ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
ভূমিকা : হাজার বছরের পথ পরিক্রমায়, ইতিহাসের গর্ভে শত সংগ্রাম শেষে নদীমাতৃক এ জনপদ ছিন্ন করেছে পরাধীনতার শৃঙ্খল। গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের অপুষ্ট ও অপরিণত প্রয়াসের পর এই সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা জনপদের স্বাধীনতায় সার্থক যে মহানায়কের দেখা মিলেছে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই জাদুকরী নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে পায় নিজস্ব পতাকা এবং মানচিত্রে স্বাধীন দেশ। কিন্তু কেবল দেশ বা ভূখ- দিয়ে স্বাধীনতা আসে না। সত্যিকারের স্বাধীনতা পেতে হলে চাই দূরদর্শী উন্নয়ন-দর্শন। নচেৎ ভৌগোলিক স্বাধীনতা হয়ে উঠে কন্টক শয্যার মতো। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রজ্ঞায় এই সত্য উপলব্ধ হয়েছে গভীরভাবে। তাই তিনি তাঁর স্বাধীন চেতনায় উন্নয়নের রূপকল্প নির্মাণ করেন।
সদ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত, প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হওয়া একটি দেশকে জাগিয়ে তুলতে, তার প্রাণের স্পন্দন ফিরিয়ে আনতে এবং প্রতিটি নাগরিকের মুখে ক্ষুধার অন্ন তুলে দিতে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন দর্শন আবশ্যক ছিল, বঙ্গবন্ধুর আশ্চর্য প্রজ্ঞায় তা পেয়েছিল এদেশের জনগণ। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী দোসরের নির্মম প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণে বাঙালি ও বাংলাদেশ সেই অতি আশ্চর্য উন্নয়ন-প্রদীপের আলো হতে বঞ্চিত হলো শৈশবেই। পরিণামে দীর্ঘ অমানিশা রাত আর হানাদারি অাঁধার এলো নেমে। স্বাধীনতার সাতচলি্লশ বছর পরে এসে আজ তাই বারে বারে অতৃপ্তি আর অপ্রাপ্তি জেগে উঠে বাঙালি মানসে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অকৃত্রিম সুহৃদ জাপান ও জাপানের জনগণ (নাওসি তামায়া প্রমুখ) আজও আক্ষেপভরে বলে, 'মিঃ রহমান (শেখ মুজিবুর রহমান) বেঁচে থাকলে এতদিনে বাংলাদেশ হয়ে যেত আজকের জাপানের কাছাকাছি। তাঁর বিচক্ষণতা অন্য বিশ্বনেতাদের চেয়ে কম ছিল না। '
রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে দীর্ঘ একুশ বছর বঙ্গবন্ধু ও তাঁর উন্নয়ন-দর্শন নিষিদ্ধ এবং উপেক্ষিত থাকার পর আজ আবার তারই প্রিয় কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে জেগে উঠেছে এদেশ। শুরু হয়ে গেছে সকল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর অলোকসামান্য উন্নয়ন-দর্শনের নান্দনিক চাষাবাদ। বাংলাদেশ আজ তাই বিশ্বসভায় ফিরে পেয়েছে তার কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা। পিতার স্বপ্ন আর দর্শন এবং কন্যার প্রাজ্ঞ বাস্তবায়নে আজ বাংলাদেশের বাঘের গর্জনে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে উন্নয়নের দিকচক্রবাল।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ :
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে আলাদা করা কঠিন এবং সত্যিকার অর্থে তা অসম্ভবই বটে। যদি ঊনিশশো কুড়ি সালের সতের মার্চ মধুমতী-বাইগারসিক্ত টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হতো তবে ইতিহাসে বাংলাদেশ নামে কোনো স্বাধীন দেশের জন্ম হতো না। আজ খেলার মাঠে যে টাইগাররা গর্জায়, তাদের গর্জন শুনতে পেতো না বিশ্ব। শৈশবে গ্লুকোমা আর বেরিবেরিতে আক্রান্ত হওয়া লিকলিকে কিশোর যদি কালের পরিচর্যায় বঙ্গবন্ধু হয়ে না উঠতো তবে পৃথিবী বাংলাদেশ নামের এই জাতিরাষ্ট্রকে পেতো না কোনোকালে। শত রাষ্ট্রভাষা হলেও বাংলা তখন হয়ে উঠতো না মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড।
