অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির
শেখ মুজিবুর রহমান তখন কিশোর। পড়াশোনার জন্য থাকেন গোপালগঞ্জ শহরে। মুজিব গ্রামে গেলেন কদিনের ছুটিতে। সে বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভালো ফসল হয়নি। গ্রামে দুর্ভিক্ষাবস্থা। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হয়। তিনি পুরো গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখলেন। দরিদ্র মানুষের কষ্ট কিশোর মুজিবের কচি হৃদয়কে আলোড়িত করলো। বাড়ি ফিরে পিতার অনুপস্থিতিতেই গোলা থেকে ধান-চাল নিয়ে তিনি গরিব মানুষের মাঝে বিতরণ করলেন। পিতা বাড়ি এসে সব শুনলেন, দেখলেন। কিই বা বলবেন তিনি মুজিবকে! মুজিব এসে অকপটে বললেন, অভাবগ্রস্ত মানুষের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তিনি নিজেদের গোলার বাড়তি ধান তাদের মধ্যে বিতরণ করেছেন, তাদের বাঁচার ব্যবস্থা করেছেন। এ থেকে কিশোর বয়সেই মুজিবের সংবেদনশীল হৃদয় ও মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় মেলে।
আরো একদিনের এমন ঘটনা শেখ মুজিবের পিতাকে হতবিহŸল করেছিল। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি স্কুলের শিক্ষক বসুরঞ্জন সেনগুপ্তের বাসায় প্রাইভেট পড়তেন। একদিন সকালে তাঁর বাড়ি থেকে পড়া শেষ করে আসার পথে এক খালি গা বালককে দেখলেন। জিজ্ঞেস করলে ছেলেটি বললো, তার গায়ে দেয়ার মতো কিছু নেই। সঙ্গে সঙ্গে মুজিব গায়ের গেঞ্জি খুলে ওই ছেলেকে দিয়ে দেন। বাড়ি ফিরে আসেন চাদর গায়ে, আদুল গায়ে। বালকের কষ্ট সেদিন মুজিব সহ্য করতে পারেননি।
বাল্যকালে পারিবারিক আবহের কারণেই শেখ মুজিব মানবপ্রেমী হয়ে ওঠেন। অন্যায়, অবিচার আর প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা আর ক্লেদ তৈরি হয় সেই কচি মনেই। টুঙ্গীপাড়া গ্রামেই শেখ মুজিবুর রহমান ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা শস্য-শ্যামলা রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। তিনি আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকেই গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। গ্রামের মাটি আর মানুষ তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো। শৈশব থেকেই তিনি তৎকালীন সমাজজীবনে প্রজাপীড়ন দেখেছেন, দেখেছেন জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারের চিত্র।
গ্রামের হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত সামাজিক আবহে শেখ মুজিব অসা¤প্রদায়িকতার দীক্ষা পান। আর পড়শি দরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাঁকে সারাজীবন সাধারণ দুঃখী মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় সিক্ত করে তোলে। বস্তুতপক্ষে, সমাজ ও পরিবেশ তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী-জীবনে তিনি কোনো শক্তির কাছে, সে যত বড়ই হোক, আত্মসমর্পণ করেননি; মাথানত করেননি।
শিশুকাল থেকেই মুজিব ছিলেন ডানপিটে ও একরোখা স্বভাবের। তাঁর ভয়-ভীতি আদৌ ছিল না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, সত্য ও উচিত কথা বলার অভ্যাস থাকায় কারো সামনেই তিনি কথা বলতে ভয় পেতেন না। প্রধান শিক্ষক গিরীশ বাবু কিশোর মুজিবের সাহসিকতা ও স্পষ্টবাদিতার গুণেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রথম দিকে তাঁর আচরণে কিছুটা অবাক হলেও তাঁর অন্য গুণের সঙ্গে সাহসিকতা, স্পষ্টবাদিতা ও দৃপ্ত-বলিষ্ঠতার জন্যেই তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন তিনি। মিশন স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই শুধু প্রধান শিক্ষককে নয়, সবাইকেই জয় করে নিলেন তিনি। পরিচিত হয়ে উঠলেন সহপাঠী ও বয়ঃকনিষ্ঠদের ‘মুজিব ভাই’ রূপে। এভাবে স্কুলে পড়া অবস্থায়ই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে।
