বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতিসত্ত্বা বিকাশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু হয়ে আছেন এক ও একাত্ম। বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্র, বাঙ্গালি জাতিসত্তা, তাঁর বিকাশের ক্ষেত্রে রয়েছে বহু ঘটনা, বহু ইতিহাস। এই ধারায় মহানায়ক শেখ মুজিব কিভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় অভিষিক্ত হলেন নতুন প্রজন্মের কাছে সে যথার্থ ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ, বাঙ্গালি জাতি ও জাতিসত্ত্বাকে তাদের স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটায়। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণ ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন, অর্থনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত দিক থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের অসারতা উপলদ্ধি করতে শুরু করে।
পঁয়ষট্টির এই যুদ্ধ বাঙ্গালিকে তাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে নতুনভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। যুদ্ধের পর বাংলাকে অরক্ষিত এবং সবদিক থেকে অসহায় রাখার পাকিস্তানী কৌশলের স্বরূপ উলঙ্গভাবে উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ঠিক এমনি একটি মুহুর্তে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্রপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে বাংলার জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে মুক্তি সনদ হিসেবে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। এই ৬ দফা প্রস্তাব পেশের মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নতুন ধারার সূত্রপাত হয়।
৬ দফার এই কর্মসূচি বাংলার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে। সারা বাংলার পথে প্রান্তরে সভা-সমাবেশ মিছিলের মাধ্যমে শেখ মুজিবের ডাকে অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে আসে সম্পূর্ণ এক নতুন গণজোয়ার। তৎকালীন জনসভাসমূহে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি ও স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন শেখ মুজিবকে বাঙ্গালি জাতির প্রধান নেতার ভূমিকায় অধিষ্ঠিত করে তোলে।
১৯৬৬ সালের ৭ জুন শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও ৬ দফার সমর্থনে ছাত্র-শ্রমিক জনতার অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে ঐতিহাসিক আন্দোলন সংঘটিত হয়, তার সাথে নতুন মাত্রা যোগ করে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাকে নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এই মামলায় বাংলার বীর সন্তানদের অভিযুক্ত করার মধ্যদিয়ে বিকাশোম্মুখ বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরও বেগবান করে তোলে। এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে শেখ মুজিব হয়ে উঠেন বাঙ্গালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা।
জাতির এই যুগসন্ধিক্ষণে (১৯৬৫ সালে) আমি তখন চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। তারুণ্যের সমগ্র উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে চলমান ঘটনাকে অবলোকন করতাম চরম বিস্ময়ের সাথে। এই বোধ থেকেই জড়িত হয়ে পড়ি তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের মূল স্রোতধারা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের সাথে। পড়াশুনার পাশাপাশি স্কুল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন এবং একই সাথে ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুবাদে আমি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সামগ্রিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে জড়িত হয়ে পড়ি।
১৯৬৭ সালে এস. এস. সি পাশ করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। এখানেও রীতিমত লেখাপড়ার পাশাপাশি উত্তপ্ত ছাত্র আন্দোলনের ছোঁয়া আমাকে আরও উজ্জীবিত করে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার ঘটনাবলী প্রত্যক্ষভাবে কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটে। এই সময় তৎকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যমণি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম পুত্র শেখ কামালের সাথে সহপাঠী হিসেবে আমার পরিচয় ঘটে এই ঢাকা কলেজেই। ১৯৬৭ সালেই আমি ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এবং একই সাথে লেখাপড়ায় ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঐ সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল বহুমাত্রিক। ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎকালীন ছাত্র আন্দোলনের খবর প্রকাশ, বিকাশমান বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আমি ও শেখ কামাল একটি বুলেটিন প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। বুলেটিনের নামকরণ করা হয় ‘প্রতিধ্বনি’।
