বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ


আকবর হোসেন 
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একটি বাদ দিয়ে আরেকটি নয়। বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাংলাদেশের স্থপতি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
 
মূলত, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের চেতনার উন্মেষ ঘটে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে। এই মামলায় যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয় তখন থেকে মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্র পরাজিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি দিয়ে তার দাবি মতো নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নানা শোষণ আর বৈষম্যের শিকার হতে হয়। প্রথমেই আঘাত আসে বাংলা ভাষার ওপর। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। রাজপথ রক্তাত্ব হয়। শহীদ হন অনেকে। বিশেষত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের চরমভাবে দাবিয়ে রাখা হয়। তখন পাকিস্তানের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক ছিল ২২ পরিবার। দেশের কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর হাতে। চাকরির ক্ষেত্রেও বাঙালিদের বঞ্চিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির জন্য বৈষম্যের বিষয়টি বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। তিনি দেশের আনাচে- কানাচে আওয়ামী লীগের ছয় দফা নিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। দলীয় নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক একতাই গভীর হয়ে ওঠে, তিনি নাম জানতেন না এমন নেতা খুঁজে পাওয়া যেত না। 
সত্তুরের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু জয়লাভ করলেও পাকিস্তানি শাসক চক্র ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে। ১৯৭১-এর ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেও আকস্মিকভাবে তা স্থগিত করা হয়। ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। এর সঙ্গে চলতে থাকে জুলফিকার আলী ভুট্টুর ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানিরা কিছুতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা দিতে সম্মত নয়। 
এরপর বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে এতটাই ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন যে তখন তার ঘোষণাই ছিল দেশের আইন। সব সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত, ব্যাংক-বীমা, কলকারখানা সবকিছু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মতো চলতে থাকে। পাকিস্তানিরাও মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়। এর সঙ্গে যোগ দেয় এ দেশের অবাঙালিরা। ৩ মার্চ বাঙালিদের মিছিলে গুলি চালালে রংপুরের ১২ বছরের যুবক শংকু সমজদার নিহত হয়। বলা চলে স্বাধীনতার প্রথম শহীদ। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তার ১৯ মিনিটের জ্বালাময়ী ভাষণে দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হন। 
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ একদিকে জাতিকে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য উজ্জীবিত করেছে অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে বুঝিয়ে দিয়েছে তোমাদের দিন শেষ। এই ভাষণটিতে বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না দিয়ে দেশদ্রোহিতার দায় এড়িয়ে সুকৌশলে বলে দিয়েছেন- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবা।’ আসলে এই ভাষণের মাধ্যমে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়ে দেন। পাকিস্তানিরাও মরিয়া হয়ে পোড়া মাটি নীতি গ্রহণ করে। তারা যে কোনো মূল্যে এ দেশের শাসন ক্ষমতা ধরে রাখবে। তারা ভেতরে ভেতরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। 
২৫ মার্চ আলোচনা ভেঙে যায়। বঙ্গবন্ধু অবস্থা বুঝে বিডিআর ও পুলিশ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। যা পরে ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া প্রচার করেন। এবার সুযোগ পেয়ে ইয়াহিয়া খান দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। সারা দেশে অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যা কার্যক্রম শুরু করে গভীর রাত থেকে। নির্বিচারে হত্যা করা হয় নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দেশের ছাত্র, যুবক, জনতা যে যেভাবে পেরেছে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। সীমান্তে মুক্তাঞ্চল এলাকা এবং ভারতের সেনা ক্যাম্পগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা কৌশলে হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে হানাদার বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে তোলে। গোটা বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ভারত-বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী যৌথ মিত্রবাহিনী গঠন করে সাঁড়াশি আক্রমণ পরিচালনা করে। মাত্র দুই সপ্তাহের সম্মুখযুদ্ধে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়। শেষ পর্যন্ত ৯ মাস যুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রায় ১ লাখ সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, মনসুর আলী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এমএজি ওসমানীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ভারতের মহান নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দেশে-বিদেশে যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে নিরাপদ আশ্রয় ও পুনর্বাসন করেন।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে আসেন। শুরু হয় দেশ গড়ার পালা। ধ্বংসস্তূপ থেকে মাত্র সাড়ে ৩ বছরে তিনি দেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ভিত্তি তৈরি করেন। কিন্তু অচিরেই তার বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত চলতে থাকে। কিছু রাজনৈতিক দল প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর মদদে তার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু দিশেহারা হয়ে পড়েন। তিনি সেনাবাহিনীকে পাশ কাটিয়ে রক্ষী বাহিনীকে দায়িত্ব দেন। অন্যদিকে পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীতে পদায়ন করলে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধু দেশের মঙ্গল চিন্তায় রাশিয়ার মডেলে এক দলীয় বাকশাল সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে শেষ করে দিতে দ্বিধা করলেন না। ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর এক দল উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যায়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বিশ্ববাসী থমকে যান। কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি মীরজাফররা এভাবে ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দেবে। একটি সদ্য স্বাধীন জাতিকে এতিম করে দেবে। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। তবে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ যত দিন থাকবে তত দিন বঙ্গবন্ধুও থাকবেন। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য। 
বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে কেবল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ও দেশের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, সমকালীন বিশ্ব নেত্রীরা বঙ্গবন্ধুকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন।


আকবর হোসেন : মুক্তিযোদ্ধা

SUMMARY

1315-1.jpg