হাস্যোজ্জ্বল মুখের মিষ্টি কথা, অন্তরঙ্গ ব্যবহার এবং খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের কারণে অল্পদিনেই স্কুলের শিক্ষক-ছাত্র সবারই প্রিয় হয়ে উঠলেন মুজিব। স্কুলের যে কোনো উৎসব-অনুষ্ঠানে তাঁর থাকতো সক্রিয় ভূমিকা, এমনকি অনেক সামাজিক কাজেও মুজিব সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। যে কোনো ধরনের কাজে মুজিব এগিয়ে গেলে অন্য ছাত্ররাও তাঁর সঙ্গে এগিয়ে যেত সেই কাজে। শৈশবকাল থেকেই মুজিবের খেলাধুলার প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল। ফুটবল খেলায় তিনি বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ভলিবল খেলাতে তাঁর বেশ আগ্রহ দেখা যেতো। গুরুসদয় দত্ত প্রবর্তিত ‘ব্রতচারী নৃত্যে’র প্রতি তিনি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন।
পরিণত বয়সে তাঁর মধ্যে যে মহানুভবতা, ঔদার্য, সাধারণ মানুষের প্রতি আন্তরিক দরদ, সৎ সাহস, মানুষের বিপদে-আপদে অকুণ্ঠচিত্তে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া, সমাজের যে কোনো স্তর ও পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশা প্রভৃতি গুণাবলী দেখা যায়, শৈশবেই তার প্রকাশ ঘটে। ‘উঠন্ত মূলো পত্তনেই চেনা যায়’- প্রবাদের সত্যতা প্রমাণিত হয় মুজিবের জীবনে।
সম্ভ্রান্ত বংশের উত্তরাধিকারসূত্রেই সমাজকল্যাণের ব্রত পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাড়িতে আনন্দবাজার,
বসুমতি, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাতসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা রাখা হতো। এসব পত্রিকা আর বই-পুস্তকের কল্যাণে কিশোর বয়সেই তাঁর সমসাময়িক দুনিয়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা জন্মে। সেই বয়সেই এলাকার অসহায় ও দুঃস্থদের উন্নয়নভাবনা তাঁর মাথায় জেঁকে বসলো। সমাজে অমানবিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যে মানুষগুলোর দিনাতিপাত হচ্ছিল, তিনি তাদের সহায়তায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। সমাজের নিষ্ঠুর বর্বরতাকে পেছনে ফেলে দিনবদলের দৃঢ় সংকল্পে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। সমাজবদলের যুদ্ধটাই ছিলো তাঁর মূল লক্ষ্য, যা জীবনযুদ্ধের চেয়েও বড় ও মহৎ। নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন ঘটনা। গ্রামের ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তিনি। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টির চাউল সংগ্রহ করলেন। বিক্রিত অর্থ ব্যয় করলেন অসহায় ও গরিব পরিবারের সন্তানদের পড়ালেখার পেছনে। সে সময়েই কিশোর মুজিবের মধ্যে ভবিষ্যৎ নেতা হওয়ার লুক্কায়িত নেতৃত্বের গুণাবলির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের ভেতরে আরেকটি মোহনীয় গুণ ছিল। তা হলো সংবেদনশীলতা আর অসাম্প্রদায়িকতা।