এ মাটির জল-হাওয়া, গাছ-পাখি, নদী-বন একজন বঙ্গবন্ধুর মনন ও মানস নির্মাণ করলেও বঙ্গবন্ধুই কালের পরিক্রমায় ফুটিয়ে তোলেন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের তিনিই স্থপতি, তিনিই জনক। সময় নির্মাণ করেছে শেখ মুজিবকে আর শেখ মুজিব তৈরি করেছেন বাংলাদেশ। কাজেই এক অর্থে বাংলাদেশ শেখ মুজিবের দুহিতা। বঙ্গবন্ধু তাই বাংলাদেশের চেয়েও বড়। তাঁর প্রযত্নই বাংলাদেশের প্রযত্ন। এ কারণেই বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে লোকে চিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে। মেয়েকে যেমন বাবার নামে চিনে তেমনি বাংলাদেশকে চিনে বঙ্গবন্ধুর নামে। সবাই বলে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। কেউ বলে না বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু। তাই বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক মা-ছেলের নয় বরং বাবা-মেয়ের।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শন : অঙ্কুরোদগমকাল
'উন্নয়ন' শব্দটি একটি ব্যাপক ও বিশাল বিস্তৃতি সম্পন্ন প্রত্যয়। এর সামগ্রিক সংজ্ঞায়ন কঠিন বৈকি। এক এক সেক্টরের বিশেষজ্ঞের কাছে এর ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা এক এক রকম।
অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি খাতওয়ারী উন্নয়নের সংজ্ঞা এককভাবে কোন সামগ্রিক উন্নয়নকে পরিস্ফুটিত করতে পারে না। তবে একটি রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন বলতে আমরা মোটের উপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের সমন্বিত রূপকেই বুঝি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের আওতায় কৃষি, শিল্প, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি খাতের অন্তর্ভুক্তি যেমন থাকে তেমনি রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রাপ্তিসমূহ মুখ্য ভূমিকা রাখে। মানবিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও মানব সম্পদ উন্নয়নের বিষয়গুলো বিধৃত থাকে। উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হলে চাই উন্নয়ন-দর্শন। সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত উন্নয়ন-দর্শন ব্যতিরেকে একটি জাতিরাষ্ট্রকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নয়ন-দর্শন এই নদীমাতৃক ভূগোলের মাটি-জল-হাওয়া সঞ্জাত। তাঁর উন্নয়ন-দর্শনে তাই লেগে আছে সোঁদা মাটির গন্ধ। এই দর্শন বাঙালির স্বকীয়তাকে ধারণ করে এবং বাঙালির আত্মজাগরণের প্রেরণাকে উদ্দীপ্ত করে। কেমন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু গড়তে চেয়েছিলেন তা যদি আমরা তলিয়ে দেখি তবে বুঝতে পারি, বঙ্গবন্ধু ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, সুস্থ সবল, জ্ঞান চেতনাসমৃদ্ধ, কোনরকম ভেদবৈষম্যহীন, শোষণহীন, অসামপ্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানুষের উন্নত এক বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর এই উন্নয়ন-দর্শনের বীজ রোপিত হয়েছিল স্বাধীনতার আগে। যখন উত্তাল পূর্ববাংলা জেগে উঠেছিল নিজেদের অধিকার আদায়ে মিছিলে মিছিলে রাজপথ উত্তপ্ত করে, তখনই বঙ্গবন্ধু পেশ করেন তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা। এই ছয়দফাই বস্তুত বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনের উর্বর বীজতলা। তারও আগে নতুন চীনের তৃতীয় জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষায় প্রদত্ত ভাষণের মাধ্যমে প্রকটিত ও প্রকাশিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের উষ্ণ প্রস্রবণ তাঁর উন্নয়ন দর্শনের অঙ্কুরোদগমে জাগিয়ে তোলে প্রাণ। ঊনিশশো সাতান্ন সালে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার ইতিহাসেই লেগে আছে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনের সূচনা-পদক্ষেপ। তাই বলা যায়, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের উন্নয়ন-দর্শন ঊনিশশো পঞ্চাশ হতে ঊনিশশো সত্তরের শেখ মুজিবের প্রাজ্ঞ চেতনায় উন্মেষকাল অতিক্রম করে যা পরবর্তীতে অভিজ্ঞতা ও সময়ের সম্ভাবনা গায়ে মেখে আরো নিরেট এবং নিখাদ হয়ে উঠে।
