অন্য এক শেখ মুজিব


দেশ শাসনের দায়িত্বভার বহনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অশুভ শক্তি অত্যন্ত নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে। জাতির ললাটে পড়ে দুরপনেয় কলঙ্কতিলক। শেখ মুজিবুর রহমান এক বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ‘ব্যক্তি’ হচ্ছে চৌহদ্দিভুক্ত একটা জীব। কিন্তু ‘মানুষ’ ব্যক্তি নয়, ব্যক্তির মধ্যেই লুকানো একটি সত্তা। সেখান থেকে তাকে খুঁজে বের করা খুব সহজ কাজ নয়।
সালটি ১৯৭২। আমাদের মহান স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর ১৬ জুলাই অনুষ্ঠিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি করা হয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অনুষ্ঠানে ভাষণদানের পর জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে ফিরে যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে থামেন। তার উদ্দেশ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জায়গা কতটা সুচারুভাবে কাজে লাগানো যায় তা দেখা। পূর্ত ও গৃহনির্মাণমন্ত্রী মতিউর রহমান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই ছিলেন। এর আগে বেশ ভারি বৃষ্টি হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু যখন তার গাড়ির অদূরে দাঁড়িয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন লক্ষ্য করলেন কয়েকটি গা-উদোম ছেলে তার গাড়িটিকে ঘিরে মনের মতো করে খেলা শুরু করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু কর্দমাক্ত ছেলেগুলোকে সস্নেহে কাছে ডেকে আনেন এবং পকেট থেকে বের করে একশ’ টাকা দেন জামাকাপড় কেনার জন্য। উৎফুল্ল ছেলেগুলো বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বঙ্গবন্ধুর গাড়িটি সেখান থেকে চলতে শুরু করে।
ঘটনাটি বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষদিকের। ১৯৭৫ সালের ২৭ জুলাই। বঙ্গবন্ধু প্রতিদিনের মতো সন্ধ্যায় গণভবন চত্বরে একাকী পায়চারি করছিলেন। হঠাৎ তার নজর পড়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি কক্ষের প্রতি। রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও সেখানে মৃদু আলো জ্বলছে। বঙ্গবন্ধু সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পান একটি লোক একাগ্রচিত্তে কাজ করে চলেছেন। লোকটির গায়ে জামা নেই। তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন, কর্মব্যস্ত ব্যক্তিটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন সাধারণ কর্মচারী, নাম আবদুল জলিল। অনেক জরুরি কাজ থাকায় ছুটির দিনেও তিনি একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। কৌতূহলী বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করে আরও জানতে পারেন, যাতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ না হয় সেজন্য তিনি কক্ষের দুটি বাল্বের মধ্যে একটি জ্বালিয়ে এবং বৈদ্যুতিক পাখার পরিবর্তে খালি গায়ে জানালা দিয়ে আসা বাইরের মুক্ত বাতাসে কাজ করছেন। আবদুল জলিলের কর্তব্যনিষ্ঠা ও মনমানসিকতায় তিনি মুগ্ধ হন এবং সঙ্গে সঙ্গে তার পদোন্নতির নির্দেশ দেন। এছাড়া পকেট থেকে তাকে পাঁচশ’ টাকা প্রদান করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার কথা ছিল। এর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ ডিগ্রিতে ভূষিত করার একটি প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। ২৬ জুলাই, ১৯৭৫ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে এটি গ্রহণ করা অনুচিত হবে বলে বঙ্গবন্ধু মনে করেন। একইসঙ্গে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতির জন্য তার সহানুভূতি ও সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
স্বাধীনতার পর সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের আবাসিক সরকারি ভবন ‘গভর্নর হাউস’ বা ‘লাট ভবন’টিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বাসভবন বা বঙ্গভবন বলে ঘোষণা করা হয়। আর রমনা গ্রিনে অবস্থিত ‘প্রেসিডেন্ট হাউসের’ নতুন নামকরণ করা হয় ‘গণভবন’। ষাটের দশকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন হিসেবে ব্যবহৃত প্রেসিডেন্ট হাউসেই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হয়। এ গণভবনটিকেই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন বলে স্থির করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসেই মনস্থির করেন, তিনি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে নিজ বাড়িতে বসবাস করবেন; সরকারি বাড়িতে থাকবেন না। যে কথা সেই কাজ। ১৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ সরকারিভাবে তা জানিয়ে দেয়া হয়। তবে রমনা গ্রিনের ওই বাড়ি অর্থাৎ গণভবন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
কোনো দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সরকারি বাড়িতে না থাকার উদাহরণ খুবই বিরল। তখনই জানা গিয়েছিল, একমাত্র মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সরকারি বাসভবনে অবস্থান করেননি। আরেক উদাহরণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি জীবনের শেষদিনটিও কাটিয়েছেন নিজের অতি সাধারণ একটি বাসভবনে।
ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এক অনন্য ইতিহাস রচিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে ডাকসুর আজীবন সদস্য করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে তার প্রথম জন্মদিন পালন উপলক্ষে ১৭ মার্চ, ১৯৭২ ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে ডাকসু সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যৌথ ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর এ বিরল সম্মানের কথা জানান। ছাত্র সদস্য ছাড়া কোনো নাগরিককে আজীবন সদস্যপদের সম্মানে ভূষিত করা ডাকসুর ইতিহাসে এই প্রথম।
১৯৭২ সালের জুলাই মাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স শেষ বর্ষ এবং মাস্টার্স প্রথম পর্বের কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী তাদের অটোপ্রমোশন দেয়ার দাবি জানান। কর্তৃপক্ষ রাজি না হওয়ায় তারা আন্দোলন শুরু করেন। তাদের যুক্তি, টানা ৯ মাসের যুদ্ধের কারণে পড়াশোনা হয়নি। কেউ কেউ আবার সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। কাজেই তারা পরীক্ষা দিতে পারবেন না। তাদের অটোপ্রমোশন দিতে হবে। অটোপ্রমোশনের দাবিদাররা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল, অবরোধ ও সমাবেশ করতে থাকে। ১৮ জুলাই ডাকসুর উদ্যোগে টিএসসিতে এক ছাত্রসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ডাকসু নেতারা অটোপ্রমোশনের বিষয়টিকে আত্মঘাতী বলে অভিহিত করে এ ধরনের অযৌক্তিক দাবি থেকে শিক্ষার্থীদের সরে আসার আহ্বান জানান। পরদিন টিএসসিতেই শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অন্য এক যৌথসভায় উপাচার্য অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরীও একই বক্তব্য দেন এবং আন্দোলনের পথ পরিহার করে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। এদিকে আন্দোলনকারীরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২০ জুলাই বেলা ১১টায় তারা বটতলায় সভা করে। সভাশেষে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে মিছিল সহকারে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে তার কার্যালয়ে যায় এবং কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়াই ১ আগস্ট থেকে শেষ বর্ষে তাদের ক্লাস শুরু করার দাবি করে। উপাচার্য সে সময় বিভাগীয় প্রধান ও প্রভোস্টদের সঙ্গে এ বিষয় নিয়েই বৈঠক করছিলেন। বৈঠকে আন্দোলনকারীদের অযৌক্তিক দাবি না মেনে তাদের পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ছাত্ররা সেখানে গেলে উপাচার্য বের হয়ে আসেন এবং বৈঠকের সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি তাদের এও জানান যে, অটোপ্রমোশন কেবল শিক্ষার্থীদের জীবনেই নয়, সমগ্র দেশ ও জাতির জন্যই একটি কলঙ্কস্বরূপ। অতএব তাদের কোনোভাবেই অটোপ্রমোশন দেয়া যেতে পারে না। বিষয়টি তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও অবহিত করেছেন বলে জানান। এ সিদ্ধান্ত শোনার পর ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা আরও সোচ্চার কণ্ঠে স্লোগান দিতে দিতে উপাচার্যের কার্যালয়ের সবক’টি দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। টেলিফোন ও বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া হয়। উপাচার্যসহ ৩০ জন বিভাগীয় প্রধান ও প্রভোস্টকে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করে রাখে তারা। দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত প্রায় ৬ ঘণ্টা চলে এ অবরোধ। উপাচার্য ও সিনিয়র শিক্ষকরা মাঝে-মাঝে অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছেন। আকস্মিক উপাচার্যের কার্যালয়ে এসে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হলে ক্যাম্পাসের সবাই বিস্মিত হয়ে পড়েন। প্রথমেই তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত জিম্মিদশা থেকে শিক্ষকদের উদ্ধার করেন এবং ছাত্রদের অবরোধ তুলে নিতে নির্দেশ দেন। সম্মানিত শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের এহেন অশ্রদ্ধা প্রদর্শনে চরম অসন্তোষ ও দুঃখ প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমাদের মতো আমিও ছাত্র ছিলাম। জীবনে ছাত্র রাজনীতি করেছি। কিন্তু শিক্ষকদের সঙ্গে কখনও এরূপ ব্যবহার করিনি।’ এভাবেই শেষ হয় আন্দোলনকারীদের সেদিনের কর্মসূচি। বঙ্গবন্ধুর সরাসরি হস্তক্ষেপে অটোপ্রমোশনের দাবিতে গড়ে ওঠা ‘আন্দোলন’ সেদিন এভাবেই মাঠে মারা যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণাঢ্য জীবনের একটি বড় অংশ আজও অনালোচিত রয়ে গেছে। বিচারের রায় অনুযায়ী তার খুনিদের কারও কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। বাকিদের রায় কার্যকরের অপেক্ষায়। তা সম্পন্ন হলেই কেবল দুরপনেয় কালিমা থেকে জাতি রেহাই পাবে। আমরা তা দেখার অপেক্ষায় আছি।
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইতিহাস বিভাগ, বাজিতপুর কলেজ, কিশোরগঞ্জ

SUMMARY

134-1.jpg