তখনো তিনি হাইস্কুলের ছাত্র। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী আর সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা গোপালগঞ্জে আসবেন। তাঁদের সংবর্ধনার জন্য বিরাট সভার আয়োজন করা হয়। সেই সংবর্ধনা সভার প্রধান স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে কাজ করেছিলেন। এতে হিন্দুদের আপত্তি ও কোনো কোনো মুসলিম সদস্যের অনীহাকে তিনি পরোয়া করেননি। তাঁর মতে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার আগে মানুষ সত্য। আর মানুষ হিসেবে আমাদের প্রধান দায়িত্ব সমাজ, দেশ ও জাতির উন্নয়ন। বিশ্বাসের এ ধারাটি তাঁর মধ্যে সমুন্নত ছিল জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। বিশাল এ জনসভার স্বেচ্ছাসেবক বিভাগের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে তিনি ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শন করেন নিজের অগোচরেই। কিশোর বয়সেই তাঁর নেতৃত্বের এ পারঙ্গমতা নজর কাড়ে শেরেবাংলার। শেরেবাংলা নিজ পকেট থেকে নোটবুক বের করে বঙ্গবন্ধুর নাম-ঠিকানা লিখে নেন। পরে কলকাতায় গিয়ে চিঠি লিখেন। এভাবে কিশোর বয়সেই জাতীয় রাজনীতির প্রবহমান ¯্রােতের সঙ্গে সংযুক্ত হলেন কিশোর মুজিব।
কিশোর বয়সেই চমৎকার মানবিক আচরণের জন্যে মুজিবের বন্ধুর অভাব হতো না। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বয়োবৃদ্ধরাও তাঁর শুভাকাক্সক্ষী হয়ে যেতেন। তাঁর চরিত্রের মাধুর্য সকলকেই কাছে টানতো। রাজনীতিতে দক্ষতা অর্জনের এই বড় গুণটি প্রাকৃতিকভাবেই তাঁর চরিত্রে অন্তর্নিহিত ছিল। তিনি শৈশব থেকেই কখনো অন্যায়ের সংস্পর্শে যেতেন না। অনিয়মকে প্রশ্রয় দিতেন না। কিশোর বয়সে সহপাঠী আবদুল মালেককে স্থানীয় হিন্দুরা ধরে নিয়ে মারধর করে। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে এর প্রতিবাদ করেন। অন্য বন্ধুদের নিয়ে মালেককে আটক অবস্থা থেকে মুক্ত করেন। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ আসে তাঁকে গ্রেপ্তার করতে। কাছের জনেরা এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাও তাঁকে আড়ালে লুকিয়ে থাকার পরামর্শ দেন। তিনি সব অবজ্ঞা করেন। মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন। সাজানো মামলা আর মিথ্যে ঘটনা দিয়ে শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন। পরবর্তীকালে অসংখ্যবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে। তাঁর জীবনের মূল্যবান সময়গুলো কেটেছে কারাগারের অন্ধ কুঠিতে। এভাবে ম্যাট্্িরক পাসের পর তিনি প্রত্যক্ষ ছাত্ররাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার সাহস পেতো না। এই জনপ্রিয়তা ও একচ্ছত্র প্রভাব ছিল তাঁর একটি চারিত্রিক বিজয়। অনুপম মানবিক হৃদয়ের অধিকারী এই কিশোরই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেন ইতিহাসের মহানায়ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, বাঙালির জাতির জনক। শেখ মুজিবের পরিচয়- তিনি বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের নেতা। তিনি বাঙালির সবচেয়ে আপনজন- তিনি বঙ্গবন্ধু। আর কোনো ব্যাখা বা উপাধির প্রয়োজন নেই তাঁর জন্যে। তবে এ কথাও সত্য যে, একজন মানুষের এমন মর্যাদা, এমন ধরনের সম্মাননা একই সঙ্গে বিরল ও ব্যতিক্রমী। বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক আভা ছড়িয়ে পড়–ক বিশ্বের সকল শিশুর মধ্যে। আগামী দিনের নাগরিকরা গড়ে উঠুক মানবপ্রেমী ও দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে- জাতির জনকের জন্মদিনে এমনই প্রত্যাশা।