সদ্যোজাত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন :
ঊনিশশো একাত্তরের মার্চে যখন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক প্রকার নিশ্চিত, তখনই বঙ্গবন্ধু তাঁর সেই মহাকাব্যিক ভাষণে উন্নয়ন-দর্শনের এক তীব্র আলোকরশ্মির বিকিরণ ঘটান। তিনি যখন বলেন, 'বাংলার মানুষকে আর দাবায়া রাখতে পারবা না', তখনই মূলতঃ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রগতির পথ রচিত হয়ে যায়। মূলতঃ বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের অমর ভাষণকাব্যেই সূচিত হয় বাঙালির আধুনিক রেনেসাঁ। তারই পথ ধরে বঙ্গবন্ধু এক পর্যায়ে তাঁর ভাষণকাব্যে ঘোষণা দেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম'। এই অতি নান্দনিক, স্বপ্নময় ঘোষণার মূল সুর কিন্তু দূরদর্শী। এই ঘোষণা আমাদের জানিয়ে দেয়, সাতচলি্লশের সংগ্রাম ছিলো ভুল স্বপ্নে বিভোর হয়ে ইংরেজ বিতাড়নের খোয়াব। কিন্তু আমাদের মূল লড়াই কেবল স্বাধীন ভূখ- পাওয়াতে সীমাবদ্ধ নেই। আমাদের সামগ্রিক মুক্তি দরকার। উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে নিজেদের নির্মাণ করতে হলে অর্থনৈতিক মুক্তি, মূল্যবোধের মুক্তি, মনন চর্চার মুক্তি সহ সকল মুক্তি অপরিহার্য। এই সামগ্রিক মুক্তি নিয়েই বঙ্গবন্ধুর সমৃদ্ধ উন্নয়ন-দর্শন।
একটি শোষণমুক্ত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার জন্যে তিনি প্রণয়ন করেন সংবিধান যাতে জনগণকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্র জনগণের সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্যে অঙ্গীকারাবদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনকে সংজ্ঞায়িত করা যায় এভাবে, উন্নয়ন হবে মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তিভিত্তিক স্বাধীনতা-মধ্যস্থতাকারী একটি প্রক্রিয়া যেখানে গরীব-দুঃখী-মেহনতি সবমানুষের জন্যে পাঁচ ধরনের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। এর মধ্যে থাকবে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক সুযোগ, সামাজিক সুবিধাদি, স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা-সুরক্ষার স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর দর্শন অনুযায়ী প্রকৃত উন্নয়ন হলো আলোকিত মানুষের সংঘবদ্ধ ও সংহতিপূর্ণ সামাজিক আর্থনীতিক ব্যবস্থা।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও সমাজ বিনির্মাণের বিষয়টি ছিল অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। এ দর্শনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ-বয়স-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষের সুযোগের সমতার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে নীতি-নৈতিকতার নিরিখে সব মানুষ মানুষ হিসেবে সমান। যে কারণে বাহাত্তরের সংবিধানে জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর উন্নয়ন দর্শনের ভিত্তিতেই চেয়েছিলেন এমন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে যে বাংলাদেশে জন্মসূত্রে কেউ দরিদ্র থাকবে না, যে বাংলাদেশে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি হবে চিরস্থায়ী, যে বাংলাদেশ হবে চিরতরে ক্ষুধামুক্ত-শোষণমুক্ত, যে বাংলাদেশ হবে বঞ্চনামুক্ত-সমতাভিত্তিক-অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশে মানবমুক্তি নিশ্চিত হবে এবং তা হবে সুসংহত। বাংলাদেশে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা দূর করে সব মানুষের সুযোগের সমতা নিশ্চিত হবে এবং এই বাংলাদেশ হবে স্বনিভর্র-স্বয়ংসম্পূর্ণ, এক কথায় 'সোনার বাংলা'।
মুজিববাদ ও উন্নয়ন-দর্শন :
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের মূল শক্তি তাঁর দ্বারা উদ্ভাবিত মুজিববাদ। এই মুজিববাদ হলো একটি ইউটোপীয় রাষ্ট্রের নীলনকশা যা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হলে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি জাতিরাষ্ট্র সহসা পরিণত হতো একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে, যাতে টেকসই আর্থ-সামাজিক কাঠামো তৈরি হতো।
