ফয়জুল আজিম শিশির
শত শত বৎসর একত্রে একই ভুমিতে বসবাসের কারণে, এক ও একক সত্তায় পরিণত হয়েছে বাঙ্গালী । সেই কারণেই ঐশিবাণী সকল বাঙ্গালীর প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। উচু ঘরনার রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা দেশের চলমান অবস্থার উপর মন্তব্যের এক পর্যায়ে টানেন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু পরিচয়ের কথা। তাদের কথাগুলো বেসুরা, পাপী ও মহামিথ্যুকদের মিথ্যাচার ও পাপের বেশাতি ভরা, শুনতে কষ্ট হচ্ছিল। সেখানে প্রতিবাদ ও কলহ ছাড়া বসে থাকা সম্ভব ছিল না। প্রতিবাদও করার রুচি ছিল না। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর বংশলতিকা সংগ্রহের জন্য বহু গন্থ ঘাটাঘাটি করে বঙ্গবন্ধুর বংশ পরস্পরা অনেক তথ্য পাই।
আরো কিছুটা তথ্য সংগ্রহের জন্য গোপালগঞ্জ বেড়াতে যাই।সেই তখনও গোপালগঞ্জ অনুন্নত ছিল। কিছু বঙ্গবন্ধু বংশ পরস্পরা তালিকা পেয়েছিলাম আমার পিতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, পরবর্তীতে স্পীকার প্রয়াত মোহাম্মদউল্যাহ একান্ত সচিব, স্বারষ্ট মন্ত্রী প্রয়াত আবদুল মালেক উকিল একান্ত সচিব, মহান জাতীয় সংসদের তৎকালীন আওয়ামী লীগের বিরোধী দলীয় নেতা মো. আসাদুজ্জামান খানের একান্ত সচিব এ.কে.এম. শামসুদ্দিন আহমেদ নিজহস্তে লিখিত ডায়েরীতে। সময়টা ছিল ১৯৭৮-১৯৮৩ সাল। সংশয় সৃষ্টিকারীগন এখনও নিকৃষ্টতম মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে, সেজন্য প্রকৃত সত্য ও তথ্য জানার প্রয়োজন রয়েছে দেশবাশীর। রাজনৈতিক কারনে ও বিভিন্ন মতলবে বঙ্গবন্ধুকে অপছন্দ করতে পারেন। সেই অপছন্দকে প্রকাশ করতে গিয়ে পূর্ব পুরুষদের বিরুদ্ধে গীবত গাইতে হবে, পাপাচার করতে হবে, মিথ্যা কালিমা লেপন করতে হবে এটা সভ্যতার কোন আচরণে পড়ে না।
বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, দরদীমন, সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং কারিশমার প্রশংসা করেছেন, ৭৩ বৎসরের চাচা খান সাহেব শেখ মোশারফ হোসেন। তাঁর কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অনেক অজানা কথা শুনেছি। বঙ্গবন্ধু এত উদারতা, সহনশীলতা, দরদীমন, মুক্তচেতনা, বুদ্ধিমত্তা, সাংগঠনিক ক্ষমতা, মনমুগ্ধকর যাদুককরী ক্ষমতা ও সাহস কোথায় পেলেন তা জানার জন্য বঙ্গবন্ধুর পূর্ব পুরুষদের বংশ পরস্পরা লতিকার জানা প্রয়োজন মনে হয়েছে, এই জন্য সংশয় সৃষ্টিকারীগন এখনও নিকৃষ্টতম মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে, সেজন্য প্রকৃত সত্য ও তথ্য জানার প্রয়োজন রয়েছে দেশবাশীর।তিন পুরুষের নাম কোন রকমে স্মরণ করতে পারে সাধারণত বাঙ্গালী মুসলমানেরা। বঙ্গবন্ধুর বংশ লতিকার দিকে তাকালে দেখা বঙ্গবন্ধুর উপরে ৮ পুরুষের নাম পরিচয়। এ বংশের পুরুষগনের অতীতের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে বঙ্গবন্ধু এত গুনের অধিকারী হয়েছিলেন কি কারণে।
শেখ আউয়ালঃ শেখ বংশে প্রথম পুরুষ শেখ আউয়াল ইরাকের রাজধানী বাগদাদের হাসনাবাদ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ৪৩০ বৎসর পূর্বে হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রঃ) এর শিষ্যদের সাথে করে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ইরাক থেকে চট্রগ্রামে আসেন। শেখ আউয়াল কয়েক বৎসর চট্রগ্রামে অবস্থানের পর গৌড়ের সুলতানের রাজধানী এবং নদী-বন্দর ঢাকার সোনারগাঁয়ে আসেন। কয়েক বৎসর সেখানে ধর্শপ্রচারের পর স্থানীয় এক মহিলাকে বিয়ে করে সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যান।
