সাইফুল ইসলাম জুয়েল
মধুমতি আর ঘাগোর নদীর তীরে এবং হাওড়-বাঁওড়ের মিলনে গড়ে ওঠা বাংলার অবারিত প্রাকৃতিক পরিবেশে টুঙ্গিপাড়া গ্রামটি অবস্থিত। আজ থেকে ছয়'শ বছর আগে কবিরত্ন বিজয় গুপ্ত তাঁর পদ্মাপুরাণ কাব্যে এই ঘাগোর নদীর ঐতিহাসিক বর্ণনা দিয়ে গেছেন। টুঙ্গিপাড়া গ্রামের সারি সারি গাছগুলো ছিল ছবির মতো সাজানো। নদীতে তখন বড় বড় পালতোলা পানশি, কেরায়া নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার চলতো। বর্ষায় গ্রামটিকে মনে হতো যেন শিল্পীর আঁকা জলে ডোবা একখণ্ড ছবি।
টুঙ্গিপাড়া তখনো অপরিচিত এলাকা। দু একটি বনেদী পরিবার এখানে বসবাস শুরু করে। টুঙ্গিপাড়ার একটি বনেদী পরিবারের নাম শেখ পরিবার। এই পরিবারের উত্তরসূরী শেখ পরিবারের সুপরিচিত ব্যক্তি শেখ হামিদ গড়ে তোলেন একটি টিনের ঘর। শেখ হামিদের একমাত্র পুত্র শেখ লুত্ফর রহমান একজন সজ্জন ব্যক্তি। গোপালগঞ্জ শহরে সবেমাত্র সরকারি চাকরি গ্রহণ করেছেন। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। এদিন শেখ লুত্ফর রহমান ও তার সহধর্মিনী সায়রা খাতুনের ঘরে জন্ম নিলো একটি ফুটফুটে চেহারার শিশু। বাবা-মা আদর করে নাম রাখলেন খোকা। এই খোকাই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতির জনক এবং সমগ্র বাঙালির প্রিয় মানুষ। শৈশব-কৈশোরে বাবা-মা তাঁকে আদর করে খোকা বলে ডাকতেন।
বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমামণ্ডিত টুঙ্গিপাড়ায়। টুঙ্গীপাড়া গ্রামেই শেখ মুজিবুর রহমান ধন ধান্যে পুষ্প ভরা শস্য শ্যামলা রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। তিনি আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন। তিনি দোয়েল ও বাবুই পাখি ভীষণ ভালোবাসতেন। বাড়িতে শালিক ও ময়না পুষতেন। আবার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন বোনদের নিয়ে। পাখি আর জীবজন্তুর প্রতি ছিল গভীর মমতা। মাছরাঙা ঢুব দিয়ে কীভাবে মাছ ধরে তাও তিনি খেয়াল করতেন খালের পাড়ে বসে বসে। ফুটবল ছিল তার প্রিয় খেলা। এভাবে তার শৈশব কেটেছে মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে আর বর্ষার কাদা পানিতে ভিজে। গ্রামের মাটি আর মানুষ তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। শৈশব থেকে তত্কালীন সমাজ জীবনে তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা নিপীড়ন দেখেছেন। গ্রামের হিন্দু, মুসলমানদের সম্মিলিত সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িকতার। আর পড়শি দরিদ্র মানুষের দুঃখ, কষ্ট তাঁকে সারাজীবন সাধারণ দুঃখী মানুষের প্রতি অগাধ ভালবাসায় সিক্ত করে তোলে। বস্তুতপক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি কোনো শক্তির কাছে— সে যত বড়ই হোক, আত্মসমর্পন করেননি; মাথানত করেননি।
টুঙ্গিপাড়ার সেই শেখ বাড়ির দক্ষিণে ছিল কাছারি ঘর। এখানেই মাস্টার, পণ্ডিত ও মৌলভী সাহেবদের কাছে ছোট্ট মুজিবের হাতেখড়ি। একটু বড় হলে তাঁদের পূর্ব পুরুষদের গড়া গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। এরপর তিনি বাবার কর্মস্থল গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে পড়াশোনা করেন। ১৯৪২ সালে এসএসসি এবং ১৯৪৭ সালে কলকাতার অধীনস্থ ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। এ সময়ে শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবনের সংগ্রামী অধ্যায়। শৈশব থেকেই তিনি খুব অধিকার সচেতন ছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হামিদ মাস্টার ছিলেন তাঁর গৃহ শিক্ষক। তাঁর এক স্যার তখন গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য একটি সংগঠন করেছিলেন। শেখ মুজিব ছিলেন এই সংগঠনের প্রধান কর্মী। বাড়ি বাড়ি ধান চাল সংগ্রহ করে ছাত্রদের সাহায্য করেছেন। একবার অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ পরদর্শনে আসেন। সাহসী কিশোর মুজিব সেবার স্কুল ঘর মেরামত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার আদায় করেন। এর কিছুদিন পরে গোপালগঞ্জে সরকার সমর্থকদের দ্বারা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জীবনে প্রথম গ্রেফতার বরণ করেন। এরপরেও তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রামে কখনো আপোষ না করায় অনেকবার কারাবরণ করেন।
বঙ্গবন্ধু ছোটদেরকে ভীষণ ভালোবাসতেন। কচিকাঁচার মেলা ও খেলাঘর ছিল তাঁর প্রিয় সংগঠন। কৈশোরে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কচিকাঁচার আসরে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের শেষ দিনটি তিনি কাটিয়েছেন এই সংগঠনের ভাই-বোনদের মাঝে। তাঁর জন্মদিনটিকে এখন আমরা জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করি। শিশুদের কাছে দিনটি আনন্দ-খুশির।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভের পর পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ ভূমিতে ফিরে এসে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর বেঁচে ছিলেন। মানবতার শত্রু কতিপয় বিপথগামী ঘৃণ্য ঘাতকের দল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নামই নয়, একটি দেশের, একটি জাতির রূপকার। যাঁর নেতৃত্বে, যাঁর অসীম ত্যাগ ও সংগ্রামে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের তিনি ছিলেন প্রকৃত বন্ধু। অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসা ছিল তাঁর বাংলার জনগণের জন্য। পরিবার পরিজনসহ নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের কত আপন ছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পর টুঙ্গীপাড়াকে পৃথক থানা ঘোষণা করা হয়। গোপালগঞ্জের এই সবুজ শ্যামল টুঙ্গিপাড়াতেই এখন চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আমাদের সেই খোকা।