স্বাধীনতার সফল বাস্তবায়ক, এই সত্য দলমত নির্বিশেষে সকলকেই মেনে নিতে হবে
বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের স্বাধীনতার প্রেরণা ও প্রতীক, তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন স্বাধীনতার সফল বাস্তবায়ক, এই সত্য দলমত নির্বিশেষে সকলকেই মেনে নিতে হবে
আমি বইতে উল্লেখ করেছি–

“তারা ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক। মুজিব বাদে তাজউদ্দীনের ইতিহাস যেমন অসম্পূর্ণ তেমনি তাজউদ্দীন বাদে মুজিবের।”

[১৯৩ পৃষ্ঠা]

বাংলাদেশের নিজস্ব প্রয়োজনেই এই সত্য একদিন ইতিহাসে স্থান পাবে।

স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ এই অসাধারণ জুটির মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছেদ না হলেও আদর্শিক বিচ্ছেদ ঘটেছিল যার কারণ ও জাতির জন্য তার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আমার বইয়ে উল্লিখিত হয়েছে। আমি সেই প্রেক্ষিতে যুক্তি-তথ্যর আলোকে ঘটনাগুলি তুলে ধরার আন্তরিক চেষ্টা করেছি।

ভালো-মন্দ সব নিয়েই তো ইতিহাস গড়ে ওঠে। ইতিহাস যত সুস্পষ্ট হবে এবং অখণ্ডিত আকারে সুরক্ষিত হবে, নতুন প্রজন্মের জন্য ততই সহজ হবে ভবিষ্যতের সঠিক পথটি খুঁজে নেবার। রাষ্ট্রের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং তাদের অন্ধ স্তাবক ও অনুসারীরা যখন যার যার ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সুবিধার জায়গা থেকে ইতিহাস খণ্ডিতভাবে উপস্থাপিত করার অপপ্রয়াস নেন, তখন ইতিহাসে যে বিশাল ফাঁক সৃষ্টি হয় তার মধ্যে ঢুকে পড়ে নানা আবর্জনা, বিভ্রান্তি ও অসত্য। সেই ফাঁকের সুযোগে ইতিহাসে যার যে স্থান প্রাপ্য নয় তারা সেই স্থানটি দখলে তৎপর হয়ে উঠেন।

একটি জাতি তখনই সত্যিকারের অগ্রগতি লাভ করে যখন সে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে ইতিহাস জানার আন্তরিক প্রয়াস নেয়, অখণ্ডিতভাবে ইতিহাস সংরক্ষণ ও উপস্থাপন করে। সততা ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে, নির্মোহ চিত্তে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস যাচাই বাছাই করে দেখার ক্ষমতাসম্পন্ন জাতির পক্ষেই সম্ভব ইতিহাসের সঙ্গে চলা; একটি সবল ও সুন্দর রাষ্ট্রের গর্বিত প্রতিনিধি হওয়া।

শারমিন আহমদ: শিক্ষাবিদ ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা।

SUMMARY

1340-1.jpg