শেখ জহির উদ্দিনঃ শেখ আউয়ালের পুত্র শেখ জহির উদ্দিন ও ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে জীবিকা নির্বাহের জন্য কলকাতায় ব্যবসা শুরু করেন। শেখ জহিরউদ্দিন ধর্মপ্রচার ও ব্যবসা উপলক্ষে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি করেন।আঠর শতকেই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার মূল ব্যবসা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।কয়েকটি বাঙ্গালী মুসলমান পরিবার ব্যবসা ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন তন্মধ্যে শেখ পরিবারও অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন।শেখ জহির উদ্দিন ফরিদপুরের খন্দকার পরিবারে বিয়ে করে কিছুদিন বসবাস। ব্যবসায়িক স্বার্থ নিয়ে তৎকালীন জমিদার রানী রাশ মনির সাথে ব্যবসায়িক বিরোধকে কেন্দ্র করে শেখ জহিরউদ্দিন তাঁর স্থায়ী ও ব্যবসায়িক নিবাস কলকাতাতেউ মৃত্যু বরণ করেন। ফরিদপুরের খন্দকার বাড়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলে শশুরবাড়ী।
জান মাহমুদঃ শেখ জহির উদ্দিনের পুত্র জান মাহমুদ ওরফে তেকড়ি ব্যবসা উপলক্ষে তৎকালিন ফরিদপুর জেলার মধুমতির শাখা নদী বাইগারের পাড়ে মনোরম গ্রাম টুঙ্গিপাড়াকে পছন্দ করেন স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলার জন্য। তখন পূর্ববঙ্গে শেখ পরিবারের অনেকেই চলে আসেন, কলকাতায় থেকে যান কেউ কেউ।
শেখ বোরহান উদ্দিনঃ জান মাহমুদ তেকুড়ির পুত্র শেখ বোরহান উদ্দিন বিশেষ করে পাট ব্যবসা করতেন। নিজেদের বড় রড় মালবাহী নৌকায় খুলনা হতে কলকাতায় পাট চালান দিতেন।১৮৫৪ সালে কলকাতা থেকে ইট, সুরকি ও রাজমিস্ত্রী এনে পাকা ৩টি বাড়ী তৈরি করেন শেখ বাড়ীতে। শেখ বোরহান উদ্দিন টুঙ্গিপাড়ার বিখ্যাত কাজী বাড়ীতে বিয়ে করেন।১৯৭১ সালে পাক বাহিনী ধ্বংস করা শেখ বাড়ীর তিনটি পাকাবাড়ীর কংকাল এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে।
শেখ কুদরত উল্লাহঃ শেখ বোরহান উদ্দিনের তিন পুত্র যথা শেখ আকরাম, শেখ তাজ মাহমুদ তেকড়ি ও শেখ কুদরত উল্লাহ ওরফে কদু শেখ। বড় পুত্র শেখ আকরাম শেখ পরিবারের অর্জিত বিপুল পরিমাণ জমির কৃষিকাজে তদারকি করতেন, মেঝ পুত্র ধর্মচর্চা ও স্থানীয় ব্যবসায়ের দেখা-শুনা করেন। পাটের ব্যবসা তুঙ্গে উঠে সুনাম ও সমৃদ্ধি সাথে। ১৫০ টি মালবাহী বড় বড় নৌকার মধ্যে পাট ও মালামাল বোঝাই ৫০ টি নৌকা একত্রে কলকাতা- খুলনা যাতায়াত করত। মধুমতি নদীর পাড়ে নড়াইল এলাকায় ইংরেজের নীল কুঠিরের কুঠিয়ালের পাইক, লাঠিয়াল ও বরকান্দজ নৌবহর আটক রাখাকে কেন্দ্র করে কলকাতা সাব-জর্জ কোর্টে কদু শেখ মামলাকে কেন্দ্র করে কলকাতা হাইকোর্ট হয়ে ১৮৮৬ সালে বিলাতে প্রিভি কাউন্সিলে আপীল বহাল রাখার পর ইংরেজ কুঠিয়ালের ১ পয়সা জরিমানা করার পর ই্ংরেজ বণিক নীলের ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায়। সেই মামলার রায়ের আদেশ বঙ্গবন্ধুর চাচা খান সাহেব শেখ মোশারফ হোসেনের নিকট রক্ষিত ছিল। এই মামলার লড়াই দ্বারা শেখ পরিবারের তেজ, সাহস, জেদ এবং লড়াকু ভাবের ধারণা পাওয়া যায়।
