আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা


আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যান্যরা ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবর রহমান গং মামলা। তবে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবেই বেশি পরিচিত, কারণ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল যে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিল। মামলা নিষ্পত্তির চার যুগ পর মামলার আসামী ক্যাপ্টেন এ. শওকত আলী ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি স্বরচিত গ্রন্থে এ মামলাকে সত্য মামলা' বলে দাবী করেন।

প্রেক্ষাপট

৬ জানুয়ারি, ১৯৬৮ সালে ২ জন সি. এস. পি অফিসারসহ ২৮জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের গ্রেফতার সম্পর্কে সরকারী প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয় যে,

“     গত মাসে (অর্থাৎ ডিসেম্বর, ১৯৬৭) পূর্ব-পাকিস্তানে উদ্‌ঘাটিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে এঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে।     ”

তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই ষড়যন্ত্রকে "আগরতলা ষড়যন্ত্র" নামে অভিহিত করে। এই একই অভিযোগে ১৭ জানুয়ারি, ১৯৬৮ সালে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়। ৩৫জনকে আসামী করে সরকার পক্ষ মামলা দায়ের করে।

নামকরণ

তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটিকে সরকারীভাবে নামকরণ করেছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার। এই মামলায় ৩৫জনকে আসামী করা হয়।

আসামীরা সকলেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তারা হলেন -শেখ মুজিবুর রহমান; আহমেদ ফজলুর রহমান, সিএসপি; কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন; স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান; সাবেক এলএস সুলতানউদ্দীন আহমদ; এলএসসিডিআই নূর মোহাম্মদ; ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফিজ উল্লাহ; কর্পোরাল আবদুস সামাদ; সাবেক হাবিল দলিল উদ্দিন; রুহুল কুদ্দুস, সিএসপি; ফ্লাইট সার্জেন্ট মোঃ ফজলুল হক; বিভূতি ভূষণ চৌধুরী (ওরফে মানিক চৌধুরী); বিধান কৃষ্ণ সেন; সুবেদার আবদুর রাজ্জাক; সাবেক কেরাণী মুজিবুর রহমান; সাবেক ফ্লাইট সার্জেন্ট মোঃ আব্দুর রাজ্জাক; সার্জেন্ট জহুরুল হক; এ. বি. খুরশীদ; খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান, সিএসপি; একেএম শামসুল হক; হাবিলদার আজিজুল হক; মাহফুজুল বারী; সার্জেন্ট শামসুল হক; শামসুল আলম; ক্যাপ্টেন মোঃ আব্দুল মোতালেব; ক্যাপ্টেন এ. শওকত আলী; ক্যাপ্টেন খোন্দকার নাজমুল হুদা; ক্যাপ্টেন এ. এন. এম নূরুজ্জামান; সার্জেন্ট আবদুল জলিল; মাহবুবু উদ্দীন চৌধুরী; লেঃ এম রহমান; সাবেক সুবেদার তাজুল ইসলাম; আলী রেজা; ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দীন এবং ল্যাঃ আবদুর রউফ।

বিচার প্রক্রিয়া

প্রথমে আসামীদেরকে 'দেশরক্ষা আইন' থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তীতে 'আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স অ্যাক্টে' শেখ মুজিবুর রহমান, সার্জেন্ট জহুরুল হক-সহ অন্যান্য আসামীকে পুণরায় গ্রেফতার করে সেন্ট্রাল জেল থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। ১৯ জুন, ১৯৬৮ সালে মামলাটির শুনানি কার্যক্রম শুরু হয়।

অভিযোগনামা

'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার' শিরোনামের মামলার অভিযোগনামায় উল্লেখ করা হয়েছিল যে,

“     অভিযুক্তরা ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটিয়ে কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল।     ”

মামলার স্থান হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে অবস্থিত 'সিগন্যাল অফিসার মেসে' নির্ধারণ করা হয়। মামলাটির শেষ তারিখ ছিল ৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ সালে।

ফলাফল

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে সাধারণ জনতা। প্রবল গণ-আন্দোলন তথা উত্তাল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সরকার পিছু হটতে শুরু করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে একান্ত বাধ্য হয়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমান-সহ অন্যান্যদের মুক্তির দাবী করেছিল। ফলশ্রুতিতে, সরকার প্রধান হিসেবে আইয়ুব খান সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

'উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান' নামক এই গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ঐতিহাসিকগণ এই মামলা এবং মামলা থেকে সৃষ্ট গণ-আন্দোলনকে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পেছনে প্রেরণাদানকারী অন্যতম প্রধান ঘটনা বলে গণ্য করে থাকেন।

ঘটনাপঞ্জি

৪ জানুয়ারি: সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচী পেশ করেন।

৭ ও ৮ জানুয়ারি: গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রাজনৈতিক ঐক্য ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি বা ড্যাক (DAC) গঠিত হয়।

২০ জানুয়ারি: ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষনের ঘটনায় নিহত হন ছাত্র আসাদুজ্জামান।