মুজিববাদের প্রথম স্তম্ভ ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ যার মাধ্যমে মানবিক মানুষ তৈরির একটা অবিরত প্রক্রিয়া ছিলো। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' হতে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর মতে পশ্চিম পাকিস্তানীরা নির্মম ও অমানবিক হওয়ার মূল কারণ তাদের দেশের রুক্ষ মরু প্রকৃতি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের নদীমাতৃক ভূগোলের কারণে এদেশের মানুষের মনে কোমলতা ও মানবিকতা অধিক। বঙ্গবন্ধুর মুজিববাদের ঘ্রাণম-িত উন্নয়ন-দর্শন তাই একটি মানবিক বাংলাদেশের কথা বলে।
মুজিববাদের দ্বিতীয় স্তম্ভ ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতা যার মূলনীতি হলো ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। এর মাধ্যমে সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে একটা সমপ্রীতির বন্ধন তৈরি করার প্রয়াস আছে যাতে দেশ গঠনের কাজে সবাই এক হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলাতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষতার মূল সুর ছিলো ধর্ম নিয়ে যাতে কেউ বাড়াবাড়ি না করে এবং ধর্ম কখনো যাতে মানবিক বাঙালির মধ্যে বিভেদের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।
মুজিববাদের তৃতীয় স্তম্ভ গণতন্ত্র যা দ্বারা রাষ্ট্রের সকল কাজে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারলেই রাষ্ট্রের উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
মুজিববাদের চতুর্থ ও শেষ স্তম্ভ ছিলো সমাজতন্ত্র যা রাষ্ট্রের মালিকানায় শিল্প ও কৃষির সমবন্টন, রাষ্ট্র কর্তৃক সকলের খাদ্য নিশ্চিতকরণের উপায় হিসেবে অনুসৃত হতো। যদিও বঙ্গবন্ধু নিজে কোন কমিউনিস্ট ভাবধারার ছিলেন না তবুও তিনি অনুধাবন করেছিলেন শ্রমিক শ্রেণির উন্নয়নের জন্যে সমাজতন্ত্রের প্রতিফলন তাঁর রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ঘটাতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনে চীন সফরের প্রভাব :
মহান মুক্তিযুদ্ধে চীন যদিও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে আমাদের সমর্থন করেনি, তবু চীনের উন্নয়নধারা বঙ্গবন্ধুর মননে রেখাপাত করেছিল গভীরভাবে। ঊনিশশো বায়ান্ন সালের পহেলা অক্টোবর চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তৃতীয়বার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু একটি প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে গেলে তিনি তাদের উন্নয়নচক্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁর আত্মজীবনীর জবানিতে আমরা জানতে পারি, চীনে এখন আর আফিং খেয়ে কেউ ঘুমায় না। এই আফিং কিন্তু মাদক আফিং নয়, তিনি ধর্মীয় উগ্রবাদের কথা বলেছেন। যার ধর্ম তার কাছে। ফলে স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরে তারা এগিয়ে গেছে প্রভূতভাবে এবং আগামী দুইহাজার কুড়ি সাল নাগাদ চীন হয়ে উঠবে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি। চীনে এক মধ্যবিত্ত ঘরের হালহকিকত দেখে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রই তাঁর নতুন দেশের জন্যে কার্যকরী।
তাছাড়া চীনাদের তৎকালীন জাতীয়তাবাদী চিন্তা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি যখন শেভের জন্য কোন বেস্নড খুঁজে পেলেন না, তখন তিনি বুঝে যান, নিজেদের উৎপাদন ও শিল্প বিপ্লবের দিকে তারা মনোনিবেশ করেছে। তাদের স্বদেশী পণ্যের ব্যবহার আর তৎকালীন পূর্ব বাংলায় কোরিয়ান ও জাপানী পুতুল কিনার হিড়িক তুলনা করে তিনি ব্যথিত হলেও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং তাঁর পরবর্তী কালের উন্নয়ন-দর্শনে তা প্রয়োগ করেন। তিনি ধর্মের আফিংয়ে বুঁদ হয়ে থাকা জাতিকে এতো দ্রুত জাগতে দেখে অভিভূত হন এবং সর্বস্তরে শৃঙ্খলার বিস্তার দেখে আপ্লুত হন। তিনি স্বাধীন চীনের মানুষের চোখে হতাশা নয়, আশা দেখেছেন এবং তাদের একজন রিকশা ওয়ালার একটি সামান্য কলম ফেরৎ দেওয়ার সততায় বিমুগ্ধ হন। বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশকে সেই নবজাগ্রত চীনের আদলে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ :
চীন সফরে আমজনতার সততার নিদর্শন দেখে বঙ্গবন্ধু তাঁর উন্নয়ন-দর্শনে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণের দিকে জোর দিয়েছিলেন অধিক। তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আক্ষেপ করতে শুনি, 'মানুষ পায় হীরার খনি আর আমি পেলাম চোরের খনি। ' তার মানে তিনি যে তাঁর জনগণকে চোর বলেছেন তাই নয়। কেননা তিনি একসময় বলেছিলেন, তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তিশালী দিক হচ্ছে তিনি তাঁর দেশের মানুষকে খুব বেশি ভালোবাসেন। আবার তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতার দিকও এটি। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একথাও বলেছেন যে, যে দেশে দুইতলা থেকে নীচতলায় আসতে আসতে কুড়ি টাকা কমে দশ টাকা হয়ে যায় সেই দেশে উন্নতি কঠিন। আর এ কারণেই ঊনিশশো বাহাত্তর সালে প্রদত্ত এক ভাষণে তিনি রাজনীতিবিদ, আমলা ও শিক্ষিত মানুষের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরা দুর্নীতি করে না, দুর্নীতি করে শিক্ষিত মানুষেরা। তাই তাঁর উন্নয়ন-দর্শনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার ছিল পরিষ্কার ভাবনা। ঊনিশশো বাহাত্তর সালের চার নভেম্বর স্পিকার মুহম্মদুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবিধান বিল (গৃহীত) এর উপর দেয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, 'আমরা এমন শাসনব্যবস্থা কায়েম করব, যেখানে প্রকাশ্য আদালতে বিচারের ব্যবস্থা থাকবে'।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব :
বঙ্গবন্ধু একজন ধীমান রাজনীতিবিদ ছিলেন। মাত্র তেরশ চৌদ্দ দিনের শাসনে তিনি রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত উন্নয়নে হাত দিয়েছেন, রাষ্ট্রের আমূল সংস্কার করেছেন। কিন্তু তিনি একসময় বুঝতে পারলেন, স্বাভাবিক পন্থায় একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিরাষ্ট্রকে টেনে তোলা যাবে না। এর জন্যে চাই বিশেষ বিপ্লব। তাঁর এই বিপ্লবে কৃষকেরা, শ্রমিকেরা মূল নায়ক। তিনি চীনে দেখেছেন, দেশ গঠনে কৃষক-শ্রমিকের কী নিরন্তর পরিশ্রম। তাই তিনিও বাংলাদেশ গঠনে তৈরি করলেন বাকশাল তথা বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। তিনি তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে এই জাতিরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির ডাক দেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কৃষির প্রাণ ভোমরা গ্রামকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং সমবায় কৃষির মাধ্যমে গ্রাম ও কৃষককে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই কাঠামোতে প্রতিটি গ্রাম হবে একটি সমবায় এবং সরকার এই সমবায়গুলোতে বীজ, কীটনাশক, সার ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমে কৃষিকে কার্যকর করে তুলবেন। উৎপাদিত পণ্য হবে তিনভাগ যার একভাগ পাবে জমির মালিক, একভাগ পাবে কৃষক এবং একভাগ পাবে সরকার। এর ফলে জমিহীন কৃষকেরও জীবিকার সংস্থান করা যেতো।
