বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, একটি পর্যালোচনা


কংগ্রেস থাকতে মুসলিম লীগ কেন? মুসলিম লীগ থাকতে আওয়ামী মুসলিম লীগ কেন? কোন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়? লাহোর প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের প্রবক্তা এ কে ফজলুল হক কেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন? অথবা পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী হয়েও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর লেখক কেন সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছেন? এসব ঘটনা প্রবাহের অবিচ্ছেদ্য অংশীদার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মজীবনীতে প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়েছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালে ১৯৬৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি বইটি রচনা শুরু করেন। তার স্মৃতিময় জীবনের প্রথমার্ধ অর্থাৎ ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত  এ গ্রন্থের উপজীব্য। ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি প্রাপ্তি সম্পর্কে বলেন ‘মনে হচ্ছিল, আল্লাহর তরফ থেকে ঐশ্বরিক অভয়বানী এসে পৌঁছাল আমার হাতে’, যা এই গ্রন্থের ঐতিহাসিক গুরুত্বই ফুটিয়ে তোলে।

শেখ বোরহানউদ্দিন নামক এক ধার্মিক ও অভিজাত পুরুষ কর্তৃক শেখ বংশের গোড়াপত্তন এবং তৎকালীন হিন্দু জমিদার ও ইংরেজ শাসকদের মুসলমানবিরোধী তৎপরতার প্রভাবে এ বংশের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাসের বিষয়টি দিয়ে আত্মজীবনী শুরু করেন। লেখক তার পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়াদি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন। অন্যদিকে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির আন্দোলন, বহুল আকাঙ্ক্ষিত পাকিস্তান সৃষ্টি এবং আশাভঙ্গ অতঃপর নিরন্তর সংগ্রামের কথা ছবির ন্যায় তুলে ধরেছেন।

তার দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ সংগ্রামী জীবনের শুরু শিশুকাল থেকেই। তন্মধ্যে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় বেরিবেরিতে আক্রান্ত হয়ে হার্ট দুর্বল হওয়া এবং দু বছর পরে চোখের অসুখ গ্লুকমায় আক্রান্ত হয়ে চশমা নেয়ার মত নিজের সাথে সংগ্রাম যেমন আছে, তেমনি আপসহীন ও নির্লোভী চরিত্রের জন্য বারবার কারাবরণ, শোষিত শ্রেণির পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার এবং রাজনৈতিক স্বার্থে পরিবার পরিজন থেকে দূরে অবস্থানের মত ব্যাপারও আছে। ‘শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে’ এভাবেই তের বছর বয়সে শিশু রেনুকে বিবাহ করার কথা বর্ণনা করেন, যা তার সংগ্রামে অন্য এক বাস্তবতা এনে দেয়।

নিজের মধ্যে লুক্কায়িত রাজনীতির বীজ শেরেবাংলা মন্ত্রিসভার শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে দ্রুত অংকুরোদগম হয়। ‘তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই?’ সোহরাওয়ার্দীর এমন প্রশ্নের জবাবে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধু একধাপ এগিয়ে বলেন ‘কোন প্রতিষ্ঠান নাই, মুসলিম ছাত্রলীগও নাই’। এই শুরু। বাকী জীবন শুধু জেল-জুলুম আর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাস।

জিন্নার ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ ঘোষণাকে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা ভুল বোঝার ফলে ১৯৪৬ এর দাঙ্গা হয়েছে বলে লেখক উল্লেখ করেন। সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ব্যতিরেকে সংগ্রাম দিবস ঘোষণা এবং সোহরাওয়ার্দীর সরকারী ছুটি জারি এহেন ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করেছে বলে আবুল মনসুর আহমেদ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ এ মত দেন। এর ফলশ্রুতিতে মুসলমানরা এক অবর্ণনীয় সাম্প্রদায়িক হামলার স্বীকার হয়। দাঙ্গার উত্তাপ নোয়াখালীতে সংক্রমিত হয়। যার প্রতিক্রিয়ায় বিহারেও ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমানদের ভূমিকা ও রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান বইতে যত্নের সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। এসময় প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ও লেখক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলকাতা ও বিহারের অসহায় মুসলমানদের রক্ষায় যে সাহসী ও দরদী পদক্ষেপ নিয়েছেন তা উল্লেখযোগ্য।

