বঙ্গবন্ধুর শৈশব


সঞ্জয় সরকার ॥
আমরা সবাই জানি_ শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা। স্বাধীন বাংলার মহান স্থপতি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, দেশের মানুষ ভালবেসে তাকে উপাধি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারণ বাংলাদেশকে তিনি মায়ের মতো ভালবাসতেন। বাংলাদেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি সারাজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছেন। বারবার জেল-জুলুম খেটেছেন। শেষ পর্যনত্ম জীবন পর্যনত্ম উৎসর্গ করেছেন। জীবনের কখনও তিনি কোন অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করেননি। তাঁর সঠিক এবং যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই 'বাংলাদেশ' আজ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আর আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের এক অবিস্মরণীয় নেতার নাম। আমাদের বুকভরা গর্বের, অহঙ্কারের ও অকৃত্রিম ভালবাসার একটি নাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ মঙ্গলবার রাত আটটায়, সাবেক ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান আদালতে চাকরি করতেন। তাঁর মাতা সায়েরা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁদের তৃতীয় সনত্মান। পরিবারের সবাই তাঁকে আদর করে 'খোকন' বা 'খোকা' বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধুর পিতা ছিলেন একজন স্পষ্টভাষী ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। পিতার এই আদর্শ তাঁকে নীতি শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন মাতৃভক্ত সনত্মান। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে তিনি একজন বিজ্ঞ আইনজীবী হবেন।
টুঙ্গিপাড়া বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার একটি উপজেলার নাম। কিন্তু তাঁর ছেলেবেলায় টুঙ্গিপাড়া ছিল আর দশটি গ্রামের মতোই ছায়াঢাকা-পাখিডাকা এক নিভৃত পলস্নী। এ গ্রামের মাটি-জল-হাওয়াতেই কেটেছে তাঁর দুরনত্ম শৈশব। শিশুকাল থেকেই খেলাধুলার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল তাঁর। স্বভাবের দিক দিয়ে ছিলেন একটু জেদি, চঞ্চল ও একগুঁয়ে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরম্ন হয় গৃহশিক্ষক প-িত শাখাওয়াতুলস্নাহ সাহেবের কাছে। তিনি ১৯২৭ সলে প্রথম ভর্তি হন স্থানীয় গীমাডাঙ্গা-টুঙ্গিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর পিতার কর্মস্থল মাদারীপুরের ইসলামিয়া হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে তাঁর পিতা বদলি হয়ে গোপালগঞ্জে যোগদান করলে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। বিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন তিনি। পছন্দ করতেন ইতিহাসের বই। এসব কারণে প্রধান শিক্ষক গিরিশ চন্দ্রসহ সকল শিক্ষকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিব।
শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন পরোপকারী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী। মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় যেমন সহযোগিতার হাত বাড়াতেন-তেমনি কারও প্রতি অন্যায় আচরণ দেখলেও প্রতিবাদ করতেন তিনি। মাত্র তের বছর বয়সে প্রতিবাদের এক বিরল দৃষ্টানত্ম স্থাপন করেছিলেন তিনি। ওই সময় গোপালগঞ্জে স্বদেশী আন্দোলনের এক সমাবেশে জনতার ওপর পুলিশের নির্বিচারে লাঠিচার্জ দেখে বিক্ষুব্ধ হন শিশু মুজিব। ফলে বিক্ষোভকারীরা যখন পুলিশের ওপর চড়াও হয়_তখন তিনিও বন্ধুদের নিয়ে যোগ দেন বিক্ষোভকারীদের দলে। পুলিশ ফাঁড়িতে শত শত ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে তাঁরা নাজেহাল করে তোলেন পুলিশ সদস্যদের। তাঁর সাহস দেখে অবাক হন থানার বড় কর্তাও।