২৪ জানুয়ারি: পুলিশের গুলিতে নিহত হন কিশোর ছাত্র মতিয়ুর রহমান-সহ আরো অনেকে।

১৫ ফেব্রুয়ারি: কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে আটক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত।

১৮ ফেব্রুয়ারি: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মৌন মিছিলে গুলি চালালে নিহত হন শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা।

২১ ফেব্রুয়ারি: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার।

২৬ ফেব্রুয়ারি: বিরোধী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার জন্য আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক আহবান করেন। পরবর্তীতে গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকা

৮ ডিসেম্বর ১৯৬৮: নীলক্ষেতে ওয়াবদার কর্মচারী আব্দুল মজিদ ও গুলিস্তানে সাইকেল মিস্ত্রি আবু।

৯ ডিসেম্বর ১৯৬৮: ফৌজদার হাটে শ্রমিক মুসা মিয়া।

২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৮: হাতির দিয়ায় কৃষক মিয়া চাঁন, হাসান আলী, চেরাগ আলী এবং শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান।

১৮ জানুয়ারি ১৯৬৯ :রূপগঞ্জে ছাত্র হাফিজ আহমেদ।

২০ জানুয়ারি ১৯৬৯: ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্র ও কৃষক সংগঠক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ।

২৪ জানুয়ারি ১৯৬৯: সেক্রেটারিয়েটের সামনে ছাত্র মতিয়ুর রহমান মল্লিক,রচ্স্তম আলী ও ময়মনসিংহে ছাত্র আলমগীর মনসুর এবং চট্টগ্রামে শ্রমিক হাসানুজ্জামান ও জানু মিঞা।

২৫ জানুয়ারি ১৯৬৯: নাখালপাড়ায় গৃহবধু আনোয়ারা বেগম, তেজগাঁতে ছাত্র আব্দুল লতিফ, ধানমণ্ডি এলাকায় চাকুরীজীবি রহিমদাদ।

২৬ জানুয়ারি ১৯৬৯: ঢাকায় শ্রমিক সরল খান, শিমুলিয়া রেলস্টেশনে আনোয়ার আলী, সিদ্দিরগঞ্জে জুলহাস শিকদার।

২৭ জানুয়ারী ১৯৬৯ :গৌরিপুরে ছাত্র হারচ্ন আব্দুল আজিজ।

৩০ জানুয়ারী ১৯৬৯ :জাজিরায় ছাত্র আলাউদ্দীন ও নৌকার মাঝি আব্দুল জব্বার মাঝি

১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ :জলির পাড় ছাত্র মহানন্দ সরকার ছাত্র।

৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯: ঢাকায় শ্রমিক আব্দুল আলী।

৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯: রাজারগাঁও ছাত্র মজিবর রহমান ও কামাল উদ্দীন আকন্দ।

১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ :নবীনগর, নারায়নগঞ্জে ছাত্র মাজাহার আহমেদ ও ঢাকা সেনানিবাসে সৈনিক সার্জেন্ট জহুরুল হক।

১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ :নাজিরা বাজারে প্রেসকর্মী ইসহাক।

১৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ :সোনাদিঘীর পাড়, রাজশাহীতে সিটি কলেজ ছাত্র ও ছাত্রনেতা নূরুল ইসলাম খোকা , রামেক হাসপাতালে শিক্ষক ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ও নাজিরাবাজারে চাকুরীজীবি রহমতুল্লাহ।

১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯: ঢাকায় শ্রমিক লোকমান, মুজিবুর রহমান, মালিবাগে দর্জি আতাহার খান, হোটেল বয় শামসু আইসক্রীম বিক্রেতা আব্দুল আলী, কাঠমিস্ত্রী আবুল হাশেম, সেনবাগে ছাত্র খোরশেদ আলম, সেনবাগ- নোয়াখালীতে শ্রমিক হাফিজুর রহমান, আব্দুর রহমান, ছাত্র আবুল কালাম, শামসুল হক, কুষ্টিয়ায় চাকুরীজীবি আব্দুর রাজ্জাক।

২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯:ঢাকা সেনানিবাসে মু. দেলওয়ার হোসেন।

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯:দৌলতপুরে ছাত্র আবদুস সাত্তার, মনিরচ্জ্জামান, নৈশবিদ্যালয়ের ছাত্র ও শ্রমিক মাহতাক আলী, শ্রমিক ইসরাফিল বান্দো, আলতাব, হাবিবুর রহমান,নাসির, লোকনাথ।

২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ :বরিশালে ছাত্র আলাউদ্দীন, ঢাকায় শ্রমিক আব্দুস সাত্তার।

৭ মার্চ ১৯৬৯ : টাঙ্গাইলে ছাত্র বিশ্বনাথ সাহা।

৮ মার্চ ১৯৬৯ : শেরপুরে ছাত্র দারোগ আলী।

২৩ মার্চ ১৯৬৯:মানিকগঞ্জে ছাত্র আবদুল কাদের।

SUMMARY

1303-1.jpg