দ্বিতীয় বিপ্লবের আওতায় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশ বলে ষাটটি জেলার ঘোষণা দেন এবং তাতে একজন করে গভর্নর নিয়োগ দেন, যারা ঐ জেলার প্রশাসনিক কর্মকা-ের মূল ব্যক্তি। মূলত কেন্দ্রের সাথে তৃণমূলের দূরত্ব কমাতে তিনি এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং মহকুমাগুলো জেলায় পরিণত হলে উন্নয়ন বিকেন্দ্রীভূত হবে ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হবে। তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের অন্যতম একটি লক্ষ্য ছিল বিচারবিভাগে মামলার জট কমানো এবং এর মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি কমানো।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনে দ্বিতীয় বিপ্লবের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার। কৃষক, মজুরসহ সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির রাজনৈতিক চেতনা লালন ও চর্চা করতেন তিনি। ভোগবাদ, পুঁজিবাদ ইত্যাদি ব্যক্তিতান্ত্রিক চেতনা ও চর্চার অবলুপ্তি ঘটিয়ে একটি সাম্যবাদী ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি ডাক দেন দ্বিতীয় বিপ্লবের। বঙ্গবন্ধুর নিজের জবানিতে আমরা পাই, তিনি বলেছেন, "কেন সিস্টেম পরিবর্তন করলাম? সিস্টেম পরিবর্তন করেছি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। সিস্টেম পরিবর্তন করেছি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্য। 'এ'থেকে একথা পরিষ্কার, বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শন আর দ্বিতীয় বিপ্লব যেন একই সূত্রে গাঁথা, যেন সাইকেলের দুই চাকা, যাদের প্রগতি বিনির্মাণ করে সমৃদ্ধি।
বঙ্গবন্ধু ও আজকের বাংলাদেশ :
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করতে এবং পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে তুলতে। তিনি বিনামূল্যে বই বিতরণ চালু করেছিলেন। নারীশিক্ষার জন্যে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনে বিশেষ স্থান ছিলো। আজকের বাংলাদেশে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক এবং নবম হতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষার আওতায় না আসলেও আজ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে বই বিতরণ চালু হয়েছে। উৎসবমুখরতার মাধ্যমে বই বিতরণ বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনে বিধৃত শিক্ষাকেই পরিস্ফুটিত করে তোলে। মেয়েদের জন্যে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করে আজ সরকার বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনের প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট আছে। যদিও বঙ্গবন্ধু একমুখী শিক্ষার প্রচলন করতে চেয়েছেন, কিন্তু আজকের বাংলাদেশে তিনটি ভিন্নধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে যা ভেদ-বৈষম্যকে এখনও জাগিয়ে রেখেছে। তবে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিভেদ হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু উন্নয়ন ও উৎপাদনের স্বার্থে কর্মমুখী শিক্ষার প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। আজ সরকার যুব উন্নয়নের মাধ্যমে সেই দর্শন বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিলো সবল ও সুস্থ জাতি গঠন। আর এজন্যে তিনি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেছিলেন। আজকের বাংলাদেশে সেই কমিউনিটি ক্লিনিক আবার চালু হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবা আজ ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। বঙ্গবন্ধু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের যে চিন্তা রেখে গেছেন তা আজ সত্যিকার অর্থেই বাস্তবায়িত হয়েছে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বর্তমানে এক দশমিক তিন-সাত শতাংশে নেমে এসেছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সকল উন্নয়নসূচকের অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় শেখ হাসিনার বিশেষ অবদানের জন্যে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক চ্যাম্পিয়ান অব দ্য আর্থ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। এই পুরস্কার প্রদানকালে ইউনেপ-এর নির্বাহী পরিচালক আচেম স্টেইনার শেখ হাসিনাকে
