গোলাম সারোয়ার :
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম দিতে হাজার বছর ধরে বাঙ্গালীদের নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ইউরোপ থেকে এ অঞ্চলে আসেন আর্যরা । তাঁরা ধর্মের নামে এবং বিভিন্ন কলা কৌশল করে বাঙ্গালীদের উপর খবরদারী করতে থাকে। তারপর কালক্রমে তাঁরা বনে যান আমাদের ধর্মগুরু, আমাদের বিধানদাতা, আমাদের শাসক । আমরা নিজভূমে হয়ে পড়ি প্রজা ।
আদিকাল থেকে বাঙ্গালীরা ছিলেন সহজ সরল আর বিশ্বাসী মানব সম্প্রদায়। সে জন্যে যখনই কোন বিদেশী সম্প্রদায় আমাদের কাছে এসে কোন অভিনব কথা বলেছেন তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাঁদের বিশ্বাস করেছেন ।
এভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কখনো ইউরোপীয়রা, কখনো আরবরা, কখনো মোঙ্গলরা কিংবা কখনো নিকট প্রতিবেশী শক্তিশালী হয়ে পড়া সাম্রাজ্যগুলো আমাদের ধন সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গেছে তাঁদের দেশে। কিন্তু যতবার পরাধীন হয়েছেন প্রতিবার বাঙ্গালীরা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করেছেন।এভাবে আমরা সর্বশেষ পরিপূর্ণমাত্রায় স্বাধীন হতে পেরেছি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। আমাদের এই ‘প্রকৃত পরম স্বাধীনতা’ যে মহান নেতার মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি, তিনি হলেন বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।বিবিসি ২০০৪ সালে হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী প্রশ্নে একটি জরিপ করে ।সেই জরিপে বিশ্বের সব বাঙ্গালী তাঁকে নির্বাচিত করেন ‘হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী’ হিসেবে ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। সে সময়ে আমরা ছিলাম ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রদেশ। এই প্রদেশটিকে তখন বলা হতো বঙ্গ প্রদেশ।ভারতীয় উপমহাদেশকে তখন শাসন করতো ব্রিটিস সাম্রাজ্য। ইংরেজরা একজন লর্ডকে নিয়োগ দিতেন আমাদের এই উপমহাদেশকে শাসন করার জন্যে। কারণ তখন আমরা ছিলাম তাদের উপনিবেশ। আমাদের জমি-জমার কর, খাজনা, কৃষি ফসলের ভাগের অর্থ ইংরেজরা তখন নিয়ে যেতো তাদের দেশে। বাংলার কৃষকদের জোর করে নীল উৎপাদন করতে বাধ্য করা হতো তাদের দেশের জন্যে। তখন সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীরা রাগে টগবগ করতো । কখনো কখনো তাঁরা ফুঁসে উঠতো ।
এই রকম সময়ে কেটেছে বঙ্গবন্ধুর শিশুকাল । তাঁর বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান। তিনি ছিলেন গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার। সেরেস্তাদার মানে হলো যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন। বঙ্গবন্ধুর মায়ের নাম হলেন সায়েরা খাতুন। বঙ্গবন্ধুরা ছিলেন দুই ভাই এবং চার বোন। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।তাঁর বড় বোন ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী এবং তাঁর ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের। তাঁর ডাক নাম ছিলো ‘খোকা’ । খোকনকে আমাদের দেশে আদর করে ডাকে খোকা বলে ।
১৯২৭ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যখন গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তখন তাঁর বয়স সাত বছর। ১৯২৯ সালে নয় বছর বয়সে তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন । তারপর চার বছর তিনি বিদ্যালয়ে যেতে পারেননি চোখে অসুখের কারণে । ১৯৩৭ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেসার সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিলো মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। সে সময় স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক । ইনি পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন । শেরে বাংলার সাথে আসেন নিখিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী । বঙ্গবন্ধু এই সময়ে স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবীতে একটি দল নিয়ে তাঁদের কাছে যান । সেই বছরেই তিনি সরকারী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সভা করার দু:সাহসের কারণে প্রথম কারাবরণ করেন ।
১৯৪০ সালে মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। সেখানে তিনি এক বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্টিকুলেশন পাশ করেন । তারপর তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন আইন পড়ার জন্যে। ঐ কলেজের বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ ।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল। এই কলেজ থেকে সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন বঙ্গবন্ধু ।
১৯৪৩ সালে তিনি বেঙ্গল মুসলিমলীগে যোগ দেন এবং অগ্রসর কাশ্মিরী বংশদ্ভুদ বাঙালি মুসলিম নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি ।