শেখ তাজ মাহমুদঃ শেখ তাজ মাহমুদ এর তিন পুত্র ছিল। শেখ আবদুল মজিদ, শেখ আবদুল হামিদ, এবং শেখ আবদুর রশিদ নসু মিয়া। শেখ আবদুর রশিদ এবং তার পুত্র শেখ মোশারফ হোসেন উভয়েই টঙ্গিপাড়ার পাটগতি ইউনিয়ন বোর্ডে প্রেসিডেন্ট ছিলেন সুদীর্ঘকাল।উভয়ে সমাজ সেবায় প্রসিদ্ধ লাভ করায়, বৃটিশ সরকার পিতাপুত্র উভয়কে “ খান সাহেব উপাধিতে ভুষিত করেন। খান সাহেব শেখ মোশ্রাফ হোসেন বঙ্গবন্ধুর চেয়ে কিছুটা বড় ছিলেন। তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। খান সাহেব মোশারফ হোসেনের বড় পুত্র শেখ কবীর হোসেন রেড় ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তাঁর বড় জামাতা মো. আইয়ুব আলী রাদিয় শ্যীকাইল কলেজের অধ্যক্ষের পদে ছিলেন বহুবৎসর এবং অন্য জামাতা সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান।
শেখ আবদুল হামিদঃ শেখ আবদুল হামিদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু দাদা। তাঁর একমাত্র পুত্র শেখ লুৎফর রহমান ও ৪ কন্যা ছিল। শেখ লুৎফর রহমানের ২ পুত্র, শেখ মজিবুর রহমান, শেখ নাসের এবং কন্যাগণ ফাতেমা বেগম, আছিয়া বেগম, আমেনা বেগম হেলেন এবং খোদেজা বেগম লিলি।খোদেজা বেগম লিলি স্বামী ছিলেন প্রাক্তন সচিব মরহুম সৈয়দ হোসেন। ১৯৭১ সালে যেখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুত্র জয়ের জন্মের সময় ডাকা মেডিকেলে ভর্তি হন, তখন পাক হানাদাররা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলুতেন্নেসা মজিব গৃহবন্দী করে রাখে, পাক সেনারা মেয়ের পাশে থাকার অনুমতি দেই নাই, তখন বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন খোদেজা বেগম লিলি আয়া সেজে শেখ হাসিনার পাশে হাসপাতালে ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানঃ টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়ীতে ১৭ মার্চ ১৯২০ সালের ইং, ২০ চৈত্র ১৩২৭ বাংলা, রোজ মঙ্গলবার,রাত ৮টায় বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহন করেন।বঙ্গবন্ধুর নানা শেখ আবদুল মজিদ বঙ্গবন্ধু নাম রাখেন শেখ মজিবুর রহমান। পিতা-মাতা আদর করে ছেলেকে খোকন বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান মাদারীপুর মুন্সেফ কোর্টে সেরেস্তাদার পরে গোপালগঞ্জে বদলী হয়ে আসেন।তাঁর বাল্যকাল কাটে টুঙ্গিপাড়াতেই। পূর্বে কোটালীপাড়া থানার অধীন ছিল টুঙ্গিপাড়া,পরবর্তীতে গোপালগঞ্জের অন্তর্গত হয়।এর পরে টুঙ্গিপাড়া স্বতন্ত্র থানা হয়েছে।বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়া ও গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন এবং এর পর ১৯৩৪ সালে পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মাদারীপুরে কর্মস্থলের ইসলামিয়া হাইস্কুলে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। ১৯৩৫ সালে গোপালগঞ্জের পাবলিক স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হন।
চোখের অসুস্থতার কারনে শিশু বঙ্গবন্ধুর ৩ বৎসর লেখা পড়া বন্ধ থাকে।১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে ৬ষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি হন।গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলের হেডমাষ্টার শ্রী গিরিশ বাবু জেদী ও দুঃসাহসী ছাত্র বঙ্গবন্ধুকে খুবই স্নেহ করতেন।
fলেখক : ফয়জুল আজিম শিশির
লক্ষ্মীপুর
০১৭২৯৪৮৪৮২৬