ইতোমধ্যে ভারত ভাগ হয়। জনমত ও সোহরাওয়ার্দীর নেগোসিয়েশন উপেক্ষা করে বাংলাকে ভাগ করে এবং আসামকে ছেড়ে দিয়ে ভারতের বিরাট ভূখণ্ডের দুই পাশে দুই ভিন্ন অংশ নিয়ে সৃষ্ট হয় পাকিস্তান। গভর্নর জেনারেল হতে না পারায় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের অসহযোগিতা এবং কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার মানসিকতাকে বাংলা ভাগের কারন হিসেবে উল্লেখ করেন। এরপর শুধুই ষড়যন্ত্র ‘পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়।’ মূলত ১৯৪৬ সালের মুসলিম লীগের দিল্লী কনভেনশনে শেরেবাংলার লাহোর প্রস্তাবের ‘স্টেটস’ (মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র) এর পরিবর্তে ‘স্টেট’ (অখণ্ড) রাষ্ট্র লেখার মাধ্যমেই এই ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করা হয়।

নির্বাচিত হয়ে নাজিমুদ্দিন যখন সদলবলে পূর্বপাকিস্তানে ফিরে যায় তখন সোহরাওয়ার্দী দাঙ্গা থামাতে এবং কলকাতায় থেকে যাওয়া মুসলমানদের সাহস যোগাতে লেগে যান। লেখকও তার সাথে থাকেন। পরে তিনি পূর্ববাংলায় ফিরে এসে, ‘কমিউনাল হারমনি’ রক্ষায় কাজ শুরু করেন। ভাষার প্রশ্নে শাসকগোষ্ঠীর নির্বুদ্ধিতা, শাসনতন্ত্র রচনায় বিলম্ব, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘কোটারি’, সরকারে আমলাদের অংশগ্রহণ এবং বিরোধী দমন নীতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগনকে ক্ষেপিয়ে তোলে। এ প্রেক্ষাপটে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণার প্রতিবাদে ‘আমি মানিনা’ বলে প্রতিবাদ জানান। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভোগী কর্মচারীদের আন্দোলনে সহায়ক ভূমিকা পালন করায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার সম্পর্কে বইতে বিশদ আলোচনা করেন।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে ‘পূর্ববাংলা আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হলে নিরাপত্তা আইনে অন্তরীণ অবস্থায় লেখক এর জয়েন্ট সেক্রেটারি হন। সরকারের অবর্ণনীয় পীড়ন ও অগণতান্ত্রিক রোষানলের পাহাড়সম বাধা পেড়িয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ এগিয়ে চলে। ‘নিখিল আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও লেখকের মাথায় ছিল। এ বিষয়ে কথা বলতে ১৯৪৯ সালের শেষের পশ্চিম পাকিস্তানে সফরে এসে নানাবিধ প্রোগ্রাম করেন। যা থেকে বোঝা যায় যে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা তখন পর্যন্ত লেখকের মাথায় ছিল না।

১৯৫৩ সালের প্রথম কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু মুসলিম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে দল গোছাতে আত্মনিয়োগ করেন। ভাসানীর মত তিনিও যুক্তফ্রন্ট গঠনের বিরোধী ছিলেন। যুক্তফ্রন্ট গঠনকে তিনি মুসলিম লীগ খেদানো পলিটিসিয়ান এবং আওয়ামী লীগ কাউন্সিলরদের ক্ষমতা লিপ্সু অংশের চক্রান্ত হিসেবে উল্লেখ করেন। এমন সময়ে স্বায়ত্ত্বশাসন ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সম্বলিত ২১ দফা রচনা করায় আবুল মনসুর আহমদের প্রশংসা করেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয় এবং পরবর্তীতে মন্ত্রিত্ব, নেতৃত্ব প্রভৃতি ইস্যুতে অন্তর্কলহ পাঠকের সামনে মেলে ধরেন। মন্ত্রিপরিষদের শপথের সময় আদমজি জুট মিলে সংগঠিত বাঙালি ও অবাঙালির মধ্যকার দাঙ্গাকে যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখান। ষড়যন্ত্রের ধারবাহিকতায় মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে বঙ্গবন্ধু সহ অনেককে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনা তিনি এভাবে উল্লেখ করেছেন ‘এই দিন থেকেই বাঙ্গালির দুখের দিন শুরু হল।’ বাইরে থাকা নেতা-কর্মীদের নীরব থাকার কঠোর সমালোচনা করে বলেন এ সময় আন্দোলন করতে পারলে পাকিস্তানরা এমন সাহস আর দেখাত না। জেল থেকে বের হয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতেও তার সংগ্রাম অব্যহত থাকে। এসব ঘটনা প্রবাহে সক্রিয় অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় একজন শেখ মুজিবুর রহমানের।