১৯৪৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এই সময়ে কিন্তু বিশ্বে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ভারতবর্ষের মানুষেরাও এই যুদ্ধের অংশীদার কারণ ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার সাথে এই যুদ্ধের বিভিন্ন পক্ষের হারা-জিতার সম্বন্ধ ছিলো।১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং শেষ হয় ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরের বছর শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ব্রিটিসদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান নামক একটি বিরল দেশের জন্ম হয় যার ছিলো দুই দিকে বিচ্ছিন্ন দুটো প্রদেশ। একটি প্রদেশ পশ্চিম পাকিস্তান এবং অন্যটি পূর্ব পাকিস্তান। দুই প্রদেশের মাঝখানের ভৌগোলিক দূরত্ব প্রায় সাড়ে বারশ মাইল এবং চিন্তা, চেতনা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ছিলো আরো বেশি দূরত্ব। মিলের মাঝে মিল ছিলো শুধু ধর্মের। পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মাঝখানে ছিলো আর একটি বৃহৎ দেশ ‘ভারত’ যা ব্রিটিসদের থেকে স্বাধীন হয় পরের দিন ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ।
দেশবিভাগের বছর শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার সময়ে কলকাতায় ভয়ানক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। এ সময় তিনি মুসলিমদের রক্ষা এবং দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় শরিক হন।
পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তারপর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যার মাধ্যমে তিনি এই প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী তারিখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন গণ-পরিষদের অধিবেশনে বলেন যে, উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা! তাঁর এই মন্তব্যে সমগ্র পূর্বপাকিস্তানের মানুষ রাগে ফেটে পড়েন ।শেখ মুজিবুর রহমান অবিলম্বে মুসলিম লীগের এই পূর্ব পরিকল্পিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নেন । ২ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে তিনি একটি প্রস্তাব পেশ করেন । এখান থেকেই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয় । এই পরিষদের আহবানে ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট পালনকালে শেখ মুজিবসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য ছাত্র নেতাদেরকে মুক্তি দেয়া হয় । তারপর ১৭ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দেন তিনি। ১৯ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। এতে ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ তারিখে তাঁকে আবার আটক করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আবার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবী আদায়ের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন যার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। মজার কথা হলো, ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর সেই বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে তাঁর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগ গঠন করেন । তিনি মুসলিমলীগ ছেড়ে দিয়ে এই নতুন দলে যোগ দেন। তাঁকে দলের পূর্বপাকিস্তান অংশের যুগ্ম সচিব নির্বাচিত করা হয় । জুনের শেষ দিকে জেল থেকে ছাড়া পান তিনি । ছাড়া পাওয়ার পরই খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেন । এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে তাঁকে সাময়িকভাবে আটক করে রাখা হলেও অচিরেই ছাড়া পেয়ে যান তিনি। এরপর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে মিলে লিয়াকত আলী খানের কাছে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের চেষ্টা করায় ভাসানী এবং তাঁকে আটক করা হয়। এটি ছিল অক্টোবরের শেষদিকের কথা।
১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের পূর্বপাকিস্তান আগমনকে উপলক্ষ করে আওয়ামী মুসলিমলীগ ঢাকায় দুর্ভিক্ষবিরোধী মিছিল বের করেন। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে এবারও তিনি আটক হন। সেবার তাঁর দুই বছর জেল হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা! এই সময়ে তিনি জেলে অন্তরীণ। জেল থেকে নির্দেশনা দিয়ে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পরিচালনা করতে থাকেন। এরপরই ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষার দাবী আদায়ের দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সময়ে তিনি জেলে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর এই অনশন ১৩ দিন কার্যকর ছিল। ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই বছরের ১৪ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট । ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মধ্যে ২২৩ টিতে বিপুল ব্যবধানে বিজয় অর্জন করে যার মধ্যে ১৪৩ টি আসনই পায় আওয়ামীলীগ। ১৫ মে তাঁকে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২৯ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেয়। ৩০ মে করাচি থেকে ঢাকায় ফেরার পর বিমান বন্দর থেকেই তাঁকে আটক করা হয়। ২৩ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন।
লেখক : গোলাম সারোয়ার
সাংবাদিক ও কলাম লেখক ।