তখনও শেখ মুজিবের নামের সাথে সুনির্দিষ্ট কোন বিশেষণ যুক্ত হয়ে ওঠেনি। বিভিন্ন জন বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন নামকরণ করলেও কোনটি তেমন স্বীকৃতি লাভ করেনি। শেখ মুজিবুর রহমান তখনও ’বঙ্গবন্ধু’ নামে পরিচিত নন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা কর্মীদের কাছে তিনি মুজিব ভাই সম্বোধনে পরিচিত। ১৯৬৬ সাল থেকে তাঁর নামের আগে তরুণ সমাজ ‘সিংহশার্দুল’, ‘বঙ্গশার্দুল’ ইত্যাদি খেতাব জুড়ে দিত।
এই প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবের নামের সাথে একটি যথাযথ বিশেষণ যুক্ত করার চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অসারতা উল্লেখ করে সে সময় আমি একটি নিবন্ধ রচনা করি। চার পৃষ্ঠাব্যাপী এই নিবন্ধে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৃ-তাত্ত্বিকভাবে দুটো পৃথক অঞ্চল হিসেবে পাকিস্তানের দুই অংশের সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্যকে জোরালোভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পাই। এই নিবন্ধে গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের নামের সাথে প্রচলিত বিভিন্ন বিশেষণের পাশাপাশি সর্বপ্রথম লিখিত আকারে আমি ‘বঙ্গবন্ধু’ বিশেষণটি ব্যবহার করি। প্রসঙ্গক্রমে নিবন্ধের উপসংহার অংশটুকু নিম্নে উদ্বৃত্ত করা হল :
“পরিশেষে একটি কথা বলা যায় দুই অংশের পার্থক্য ও অমিলকে স্বীকার করে দুই অংশের পৃথক ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে পাশাপাশি স্থান দিয়ে ও সর্বোপরি পূর্ব বাংলার নয়নমনি-মুক্তিদিশারী, “বঙ্গবন্ধু”, সিংহশার্দুল শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রস্তাবিত ৬ দফা কর্মসূচির বাস্তবায়নের মাধ্যমে আজব ও অভিনব পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি টিকে থাকতে পারে – নতুবা নয়।”
বলাবাহুল্য, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ঢাকা কলেজ শাখার প্যাডে ৩ নভেম্বর, ১৯৬৮ সালে আমার স্বহস্তে লেখা এই নিবন্ধটি আমি ছদ্মনামেই প্রকাশ করি। নিবন্ধের নাম ‘আজবদেশ’, আমার ছদ্মনাম ছিল ‘সারথী’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই নিবন্ধটি হুবহু কোথাও প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। এর পেছনেও রয়েছে একটি ছোট্ট ইতিহাস।
শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ঐতিহাসিক ৬ দফার আলোকে লিখিত এই নিবন্ধে মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অসাড়তাই ফুটে উঠেছিল। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে এ ধরনের নিবন্ধ ছিল রীতিমত রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ। ‘প্রতিধ্বনি’তে এই নিবন্ধটি প্রকাশের উদ্যোগ নিলে শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খান সহ ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আমাকে ওই মুহূর্তে নিবন্ধটি না ছাপানোর পরামর্শ দেন। উনাদের যুক্তি ছিল, এই নিবন্ধ প্রকাশিত হলে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের ধারাবাহিক কার্যক্রম পুলিশী রোষানলে পড়বে এবং ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার কার্যক্রম পরিচালনা ব্যহত হবে।
‘আজবদেশ’ নামে এই লেখায় ‘বঙ্গবন্ধু’ বিশেষণটি আমার কাছে খুব যুৎসই ও যথার্থ বলে অনুমিত হওয়ায় ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি কোথাও ছাপিয়ে ব্যবহারের চিন্তায় ছিলাম। ১৯৬৮ নভেম্বরে প্রতিধ্বনি বুলেটিনে ঐতিহাসিক ৬ দফা পুনর্মুদ্রনের সময় সর্বপ্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়। ‘৬৯ এর গণআন্দোলনের প্রাক্কালে ঝিমিয়ে পড়া ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা শহরে ছাত্রলীগের আমরা ৩০/৪০ জন সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলাম। প্রতিধ্বনির লেখা তৈরি করে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ ছাত্রলীগের নেতা একরামুল হকের পুরানা মোগলটুলি হোস্টেলে প্রেসের সন্ধানে গিয়ে লেখাটা পড়ে শুনালাম। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ ছাত্রলীগের নেতা ও বর্তমানে সাংবাদিক বদিউল আলম। ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধাটি উপাধি হিসেবে ব্যবহার করায় আমার এ দু’জন বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মী আমাকে সমর্থন করলেন অকুণ্ঠ চিত্তে। আমরা প্রতিধ্বনি ছাপানোর জন্য পুরানা ঢাকার কোর্ট হাউজ স্ট্রিটস্থ কায়দে আযম কলেজ (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ) ছাত্র সংসদের তৎকালীণ সাধারণ সম্পাদক মো. ইব্রাহিমের বড় ভাইয়ের মোহাম্মদী প্রেসে গিয়ে ছাপানোর ব্যবস্থা করলাম।
প্রসঙ্গত, এই প্রেস থেকে আগরতলা মামলা চলাকালীন সময় বিশেষ সামরিক আদালতে প্রদত্ত শেখ মুজিবের জবানবন্দিটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রয়াত দফতর সম্পাদক মরহুম সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি’র অর্থানুকূল্যে সর্বপ্রথম ছাপিয়ে সাধারণ জনগণের কাছে বিলি করেছিলাম।