অনুপ্রেরণাদানকারী নেতা হিসেবে অভিহিত করেন। যে অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও দর্শন বঙ্গবন্ধু সৃষ্টি করে গেছেন তা আজ সফল হয়েছে। আজ এদেশে 'ধর্ম যার যার উৎসব সবার' এই কথাটি সত্যিকার অর্থেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সরকার আজ যে বোনাস প্রদান করছে তাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রাণ ফিরে পেয়েছে। যে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু তাঁর উন্নয়ন-দর্শনের মাধ্যমে দেখেছেন তা আজ সফল হওয়ার পথে। আজ সবার মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে এবং দারিদ্র্যের হার শতকরা বাইশ শতাংশে নেমে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আজ নারীদের প্রভূত ক্ষমতায়ন হয়েছে। নারী আজ রাজনীতি ছাড়িয়ে সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছে। আজ নারীরা বিমান চালায়, রেল চালায়, দেশ চালায় এমনকি পর্বতশৃঙ্গেও আরোহন করে।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে শেখ হাসিনার ভূমিকা :
বাবার দেয়া উন্নয়ন-দর্শন বাস্তবায়নে তাঁর প্রিয় কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর। তিনি তাঁর বাবার স্বপ্ন পূরণে নির্মাণ করেছেন যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু, নিজেদের অর্থায়নে বিশ্বব্যাংককে চোখ রাঙিয়ে নির্মাণ করছেন পদ্মাসেতু। পাশাপাশি যানজট কমিয়ে আনতে তৈরি করেছেন নান্দনিক উড়াল সেতু। আকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-এক পাঠিয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছেন দেশের মানুষকে নিয়ে। তাঁর হাতেই আজ এগিয়ে যাচ্ছে মেট্রো রেলের কাজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করে তিনি হয়ে উঠেছেন উন্নয়নে অদম্য। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কর্ণফুলি টানেলের মতো অকল্পনীয় স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে তিনি বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনকে দৃশ্যমান করে তুলেছেন পৃথিবীর কাছে। স্কুল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে তিনি আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে করে তুলেছেন নিরাপদ। তাঁর দূরদর্শিতায় আজ আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাত দশমিক আট-ছয়। বাবার মতোই প্রজ্ঞা ও দর্শন দিয়ে তিনি আজ পরিণত হয়েছেন বিশ্বনেতায়। গ্রামীণ কৃষকের জন্যে তিনি স্থাপন করেছেন 'পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক'। বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা এবং ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে চাল বিতরণ করে তিনি দূর করেছেন ক্ষুধা। তাঁর দূরদর্শিতায় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আজ আর মঙ্গা বলে কিছু নেই। বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান 'মুক্তিযোদ্ধা'দের ভাতা প্রদান, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেঙ্ নির্মাণের মাধ্যমে তিনি বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। তাঁর যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বনেতাদের কাছে পেয়েছে সমীহ এবং জাতির জনকের কন্যা তাঁর পিতার উন্নয়ন-দর্শন বাস্তবায়ন করে আজ বিশ্বের একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আগে যেখানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিংবা কানাডার প্রেসিডেন্ট প্রমুখের সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছবি তুলতে পারলে বর্তে যেতেন এখন সেখানে তারাই বরং যেচে সেল্ফি তুলতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করেন। জাতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু এই সম্মানটুকুই চেয়েছিলেন বাঙালিদের জন্যে। তাঁর কন্যা আজ পিতার সেই দর্শন বাস্তবায়নে যথেষ্ট সফল।
বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি, একটি বাড়ি একটি খামারসহ দশটি অগ্রাধিকার প্রকল্প এবং সতেরটি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট নিয়ে আজ শেখ হাসিনা যথাবেগে এগিয়ে চলেছেন উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে। টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত্তি শান্তি। জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদন এবং জাতিসংঘে শান্তি-মডেল উপস্থাপন সেই টেকসই উন্নয়নের স্বপ্নকে সত্যি করে তোলে। তিনি একদিকে যেমন কঠোর হাতে জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল করেছেন তেমনি অন্যদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী হয়ে উঠেছেন মাদার অব হিউম্যানিটি। তিনি দশ টাকায় চাল আর দশ টাকায় কৃষকের ব্যাংক হিসাব খুলে দেয়ার সুযোগ দান করায় আজ সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে একটি উন্নয়ন-দর্শনের ছড়া-
দশ টাকায় ব্যাংক হিসাব আর
দশ টাকায় চালে
পিতার স্বপ্ন সত্যি হলো
শেখ হাসিনার কালে।
উপসংহার :
বঙ্গবন্ধু এক আশ্চর্য জাদুকর। তাঁর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে বাঙালি শুধু স্বাধীনতাই পায়নি, বরং বাংলাদেশ আজ তাঁর উন্নয়ন দর্শনের উপর ভর করে এগিয়ে চলেছে ভিশন-২০২১ ও ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে। আরেক মহান নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর চোখে হিমালয়সম মহান বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্প মেয়াদের শাসনে যা শুরু করেছিলেন তা দেশকে গড়ার জন্যে যথেষ্ট। যারা তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে তারা জানে না, জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে তাঁর আদর্শ এবং উন্নয়ন-দর্শন অধিকতর শক্তিশালী ও জীবন্ত। তাঁরই সুযোগ্যা কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে জাতির জনকের সকল স্বপ্ন আর দর্শন আজ বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে। পিতা-পুত্রীর এই যুগল নেতৃত্বের সুষমায় আজ তাই পরাজিত পাকিস্তানীদের মুখ দিয়ে সময়ের সাথে সাথে বের হয়ে আসে, 'আমরা সুইজারল্যান্ড হতে চাই না, আগামী দশ বছরে আমরা বাংলাদেশ হতে চাই। ' জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্যে অত্যন্ত গৌরবের। একথা শোনার পরে আজ আর বলতে হয় না, পিতার স্বপ্ন আর দর্শনের শকটে চড়ে কন্যা গড়েছেন এক নতুন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু যদি হন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, তবে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা হলেন আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার।
পিতার স্মৃতিচারণে শেখ হাসিনা একটা কথা প্রায়ই বলেন। তাঁর পিতা তাকে বলতেন, 'শেষ জীবনে আমি গ্রামে থাকবো। তুই আমাকে দেখবি। আমি তোর কাছেই থাকবো' তাঁর পিতার এই আবেগমথিত কথা আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়ে ফলেছে। আজ বঙ্গবন্ধু শুয়ে আছেন তাঁর প্রিয় টুঙ্গীপাড়া গ্রামে। আর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা পিতার সকল স্বপ্ন আর দর্শনকে ধারণ করে গড়ে তুলেছে আধুনিক বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু আজ তাঁর প্রিয় কন্যার কাছেই অধিক নিরাপদ এবং অধিক সুসংহত।
লেখক : ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া,
অধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি; কবি ও প্রাবন্ধিক ঢ়রলঁংযঢ়ঢ়ন@মসধরষ.পড়স
কৃতজ্ঞতা : * অসমাপ্ত আত্মজীবনী-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান * বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক ভাবনা ও আজকের বাংলাদেশ-ড. আতিউর রহমান * কেমন হতো বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ-আবুল বারাকাত * বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ও জাতীয় পুনর্গঠন-নূহ-উল-আলম লেনিন।