প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপিতে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের এই অধ্যায় পর্যন্ত উল্লেখ আছে। যদিও প্রকাশক তার ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক জীবনের পরিচয়, টিকা, জীবনবৃত্তান্তমূলক  টিকা এবং একটি নির্ঘণ্ট যুক্ত করে তাকে তরুনদের কাছে পূর্ণাঙ্গরূপে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। সত্তরের দশকের শেষ দিকে রচিত এ পাণ্ডুলিপি অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার হাতে পৌঁছে। প্রায় চার দশকের পুরানো, হলুদ হয়ে যাওয়া নরম পাতার পাণ্ডুলিপি থেকে লেখা উদ্ধারে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যথেষ্ঠ কষ্ট করেছেন। বিশেষজ্ঞের সহায়তাও নিয়েছেন। শব্দ ও ভাষার সাবলীলতার খাতিরে লেখকের অবর্তমানে সম্পাদনা করেন। তাই গ্রন্থে লেখকের বক্তব্যের অবিকল প্রতিফলন নিশ্চিত করতে নানাবিধ সতর্কতা অবলম্বন করেন। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের স্বীকৃত প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএল। বাংলার পাশাপাশি একইদিনে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান থেকে একযোগে প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য আনফিনিশড মেমোয়ার্স’।

৩২৯ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি পড়ার মধ্য দিয়ে লেখকের চারিত্রিক গুনাবলী ও রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এসবের অন্যতম হল তাঁর আপসহীন চরিত্র এবং অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। যদ্বারা তিনি জেল শব্দটিকে নিজের নামের সমার্থক বানিয়েছেন। কৈশরেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া শেখ মুজিব প্রথম জেলে যান। পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। ১৯৪৯ এ ভাসানী তাঁকে গ্রেফতার এড়িয়ে থাকতে বললে তিনি তার কারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পরে গ্রেফতার হন। বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের মাসে লাগাতার অনশন করে মুক্তি পান। ১৯৫৪ সালে সরকার মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে বাসায় পুলিশ পাঠিয়েছেন শুনে তিনি নিজেই ম্যজিস্ট্রেটকে ফোন দিয়ে গ্রেফতার হন।

মুসলিম লীগে সংস্কারের ব্যাপারে তিনি চেষ্টা চালান। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুরদের প্রতিক্রিয়াশীল দলের গণ্ডি থেকে মুসলিম লীগকে জনগণের প্রগতিবাদী প্রতিষ্ঠানে পরিণিত করতে তিনি চেষ্টা চালান। মুসলিম লীগের ‘কোটারি’, দলাদলি, আপোসকামী ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে পাকিস্তান আন্দেলনের মূল দুর্বলতা এবং পাকিস্তান উত্তর সময়ের সবচে’ বড় সংকট হিসেবে উল্লেখ করেন।

