বঙ্গবন্ধুর আত্মকথন : অসমাপ্ত ইতিহাসের ভ্রমণ


রাজু আলীম 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একটি নাম। একটি জাতির স্বপ্ন পূরণের কেন্দ্রে যার অবস্থান। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের যিনি স্থপতি। মুজিবুর রহমান যার আসল নাম। এর বাইরে ‘খোকা’, ‘মিয়া ভাই’ নামেই অনেকে ডাকতেন। শেখ তার বংশীয় পদবি। নামের অগ্রভাগে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের মানুষের ভালোবাসার উপাধি। আর ‘জাতির জনক’- একটি পরাধীন জাতি ও দেশকে দুইশো বছরের দুঃশাসন, শৃঙ্খলা থেকে মুক্তি দেয়ার দায় পূরণের জন্য বাঙালি জাতি তাকে নিজেদের পিতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। 
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের একটি বিশাল অংশ কেটেছে কারাগারে জেলবন্দী অবস্থায়। ১৯৬৭ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী অবস্থায় বন্ধু-বান্ধব এবং স্ত্রীর অনুরোধে নিজের জীবনী লেখা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কারাবন্দী অবস্থায় নিজের জীবনের অংশ ডায়েরির খাতায় লিখেওছিলেন। দীর্ঘদিন পরে ২০০৪ সালে সেই ডায়েরি আবিষ্কৃত হয়ে এসে পড়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। তারপরে সেই ডায়েরির লেখা পাঠোদ্ধার করে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী। যা রয়ে গেছে অসম্পূর্ণ। তাই লেখাগুলো যখন বই হিসেবে মলাটবন্দী করা হলো তখন নাম দেয়া হলোÑ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
দেশ যখন অন্যায়, শাসন ও শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে চলেছে, ঠিক তখনই শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির ত্রাণর্কতা হিসেবে আবির্ভূত হন। কারাবন্দী অবস্থায় রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি তুলে ধরেছেনÑ তার বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজ জীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, দেশভাগ, মুসলিম লীগের রাজনীতি, আওয়ামী লীগের রাজনীতি, পূর্ব বাংলার রাজনীতি, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, সরকার গঠন, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন বিষয়ে তাঁর প্রত্যক্ষ  অভিজ্ঞতা। পাশাপাশি এখানে তুলে ধরেছেন নিজের কারাজীবন, পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তানের কথা। 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। সেই থেকে ১৫ আগস্ট আমাদের শোক দিবস। আগস্ট শোকের মাস। শোকের মাস আগস্টে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী অবলম্বনে চ্যানেল আই নির্মাণ করে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মকথন’। একইসঙ্গে সেই অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’-এ। একইসঙ্গে একটি অনুষ্ঠান মাসব্যাপী দু’টি চ্যানেলে প্রচার হওয়ার নজির আর এদেশে নেই। বঙ্গবন্ধুর কর্মবহুল এবং দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত গোটাজীবনের গল্প সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর মতো অনুষ্ঠানকে একটি মহতী উদ্যোগই বলব আমি।  
‘বঙ্গবন্ধুর আত্মকথন’ অনুষ্ঠানে সূচনা পর্বে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে স্মৃতিচারণ ও ভূমিকা পাঠ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দেশীয় কোনো টেলিভিশন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিও নজিরবিহীন।
‘বঙ্গবন্ধুর আত্মকথন’ অনুষ্ঠানটি পহেলা আগস্ট থেকে শুরু হয়ে একত্রিশ আগস্ট পর্যন্ত চলে। পহেলা আগস্ট থেকে শুরু হয়ে একত্রিশ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্বে যারা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা হলেন- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক,  দৈনিক সমকাল-এর সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ. আ. ম. স. আরেফিন সিদ্দিক, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাহাত খান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর,  কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন,  রাজনীতিবিদ ও গবেষক নূহ আলম লেনিন, নাট্যজন আতাউর রহমান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব  সৈয়দ হাসান ইমাম, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম,  কবি রুবি রহমান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ, ডা. প্রাণগোপাল দত্ত, অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদার, কবি আসাদ চৌধুরী, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ, বিশিষ্ট নাট্যজন আলী যাকের, বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান, অধ্যাপক এ.কে আজাদ চৌধুরী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।  
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু অকপটে বলে গেছেন তার জীবনকথা। বইয়ের শুরুতেই আমরা দেখি তাঁর সরল-সত্য স্বীকারোক্তি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের প্রভাব যে কতটা স্পষ্ট তা বইটি পড়লেই ঝকঝক হয়ে উঠবে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরুতেই তিনি বলেন,  ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হলো। কেমন করে তার সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। কীভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তার স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।’ শহীদ সাহেবের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা ফুটে ওঠে এই লাইনগুলোর মধ্যে দিয়েই। 
