বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ


সুবিদ আলী ভূইয়া

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ- এ দুটি নাম, দুটি শব্দ একে অপরের পরিপূরক, যা আজ ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। একটি ছাড়া অন্যটি যেন মূল্যহীন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে মহানায়ক, তিনি বঙ্গবন্ধু, আমাদের জাতির জনক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। তার দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের পথ ধরেই বাঙালি তাদের নিজ আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করে। তার নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি অনুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ তথা পাকিস্তানি আধিপত্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছে আমাদের স্বদেশভূমিকে। সেই কিশোর বয়সেই তিনি নিজ নেতৃত্বকে সংগঠিত করতে সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ রাখেন। ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ মহকুমা পরিদর্শনে আসা বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উপস্থিতিতে কিশোর মুজিব স্কুলের ভাঙা ছাদ দিয়ে পানি পড়া বন্ধে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিজের উপস্থিতি জানান দেন। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নেতৃত্বে আসেন আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের।১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলোনি হিসেবে বিবেচনা করত পাকিস্তানি শাসকরা। সেই থেকে এ দেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে সাহসী মহামানব দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে এসেছেন, যৌবনের একটা দীর্ঘ সময় জেলে কাটিয়েছেন, তার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি। অধিকার আদায়ে প্রতিটি সংগ্রামে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছেন, সফল হয়েছেন। তিনি তার রাজনৈতিক সহকর্মী ও সহযোদ্ধা হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানের মতো মহৎ, সৎ, মহান দেশপ্রেমিকদের পেয়েছিলেন।বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি সামরিক চক্রের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। পাকিস্তানি শাসক চক্রের বিমাতাসুলভ মনোভাব বুঝতে পেরে তিনি ৪৭-এর দেশভাগের পর থেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। সেই স্বপ্ন সামনে রেখে ধীরে ধীরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ড নিয়ে অগ্রসর হন তিনি। ১৯৬৬ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি পেশ করেন। এই ৬ দফাই ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ এবং বাঁচার দাবি। বাংলার মানুষ তাকে ভূষিত করেছিল বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। এই অসাধারণ ভাষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এবারের সংগ্রাম এ কথাটি উচ্চারণ করে তিনি বাঙালিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন একজন বাঙালি, তেমনি ছিলেন একজন ধার্মিক। ইসলামের সুমহান শিক্ষার প্রতি তিনি তার সুদৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলে ছিল এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সুদৃঢ় প্রচেষ্টা। কিন্তু পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী শাসকগোষ্ঠী এবং ইসলামের তথাকথিত লেবাসধারী চক্র সব সময় বঙ্গবন্ধুকে ইসলামবিরোধী বলে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও ইসলামের লেবাসধারী গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং তার নিজ হাতে গড়া দলকে ইসলামবিরোধী বলে প্রচার- প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মকে কখনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাননি বঙ্গবন্ধু। তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সব মানুষের নিজ নিজ ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সে অধিবেশনে তিনি ঘোষণা করেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার নিজ নিজ অধিকার অব্যাহত থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মচর্চা বন্ধ করতে চাই না এবং তা করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। বঙ্গবন্ধু তার স্বল্পকালীন শাসনামলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন, সমকালীন মুসলিম বিশ্বে এর দৃষ্টান্ত বিরল। তিনি ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখন সরকারি অর্থে পরিচালিত মুসলিম বিশ্বের অন্যতম একটি বৃহৎ সংস্থা হিসেবে নন্দিত।ঢাকার বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম পাকিস্তান আমলে ছিল রেসকোর্স ময়দান। এখানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার নামে চলত জুয়া, হাউজি ও বাজিধরা প্রতিযোগিতা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বন্ধ করেন এবং রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে রাখেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষরাজি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বহন করে চলেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অধিবেশনে যোগদান করেন।