’প্রতিধ্বনি’তে ৬ দফার শিরোনামে ’বঙ্গবন্ধু’ অভিধাটি যুক্ত করা হয়েছিল এইভাবে – “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তাবিত পূর্ব বাংলার মুক্তিসনদ ৬ দফা”। অজানা ও অনালোচিত এই ঐতিহাসিক তথ্যের প্রাসঙ্গিকপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যায় ১৯৮৭ সালের ৩১ জুলাই ’বাংলার বাণী’ পত্রিকায় কলামিস্ট ওবায়দুল কাদের’র (বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী) বর্ণনায় –“মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত হন লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশে, ১৯৬৯ সালে। অবিস্মরণীয় গণবিস্ফোরণের চূড়ান্ত পর্যায়ে সে আন্দোলনের অগ্রণী বাহিনী ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবকে রেসকোর্সের স্বতঃস্ফূর্ত বিশাল জনসমুদ্রে ডাকসুর সহ-সভাপতি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা তোফায়েল আহমদ ’বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেন। সেটা অবশ্য আরও পরের ঘটনা।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কার মাথায় প্রথম ’বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি এসেছিল। এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে খানিকটা পেছনে যেতে হয়। তখন সম্ভবতঃ ১৯৬৭ সাল। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ ’প্রতিধ্বনি’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা বের করতো। সে পত্রিকার একটি ইস্যূতে ছাত্রলীগের রেজাউল হক মুশতাক ’সারথী’ ছদ্মনামে ’আজবদেশ’ নামে একটি লেখা লেখেন। লেখাটার শেষ দিকে ‘বঙ্গশার্দুল’ শেখ মুজিবের পাশে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে একই পত্রিকায় ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাসের ইস্যূতে ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তাবিত পূর্ব বাংলার ’মুক্তিসদন’ ৬ দফা শিরোনাম হয়ে আসে। তখন অবশ্য ছোট হেডিংয়ে অখ্যাত এক পত্রিকায় ব্যবহৃত ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ঢাকার ছাত্র মহলের একাংশ ছাড়া অন্যকারও নজর কাড়েনি। হয়তো স্থান কাল পাত্রের বিবেচনায় সে সময় শেখ মুজিবের নামের সাথে এমন একটা বিশেষণ প্রয়োগের ভাবনাটা তেমন গুরুত্ব পায়নি। ওটা গুরুত্ব পায় ঠিক তখন যখন জাগ্রত বাঙ্গালি জাতির জাগরণের সব স্রোতধারা এক মোহনায় একাকার, যখন গণমোহন মুজিব বিদ্রোহী বাংলার মুকুটহীন সম্রাট। বলা দরকার, মুজিবের জন্য যুৎসই খেতাব হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান ও ‘৬৯ এর তরুণ নেতৃত্বের সকলের খুবই পছন্দ হয়েছিল।”
১৯৬৮ সালে নভেম্বর মাসের শেষার্ধে প্রতিধ্বনিতে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের বিভিন্ন লিফলেট, প্রচারপত্রে ব্যবহৃত হতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিকভাবে প্রাসঙ্গিক আর একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। ১৯৬৮ সালে সর্বপ্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ নামকরণ করার পাশাপাশি আমার উদ্যোগে ও আমার ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু রায়হান ফেরদাউস মধুর সহযোগিতায় ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’র জীবনী বিষয়ে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছিলাম। দেড় ফর্মার পুস্তিকাটির নাম ছিল ‘এই দেশেতে জন্ম আমার’। প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন মরহুম কালাম মাহমুদ। বর্তমানে দুস্প্রাপ্য এই পুস্তিকাই ‘বঙ্গবন্ধু’র জীবনী বিষয়ক সর্বপ্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত পুস্তিকা। এই পুস্তিকাটি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে দিলাম, তখন খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ আদর করলেন। বঙ্গবন্ধু আবেগ আপ্লুত হয়ে বললেন, “ছাত্রলীগের ছেলেরা এত সুন্দর প্রকাশনা বের করতে পারে আমার ধারনাই ছিলনা”। তিনি আরো বললেন, “এটা প্রকাশ করতে তোর তো অনেক টাকা খরচ হয়েছে”। আমি ছিলাম নিরুত্তর। অতঃপর বঙ্গবন্ধু পাঁচশত টাকার একটি নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এটি তোর কাছে রাখ”।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব বাঙ্গালি জাতির অবিসংবাদিত নেতারূপে আত্মপ্রকাশ করেন। ‘৬৯ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের গণ সংবর্ধনায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ডাকসুর তৎকালীন সহ-সভাপতি, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ও সাবেক শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমদ তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসীর পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
বলাবাহুল্য, এই সময় থেকেই শেখ মুজিরের নামের সাথে এতদিনের প্রচলিত ‘মুজিব ভাই’, ‘বঙ্গশার্দুল’, ‘সিংহশার্দুল’ ইত্যাদি বিশেষণকে রীতিমত প্লাবিত করে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটিই সমুজ্জল হয়ে ওঠে। ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি পরবর্তীকালে তাঁর নামের সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে যে, ‘বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ করলে আর শেখ মুজিব বলতে হয়না। একইভাবে শেখ মুজিব নাম উচ্চারিত হলেই ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটিও চলে আসে অবলীলাক্রমে। আজ শেখ মুজিব মানে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধু’ মানেই শেখ মুজিব।
লেখক: রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক।
প্রাক্তন ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজ কর্মী।