জীবনীগ্রন্থে নিজ পরিবারের পরিচয় পর্ব থেকে শুরু করে শহীদ সাহেবের সঙ্গে পরিচয় পর্বটিও স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধু। শহীদ সাহেবের সঙ্গে তার পরিচয় হয় ১৯৩৮ সালে। একসঙ্গে দুই নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ আসেন। সেখানেই পরিচয় পর্ব দিয়ে রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র শেখ মুজিবুর রহমানের যাত্রা শুরু। এরপর সেই কলেজছাত্র ধীরে ধীরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে একটি জাতির স্বপ্নপূরণের নায়ক। 
পাকিস্তান আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা স্পষ্ট। সেসময়কার মুসলমানদের একমাত্র দাবি ছিল ‘পাকিস্তান’ নামে আলাদা রাষ্ট্র। আর সেই দাবি  প্রতিষ্ঠায় যে ভূমিকা তার ছিল তা তিনি খুব সহজেই বলে গেছেন। এমনকি সেখানেও শহীদ সাহেবের ভূমিকার স্পষ্ট বর্ণনা দেন বঙ্গবন্ধু। তবে এসব বর্ণনা তার নিজের ব্যক্তিগত মতামত হিসেবেই ধরে নিতে হবে।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন রাজনৈতিক কূটচাল, পার্টি ম্যানুপুলেশন, টাকার খেলা, দল বদলানো, নানান ঘটনায় মানুষের নতুন নতুন চেহারার উন্মোচনÑএসবই পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে। সঙ্গে আছে দুর্ভিক্ষ এবং হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। দেশভাগ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট উঠে আসে বইয়ে। শুধু তাই নয়, কলকাতা ও সিলেট নিয়ে যে রাজনীতি ব্রিটিশরা করেছে সে বর্ণনাও আছে। কলকাতাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী না করে ভারতের সীমানায় দিয়ে দেয়াটা হঠকারিতার শামিল বলেই বোঝা যায়।
শুধু রাজনীতি কিংবা নিজের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বাদেও কখনো কখনো বঙ্গবন্ধুর ভেতরের অন্যরকম সত্তাও জেগে উঠতে দেখা গেছে এ গ্রন্থে। তাজমহলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভেতরের রোমান্টিকতার প্রকাশ পেয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘সূর্য যখন অস্ত গেল, সোনালী রঙ আকাশে ছুটে আসছে। মনে হলো, তাজের যেন আর একটা নতুন রূপ। সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কী অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ বৎসর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই, আর ভুলতেও পারব না।’ মানুষ মাত্রই কবি। কথাটি হয়তো ঠিক। অপরূপ মায়া ও রোমান্স উঠে এসেছে লাইনগুলোতে।
বঙ্গবন্ধু একবার সরকারের গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে লাহোর থেকে দিল্লি হয়ে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে খুলনার পথ ধরে বাড়ি ফেরার কাহিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন, মনে হয় কোনো থ্রিলার পাঠ করছি। বিভিন্ন বর্ণনা, শব্দের ব্যবহার, বাক্য গঠন, ভাষাশৈলীও অসাধারণ। যেমন, একবার এক বছর ধরে কারাবন্দী থাকার পর একটি মামলায় হাজিরা দিতে স্টিমারে বঙ্গবন্ধুকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। পরিবারের আপনজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বঙ্গবন্ধু খুবই উদগ্রীব ছিলেন। অপরদিকে, পরিবারের সদস্যগণ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসার খবর না জেনে তার সঙ্গে দেখা করতে অন্য এক স্টিমারে একই সময়ে ঢাকা রওনা হন। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেন : ‘যা ভয় করেছিলাম তাই হলো, পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকায় রওনা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হলো না আমাদের।’
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ একটি আত্মজীবনী গ্রন্থ। যে গ্রন্থখানি লিখেছেন একজন নেতা। নেতার লেখায় রাজনীতি উঠে আসাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু একজন নেতা। বাংলাদেশ স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান নেতা এবং তার রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী একজন নেতার বেড়ে ওঠার গল্প। তার রাজনৈতিক দর্শন ও ভাবনার মিশেলে বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে এ গ্রন্থে। ভাষা ঝরঝরে। বাক্য সাধারণ। শব্দ নির্বাচনে সাদামাটা। কোনো সাহিত্য করার জন্য এ জীবনী তিনি লেখতে বসেননি। নেহায়েত বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এবং স্ত্রী রেণুর অনুরোধে নিজের জীবন লেখতে বসেছিলেন কারাবন্দী অবস্থায়। যা আজ আমাদের সামনে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ হাজির হয়েছে। 
বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু প্রায় সমার্থক। হাজার বছর ধরে বাঙালি একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য লড়াই করে আসছিল। সেই দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলাফল বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও জাগ্রত নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে দখলদার পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা এবং অবিস্মরণীয় বিজয়। কিন্তু এই বিজয় অর্জনের আগে উনিশ শতকের শুরু থেকে কেমন ছিল আমাদের মাটি ও মানুষের রাজনীতি, কেমন ছিল এখানকার রাজনৈতিক নেতাদের মানসকাঠামো তার কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ অনেকদিন আমাদের কাছে ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আমাদের সেই অভাবই শুধু পূরণ করেনি, আমাদের ইতিহাসের আয়নায়ও দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ফলে আমরা যেমন আমাদের চিনতে পারছি, একইভাবে আবিষ্কার করতে পারছি সেই কালের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূগোলও। 
