হাসান আজিজুল হক
বাঙালি জাতির যে আজকে সারা বিশ্বে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, তা তো একদিনে হয়নি। যখন সামগ্রিকভাবে একটি জাতির এগিয়ে যাওয়া ও ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে একজন মানুষ বুঝতে ও বলতে পারেন, তখন তাকে আমরা নেতা বলি। কারণ একটা জাতির অনেক দূর পর্যন্ত তিনি দেখতে পান।
ব্রিটিশ আমলে চল্লিশের দশক থেকে সেই নেতৃত্বের কথা আমরা জানি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন সে সময়কার ডাকসাইটে নেতা আর তার বিশ্বস্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
’৪৭ সালে দেশ বিভাগ হল। তারপর আমরা ভাষা আন্দোলন দেখেছি, যেখানে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি। সেখানে সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী ও অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে খুব সাহসী ভূমিকায় দেখেছি।
বাংলা ভাষা ও বাংলার মানুষের প্রতি তার যে কমিটমেন্ট ছিল আমরা যারা আগাগোড়া দেখেছি, বুঝতে পেরেছি। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মার্কিনপন্থী নেতা। ন্যাটো ইত্যাদিকে তিনি সমর্থন করেছিলেন। আমার মনে হয়, তখনই বঙ্গবন্ধু চিন্তা করেছিলেন যে, তাকে ভিন্ন পথ নিতে হবে।
’৬০-এর দশকে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু একক নেতৃত্বে আসেন। ভাসানীর দ্বিধা ছিল। তিনি কখনও সমাজতান্ত্রিক আবার কখনও ইসলামী সমাজতান্ত্রিক দ্বিধায় ভুগেছেন। ওই সময় বিপ্লবী হতে গিয়ে তার সঙ্গে আরও অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ছিলেন শোষণমুক্তির বিশ্বাসে অটল। তিনি নিকটবর্তী শোষক পাকিস্তান দেখেছেন। তিনি তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন।
গণঅভ্যুত্থান ও ছয় দফা ইত্যাদিতে স্বায়ত্তশাসনের আল্টিমেটামের মাধ্যমে যাকে বলে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেয়া, বঙ্গবন্ধু তাই করলেন। এতে গোটা দেশ জেগে উঠল। অন্য নেতারা পিছিয়ে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু হলেন অবিস্মরণীয় নেতা।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও গণআন্দোলন ইত্যাদিতে বঙ্গবন্ধু যা বলেছেন, তাই ঘটেছে। তারপর ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে পড়লেন বাঙালির একমাত্র নায়ক। ‘ভাতে মারবো, পানিতে মারবো। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাক’- উদ্দীপ্ত এ ভাষণের মধ্য দিয়ে তার অনমনীয় মনোভাবের বিষয়টি আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। তার নির্দেশনায় যুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের পর স্বাধীন দেশের নায়ক হিসেবে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ফিরে এলেন।
হাসান আজিজুল হক : অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক