মামুনুর রশীদ
বঙ্গবন্ধু তার জীবনের প্রতিটি ধাপে বাঙালির সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিনে এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন, ‘৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী? উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এর পর তিনি বেদনার্থ স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কি আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু।’
বাঙালি জাতি ভাগ্যবান, তারা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বহুগুণে গুণান্বিত একজন রাজনৈতিক নেতা পেয়েছিল। তিনি শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নেতা, দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, একজন দুর্জয় সাহসী রাজনীতিক, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, মানবিক গুণসম্পন্ন মহান মানুষ, অসাধারণ বাগ্মী এবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় নেতা ছিলেন না, একই সঙ্গে ছিলেন বাঙালি জাতির অভিভাবক। নাগরিক হিসেবে আমরা গর্বিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য ।
আজ ১৭ মার্চ এই মহান মানুষটির ৯৭তম জন্মদিন। এদিনটি জাতীয় শিশু দিবস হিসেবেও উদযাপিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালে ১৭ মার্চ তত্কালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এই মানুষটিই হয়ে ওঠেন লাল-সবুজ পতাকার ধারক ও বাহক; বাঙালির শেষ ঠিকানা। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিও পেয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ‘বঙ্গবন্ধু বা শেখ মুজিব’ নামটির মধ্যেই স্বদেশকে উপলব্ধি করেন। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা যত দিন বহমান থাকবে, বাংলাদেশ নামক দেশটি থাকবে যত দিন, তত দিন বাঙালি জাতিসত্তায় মিশে থাকবে এ নাম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের লাল-সবুজ পতাকা, আমাদের বঙ্গবন্ধু— এই তো বাঙালির পরিচয়।
অবিসংবাদিত এ নেতার সমাজ পরিবর্তন বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে ত্যাগ, অসম সাহস, দূরদর্শিতা, সর্বোপরি কর্মদক্ষতা ছিল, সময়ের পরিক্রমায় সেই দক্ষতা আজ এক অসামান্য নিখাদ শিল্পে পরিণত হয়েছে। তাকে ধারণ করার অর্থই হলো, বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের মূল অস্তিত্বকে ধারণ করা। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মেও ভেদাভেদ করেননি। তিনি সবসময় বলতেন, ‘আমি মানুষকে কেবল মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান বলে কিছু নেই। সবাই মানুষ।’
তিনি মানুষকে নিয়ে চিন্তা করতেন। তিনি ভেবেছিলেন মানুষকে মোটা ভাত, মোটা কাপড় দেবেন। তিনি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সাধনায় মশগুল ছিলেন। আমলাদের তিনি ধানের ক্ষেতে নামিয়ে দিয়েছিলেন। কৃষকদের সার, বীজ, তেল, পাওয়ার পাম্প, কীটনাশক দিয়ে তার মেরুদণ্ড মজবুত করে দিয়েছিলেন। বিপন্ন কলকারখানা উত্পাদনের ছন্দে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি বলেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় বলব— আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ যে বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন বাঙালির জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। জাতির জন্য সঠিক আদর্শ ও সঠিক পথটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য তিনি রচনা করে গেছেন।
বাল্যকাল ও কৈশোর থেকে সংগ্রাম শুরু করা বঙ্গবন্ধু সারা জীবন একটিই সাধনা করেছেন, তা হচ্ছে— বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য নিজেকে উত্সর্গ করা এবং সেটি প্রমাণ করে গেছেন নিজের জীবন দিয়ে।
এখন ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘বাংলাদেশ’— দুটি নাম একটি ইতিহাস। এক ও অভিন্ন সত্তা। যেন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট গঠন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এ দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আজ জাতি অভাবনীয় শূন্যতা অনুভব করে।
বাঙালি জনমানুষ যখন আন্দোলিত হচ্ছিল, তখন ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বজ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি প্রথমে মুক্তি ও পরে স্বাধীনতার কথা বলেন। তীক্ষদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষটি স্বচিত্তে মুক্তির জন্য যে স্বাধীনতার প্রয়োজন, তা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন। মুক্তি মানে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সবক্ষেত্রে মুক্তি। একটা স্বাধীন জাতিই কেবল পারে ওই ধরনের মুক্তির প্রত্যাশা করতে। তাই তার ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত করে তোলে। বাংলার প্রতিটি মানুষের রক্তে জাগিয়ে তোলে দুর্বার শক্তি, যে শক্তির সামনে দাঁড়াতে পারেনি পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী এবং এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্র।
‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ এবং ‘যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুকে মোকাবিলা করো’— এসব কথার মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। এমনকি ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি’ উচ্চারণের মধ্যে ছিল জাতির মুক্তি আন্দোলনে নিবেদিত অন্যান্য নেতা-কর্মী ও জনতার বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর মুক্তিমন্ত্র।
বঙ্গবন্ধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানচিত্রে এক লৌহমানব। তার চিন্তা-চেতনা, তার স্বপ্ন, তার অপরিসীম আত্মত্যাগের ফলে মরণভীতু বাঙালি জাতি জাগরণের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতার যূপকাষ্ঠে প্রাণ দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। বঙ্গবন্ধুর কাছে এ জাতির ঋণ অপরিশোধ্য। আজ তার জন্মদিনে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
মহামানবের জন্মদিনে আমাদের অঙ্গীকার, আমরা নতুনরাই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’— বিশ্বকবির এ চয়নকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজের স্বার্থকে বড় করে না দেখে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে আমরা মানুষের কল্যাণে, উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ সুসভ্য আধুনিক ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনানির্ভর রাষ্ট্র গড়ার কাজে হাত বাড়াব। বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে সোনার বাংলা গড়ায় আমাদের জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবই— এই আমাদের অঙ্গীকার।