তার দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ সংগ্রামী জীবনের শুরু শিশুকাল থেকেই। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বেরিবেরিতে আক্রান্ত হয়ে হার্ট দুর্বল হওয়া এবং দু’বছর পরে চোখের অসুখ গ্লুকোমায় আক্রান্ত হয়ে চশমা নেয়ার মতো নিজের সঙ্গে সংগ্রাম যেমন আছে, তেমনি আপসহীন ও নির্লোভী চরিত্রের জন্য বারবার কারাবরণ, শোষিত শ্রেণির পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার এবং রাজনৈতিক স্বার্থে পরিবার-পরিজন থেকে দূরে অবস্থানের মতো ব্যাপারও আছে। ‘শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে’ এভাবেই তের বছর বয়সে শিশু রেণুকে বিবাহ করার কথা বর্ণনা করেন, যা তার সংগ্রামে অন্য এক বাস্তবতা এনে দেয়।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠের মধ্য দিয়ে লেখকের চারিত্রিক গুণাবলি ও রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এসবের অন্যতম হলো তার আপসহীন চরিত্র এবং অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। যা দ্বারা তিনি জেল শব্দটিকে নিজের নামের সমার্থক বানিয়েছেন। কৈশোরেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অষ্টম শ্রেণি পড়–য়া শেখ মুজিব  প্রথম জেলে যান। পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। ১৯৪৯ এ ভাসানী তাকে গ্রেফতার এড়িয়ে থাকতে বললে তিনি তার কারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পরে গ্রেফতার হন। বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের মাসে লাগাতার অনশন করে মুক্তি পান। ১৯৫৪ সালে সরকার মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে বাসায় পুলিশ পাঠিয়েছেন শুনে তিনি নিজেই ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন দিয়ে গ্রেফতার হন।
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক বইতে তার ইসলাম বিষয়ক বেশকিছু তথ্য পাওয়া যায়। ভাসানীর সঙ্গে এক জেলে থাকার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘মওলানা সাহেবের সাথে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম। মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কোরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমাদের জন্য বাঁধা নিয়ম ছিল’। জেল জীবনের সময় পার সম্পর্কে বলেন, ‘আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কোরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কোরআন শরীফের বাংলা তরজমাও কয়েক খণ্ড ছিল আমার কাছে’। 
বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা, প্রতিপক্ষ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বস্তুনিষ্ঠ প্রশংসা ও সমালোচনা করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানের জন্ম এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মওলানা ভাসানী ও শেরেবাংলা ফজলুল হকের অবদানকে তুলে ধরার পাশাপাশি সময় সময় তাদের সমালোচনা করেছেন। 
কবি আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। লাহোরে থাকা অবস্থায় একবার তার বাড়িতে গেলে বলেন, ‘কবি এখানে বসেই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আল্লামা শুধু একজন কবি ছিলেন না, একজন দার্শনিকও ছিলেন। আমি প্রথমে তার মাজার জিয়ারত করতে গেলাম এবং নিজকে ধন্য মনে করলাম’।
আত্মজীবনী হিসেবে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে নানা প্রসঙ্গের অবতারণা, আলোচনা ও মূল্যায়ন সবকিছুতেই বস্তুনিষ্ঠতার  ছাপ লক্ষ্য করা যায়। এই আত্মজীবনী নিয়েই আমাদের অনুষ্ঠান ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মকথন’। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক আত্মজীবনী অবলম্বনে অনুষ্ঠান নির্মাণে অংশগ্রহণ করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। সেইসঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি বঙ্গবন্ধু কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। একইসঙ্গে কৃতজ্ঞতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানাকেও। 
যারা আগস্টজুড়ে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মকথন’ অনুষ্ঠানটি দেখেছেন তারা নিশ্চয় জানেন যে, এই অনুষ্ঠানটির মূল পরিকল্পনায় রয়েছেন বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক ও চ্যানেল আই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর এবং অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, চ্যানেল আই’র পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ। প্যানেল প্রযোজক হিসেবে আমার সঙ্গে ছিলেন শহিদুল আলম সাচ্চু। চ্যানেল আই ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ এই সেøাগানকে ধারণ করে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে সবসময় গৌরবের সঙ্গে তুলে ধরে আসছে চ্যানেল আই। এরই ধারাবাহিকতায় এবার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মকথন’। দল যার যার বঙ্গবন্ধু সবার- এই সেøাগানকে সামনে রেখে এখন দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে গেলেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ শেষ হবে। হবে সোনার বাংলা। 
লেখক : কবি, প্রোগ্রাম ম্যানেজার চ্যানেল আই 

SUMMARY

1333-B3.jpg