এর পরের বছর_অর্থাৎ তাঁর বয়স যখন চৌদ্দ, তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি হঠাৎ চক্ষুরোগে আক্রানত্ম হন। অনেক চিকিৎসা চলে। কিন্তু অসুখ সারে না। এ কারণে তাঁর লেখাপড়া সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। তিন বছর পর আবার সুস্থ হয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। মনোযোগী হন লেখাপড়ায়। তখন ঘটে আরেক ঘটনা। গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল পরিদর্শনে আসেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর ব্যাপারে শহরের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। বিষয়টি কিশোর মুজিবের ভাল লাগেনি। তাই তিনি আয়োজকদের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন এবং দুর্জয় সাহস নিয়ে একটি মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করেন। এর ফলে বিরোধীচক্রের রোষানলে পড়েন শেখ মুজিব। রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। হাজতবাস করতে হয় সাতদিন। এটিই তাঁর জীবনের প্রথম কারাবরণ।
দেশে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে। চারদিকে এক দাবি_ইংরেজ শাসনের অবসান চাই। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার দাবি শেখ মুজিবের কিশোর মনকেও দোলা দিল। তিনি উদ্বুদ্ধ হতে লাগলেন স্বদেশপ্রেমে। জীবনের এসব খ-িত ঘটনাই বুঝি তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষা সম্পন্ন করেছিল।
উপরোক্ত ঘটনার কিছুদিন পর গোপালগঞ্জে আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শেখ মুজিব তাঁর সামনে স্কুলের ছাত্রাবাসের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন। কিশোর মুজিবের দুরনত্ম সাহস ও মনোবল সোহরাওয়ার্দীকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। তিনি সহজেই আপন করে নেন মুজিবকে। উৎসাহিত করেন বিশেষভাবে। শেখ মুজিবও সোহরাওয়ার্দীর সানি্নধ্যে মুগ্ধ হয়ে এক নিবিড়-অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়েন। আর এভাবেই কিশোর বয়সেই রাজনৈতিক গুরম্নর সন্ধান পেয়ে যান শেখ মুজিব। তিনি নিয়মিত চিঠি লিখতেন সোহরাওয়ার্দীর কাছে। সোহরাওয়ার্দীও উত্তর দিতেন তাঁর চিঠির।
১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা (এসএসসি) পাস করে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে যান এবং ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। একদিকে যেমন পড়াশোনা চালিয়ে যান, অন্যদিকে দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সক্রিয় হন রাজনীতিতে। এর পরের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষায় পরিপূর্ণ। সে এক বীরত্বগাথা।
তাই টুঙ্গিপাড়ার সেই দুরনত্ম কিশোর শেখ মুজিবের নাম শুধু টুঙ্গিপাড়ায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর নাম ছড়িয়ে গেছে_সারা বাংলায়, সারাবিশ্বে। পরিণত বয়সে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শোষিত-বঞ্চিত-গণমানুষের নেতা, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর সঠিক নেতৃত্ব এবং আহ্বানের কারণেই একাত্তরে বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপ দেয়, পাকিসত্মানি শাসকগোষ্ঠীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। নিজস্ব একটি পতাকা ও একটি মানচিত্র নিয়ে গর্ব করার সুযোগ পাই আমরা। তাঁর অশেষ অবদান এবং আত্মত্যাগের জন্যই তিনি আজ আমাদের কাছে জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, স্বাধীনতার মহান স্থপতি।
কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম-নিষ্ঠুর সত্যিটি হচ্ছে_যে মানুষটি নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে তুচ্ছ করে গরিব-মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য সারাজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, দিনের পর দিন জেল খেটেছেন, অসংখ্যবার নির্যাতন ভোগ করেছেন, যাঁর জন্য আজ স্বাধীনতা_ সে মহান মানুষটিকেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সপরিবারে হত্যা করে একদল উচ্চাবিলাসী বিশ্বাসঘাতক-নরপিশাচ। তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) ও শেখ রেহানা সেদিন বিদেশে থাকায় তাঁরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। ঘাতকরা সেদিন চেয়েছিল_ বঙ্গবন্ধুর নাম চিরতরে মুছে দিতে। কিন্তু যাঁরা ইতিহাসের জন্ম দেন, যাঁরা ইতিহাসের নায়ক_ তাদের নাম কী সহজে মুছে ফেলা যায়। যায় না। তাই কবি বলেছেন, 'যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা/গৌরী, যমুনা বহমান/ততদিন রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান'। কবির কথাই সত্যি। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অমস্নান হয়ে থাকবে। তিনি চিরঞ্জীব।

SUMMARY

1324-B3.jpg