সদ্য স্বাধীন দেশকে গড়তে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দিন-রাত কাজ করেছেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে শূন্য কোষাগার নিয়ে সচল করেন। উন্নত দেশগুলোর প্রথমদিকের অসহযোগিতাসহ নানা সংকটের মধ্যে দেশকে এগিয়ে নেন। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তার হাতে গড়ে ওঠে একটি আধুনিক সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী। পুলিশ ও আনসারকে একটি আধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়। দেশ গড়তে দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিকভাবে নানা দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দিয়ে।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল একদল পাষণ্ড, যারা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল সুবিধাভোগীদের কাছে। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা দীর্ঘ ৩৫ বছর ওই পাষণ্ডদের আগলে রাখলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বের অনেক উঁচু মানের একজন নেতা। 
বিশ্ব ইতিহাসে যে কজন নেতার নাম সগর্বে উচ্চারিত হয় বঙ্গবন্ধু তাদের অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, আলজেরিয়ার আহমেদ বেন বেল্লা আর কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো রাজনীতিক হিসেবে নিজ নিজ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যেমন সফল, তেমনি বঙ্গবন্ধুও নিজ নেতৃত্বগুণে বাঙালি জাতির জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছেন। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে নানা কারণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডটি ছিল বিশ্বে আলোচিত। এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিল একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা এবং সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিক। তাদের এই ষড়যন্ত্রে দেশী-বিদেশী নানা চক্রও সম্পৃক্ত ছিল। এর প্রমাণ মেলে হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের বিদেশে আশ্রয় লাভের ঘটনায়।বিশ্বের যে কোনো রাজনৈতিক নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান হত্যাকাণ্ডের তুলনায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি ছিল নজিরবিহীন। আমরা যদি আব্রাহাম লিংকনের হত্যাকাণ্ড দেখি- বিল বুথ নামে এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করেছিল। কেনেডিকে হত্যা করেছিল হারবে ওসওয়াল্ড নামের এক সন্ত্রাসী। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করেছিল আকবর নামে এক আফগান যুবক। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল নাথুরাম গডসে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের সঙ্গে তুলনা করলে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের হত্যাকাণ্ডটি নানা কারণেই নজিরবিহীন। এর ব্যাখ্যা দেয়া যায় এভাবে : বিল বুথ লিংকনকে হত্যা করে পালিয়ে যায়, পরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। গান্ধীর হত্যাকারীকে অল্পদিনের মধ্যে ফাঁসি দেয়া হয়। কেনেডির হত্যাকারী ওসওয়াল্ডকে আরেক ঘাতক জ্যাক খুন করে। অথচ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শাস্তি পেতে ৩৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এজন্য ১৩ বছর আইনি লড়াই করতে হয়েছে। মোট ১২ জনের মধ্যে ৫ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে, বাকিরা এখনও পলাতক। খুনিদের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে কলংকের দায়মুক্তি আপাতত ঘটলেও তাদের দীর্ঘদিনের সহায়তাকারী, পৃষ্ঠপোষক এবং চেতনার ধারক যারা, তাদের চিহ্নিত ও বিচার না করা পর্যন্ত একে চূড়ান্ত দায়মুক্তি বলা যাবে না। আমি মনে করি, হাতেগোনা কয়েকজন খুনিকে শাস্তির মধ্য দিয়েই এই কলংকজনক অধ্যায়ের শেষ হয়নি। খুনিদের পৃষ্ঠপোষকরা এখনও সক্রিয়, তাই চূড়ান্ত দায়মুক্তি এখনও হয়নি। আমরা ইতিহাসের দায়মুক্তি পেয়েছি; কিন্তু এই দায়মুক্তির প্রকৃত সুফল আসবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে।মহামানবের মৃত্যু নেই। তারা বেঁচে থাকেন কর্মের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুও তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, জনগণের প্রতি ভালোবাসা আর একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। যতদিন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পৃথিবীর বুকে পরিচিত থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃথিবীর বুকে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কবির ভাষায় বলতে হয়-যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমানততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

SUMMARY

1319-B4.jpg