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক বইতে তার ইসলামপ্রিয়তা সম্পর্কে বেশ তথ্য পাওয়া যায়। ভাসানীর সাথে এক জেলে থাকার বর্ণনায় তিনি বলেন ‘মওলানা সাহেবের সাথে আমরা তিনজনই নামাজ পড়তাম। মওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজের পরে কোরআন মজিদের অর্থ করে আমাদের বোঝাতেন। রোজই এটা আমাদের জন্য বাঁধা নিয়ম ছিল’। জেল জীবনের সময়-পার সম্পর্কে বলেন ‘আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কোরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কোরআন শরীফের বাংলা তরজমাও কয়েক খণ্ড ছিল আমার কাছে’। ১৯৫২ সালে শান্তি সম্মেলনে চীনে গিয়ে চীনের অর্থনীতিসহ সামগ্রিক উন্নতিতে অভিভূত হয়ে যান। এসময় তাদের স্বাধীনতার বছর ১৯৪৯ উল্লেখ করে ১৯৪৭ এ স্বাধীনতা পাওয়া পাকিস্তানের অধোগতির জন্য আফসোস করেন।

রাজনীতিতে সোহরাওয়ার্দীকে আজীবন গুরু মানলেও তা অন্ধ অনুকরণ পর্যায়ে ছিলনা। ন্যায়-অন্যায় ও  জাতীয় ইস্যুতে বঙ্গবন্ধুকে তার বিরোধিতা করতেও দেখা গেছে। ১৯৪৬ এর নির্বাচনে নাজিমুদ্দিনের সাথে আপোসের প্রশ্নে শহীদ সাহেবের নমনীয় অবস্থান দেখে বলেছিলেন ‘আপোস করার কোন অধিকার আপনার নেই। আমরা খাজাদের সাথে আপোস করব না।’ আবার যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে দেয়ার পর পাকিস্তান সরকারের অনুরোধে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিত্ব নিলে জেলে বসে তিনি এর বিরোধিতা করেন।

আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা, প্রতিপক্ষ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বস্তুনিষ্ঠ প্রশংসা ও সমালোচনা করেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানের জন্ম এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতা সুলভ আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মাওলানা ভাসানী ও শেরেবাংলা ফজলুল হকের অবদানকে তুলে ধরার পাশাপাশি সময় সময় তাদের দুর্বল চিত্ত, দোদুল্যমান মনোভাব এবং যুক্তফ্রন্টে নেতৃত্ব দানে ব্যর্থ হওয়ার সমালোচনা করেছেন। অপরপক্ষে শহীদ সাহেবের উদার, ত্যাগী, অসাম্প্রদায়িক নেতৃত্বকে বাহবা দিলেও তার অতি উদারতাকে খাজা নাজিমুদ্দীন গংদের নেতৃত্বে আসার অন্যতম ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখিয়েছেন (১৯৩৭ এর নির্বাচনে শহীদ সাহেবের সিটে উপনির্বাচনের মাধ্যমে নাজিমুদ্দীনকে জেতানো হয়।)  তার মতে ‘উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদরতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি হয়।’ খান আতাউর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, ইয়ার মোহাম্মদ খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শামছুল হক সাহেব, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ সহযোদ্ধাদের অবদান বইয়ের পৃষ্ঠায় বার বার এসেছে।

কবি আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে তিনি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। লাহোরে থাকা অবস্থায় একবার তার বাড়িতে গেলে বলেন, ‘কবি এখানে বসেই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আল্লামা শুধু একজন কবি ছিলেন না, একজন দার্শনিকও ছিলেন। আমি প্রথমে তাঁর মাজার জিয়ারত করতে গেলাম এবং নিজকে ধন্য মনে করলাম’।

স্বাধিকার আন্দোলনে মাওলানা আকরাম খা এর আজাদ, আবুল হিশামের মিল্লাত, আবুল মনসুর আহমদের ইত্তেহাদ, ভাসানীর উদ্যোগে মানিক মিয়ার ইত্তেফাক প্রভৃতি পত্রিকার অবস্থান এখানে জোরালো ভাবে চিত্রিত হয়েছে।

আত্মজীবনী হিসেবে এখানে প্রসঙ্গের অবতারণা, আলোচনা, ও মূল্যায়ন সবকিছুতেই বস্তুনিষ্ঠতার  ছাপ লক্ষ্য করা যায়।  ইতিহাসের ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী সহ প্রত্যেকটি সচেতন মানুষের নিকট এ গ্রন্থের একটা অনন্য মর্যাদা থাকবে বলে আশা করা যায়।

SUMMARY

1332-1.jpg