মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি
বাঙ্গালী জাতিকে শাসন ও শোষনের যাতাকল থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম এবং যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন অনেকে। অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ণ সহ্য করেছেন বাঙ্গালী জাতির অনেক বীর সšতানেরা। ১৯৪৭ এ পাকি¯তান স্বাধীন হলেও বাঙ্গালীর কোন লাভ হয়নি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এর দীর্ঘ ২৩ বছরের ”স্বাধীনতা সংগ্রাম” এবং ১৯৭১ এর বীরত্বপূর্ণ ”মুক্তিযুদ্ধের” সিড়ি বেয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আমরা অর্জন করি আমাদের হাজার বছরের কাংখিত ”স্বাধীনতা”।
বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতার ইতিহাস, স্বাধীনতার স্থপতি, স্বাধীনতার ঘোষক ইত্যাদি বিষয় ও ঘটনা গুলো ঐতিহাসিক স্বীকৃত সত্য। বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা অতি সহজে হটাৎ করে আসেনি। স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে যে সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে তা শুধু আমাদের দেশবাসীরই জানা নয়, বিশ্ববাসীও তা ভালভাবে জানে। সুতরাং এ বিষয় গুলো নিয়ে নতুন কিছু লেখা সম্ভব নয়, তবে কিছু লেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি। ২০০১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী চার দলীয় বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, স্বাধীনতার ঘোষক, জাতির জনক ইত্যাদি বিষয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা চালিয়েছে, নতুন প্রজন্মের কাছে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। এ অবস্থা কোন সচেতন নাগরিকের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয় বিধায় আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই যে আমাদের ”জাতির জনক” এবং স্বাধীনতার ঘোষক এ বিষয়ে নিæলিখিত ১২টি তথ্য তুলে ধরছি।
১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক দিনে বা শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চের ঘোষনার মাধ্যমেই আসেনি। ৫২ এর মহান ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং নির্বাচনে বিজয়, ৫৮ এর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬২ এর গণ বিরোধী হামিদুর রহমানের শিক্ষা কমিশনের রির্পোটের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬৬ এর ৬ দফার আন্দোলন, ৬৯ এর গণ আন্দোলন এবং ৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে দীর্ঘ স্বাধীনতার সংগ্রামের পথ বেয়ে সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হয়েছে। সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এ দীর্ঘ স্বাধীনতার সংগ্রামে আমাদের নেতৃত্বে ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জনাব হোসেন শহীদ সরওয়াদী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সহ অনেক নেতা। তবে এনাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুই এ সংগ্রামে সর্বাধিক অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। বিশেষ করে ১৯৬০-১৯৭০, এ দশ বছরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই এ সংগ্রাম তার সঠিক লক্ষ্যে (স্বাধীনতা) পৌঁছে। ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চে তৎকালীন পাকি¯তানে এমন কোন ব্যক্তি সম্ভবত: ছিলেন না যিনি বাঙ্গালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে চিনতেন না। শুধু তৎকালীন পাকি¯তান কেন, ১৯৭১ এ আমাদের উপমহাদেশ সহ বিশ্বে যারা রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন তারা সকলেই বাঙ্গালী জাতির নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকেই জানতেন। সুতরাং বাঙ্গালী জাতির জন্মলগ্নেই এ জাতির জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকেই সবাই চিনতেন। আজ এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই।
২)বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষন হলো একটি অন্যতম মাইল ফলক। এ ভাষনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ সম্পন্ন করে চুড়াšত বিজয় অর্জনের জন্য ”মুক্তিযুদ্ধের” ডাক দিয়েছিলেন এবং এ যুদ্ধ কিভাবে করতে হবে তার সুচারু দিক-নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষনা ”প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল”, ”তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে”, ”জীবনের তরে রা¯তা ঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দিবে”, ”রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দিব” এদেশের মানুষকে মুক্ত করে তুলব ইনশাল্লাহ” ” এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। বঙ্গবন্ধুর এ নির্দেশাবলী ৭ই মার্চ ৭১ এর পর থেকেই সকল বাঙ্গালীর হৃদয়ে ধ্বনিত হয়েছে, আজও এবং যুগ যুগ ধরে প্রকৃত বাঙ্গালীর হৃদয়ে ধ্বনিত হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ অর্থ্যাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ১৮দিন আগেই বাঙ্গালী জাতিকে এবং এ জাতির সকল পর্যায়ের নেতাদের জানিয়ে দিয়েছেন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা, এ যুদ্ধের রাজনৈতিক তাৎপর্য এবং সামরিকভাবে এ যুদ্ধ কিভাবে করতে হবে অর্থ্যাৎ মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত(ষ্ট্রেটিজিক) এবং রণকৌশল (টেকটিকেল) সহ সকল দিক নির্দেশনাই দিয়েছিলেন। একজন দুরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি বুঝেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরী হতে পরিস্কার নির্দেশনার দরকার এবং ৭ই মার্চের পরে ঘটনা এত দ্রুত এগোবে যে পরে এ ধরণের নির্দেশনা দেয়ার উপযুক্ত সময় নাও পাওয়া যেতে পারে। জাতির জনকের ৭ই মার্চের ভাষনের পর পরই ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে বাঙ্গালী জাতি একতাবদ্ধ ভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু করেছিল। পাকিস্তানীদের সাধে অসহযোগ সহ সকল সরকারী কর্মকান্ড বন্ধ করে দিয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলাদেশ তখন চলত। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ না করানোর মত সাহস দেখাতে পেরেছিলেন।
৩)বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৫-২৬শে মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে অর্থ্যাৎ রাত ১২টা ২০ মিনিটে ইষ্ট
পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) (আজকের বি,ডি,আর,) এর বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে ”স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছিলেন যা আজ ঐতিহাসিক সত্য বলে প্রমানিত। এর সাক্ষ্য প্রমান এখনও অটুট (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল পত্র – ৩য় খন্ড।) ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা ছিল নিæরূপ :
“This may be my last message, from to-day Bangladesh is independant. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last, your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final
(অনুবাদ – সম্ভবত: এটাই আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনসাধারণকে আহŸ্ান জানাচ্ছি তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যাই তোমাদের হাতে আছে তার দ্বারাই শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতারিত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।) ২৬শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনা অনেকেই শুনেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনা শুনেছিলেন তৎকালীন ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনে কর্মরত আই এস পি আর (ওঝচজ) এর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালেক। তিনি তার ”উইটনেস টু সারেন্ডার” বইয়ের ৭৫ পৃষ্টায় লিখেছেন ” When the first shot had been fired, ‘the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been, sounded like, a pre-recorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the People’s Republic of Bangladesh.’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানী সেনা অফিসার সহ অনেকেই ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক দেয় ”স্বাধীনতার ঘোষনা” শুনেছেন এবং এ ঘোষনা অনুযায়ী তাদের কর্তব্য পালন করেছেন।
৪) স্বাধীনতার ঘোষনা ছাড়াও বঙ্গবন্ধু ২৫-২৬ মার্চ রাতেই টেলিফোনের মাধ্যমে আরও একটি ঘোষনা বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলায় এবং বিভিন্ন সংস্থায় প্রেরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। ঘোষনাটি নিæরূপ ছিল:
”পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমন করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতি সমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শক্রদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আলাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এ যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ই,পি,আর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপস নেই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্র“কে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা -কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আলাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। ”জয় বাংলা”। এ ঘোষনা অনুযায়ীই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সামরিক নেতৃবৃন্দ, ই, পি, আর, পুলিশ ও আনসার নেতৃবৃন্দ, ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং সকল স্তরের জনগণ ২৬ মার্চ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে।
৫)১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ দিবাগত রাতে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াতিহয়া খান পাকিস্তান রেডিও এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেন। সে ভাষনে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষনার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিবকে পুরোপুরি দোষারোপ করে বলেছিলেন “Sk Mujib has declared independence of East Pakistan. He is a traitor. This time he will not go unpunished” (শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষনা করেছে। সে একজন দেশদ্রোহী। এবার সে শাস্তি এড়াতে পারবে না।) ২৭শে মার্চ ৭১ তারিখে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ঞযব উধরষু ঞবষবমৎধস পত্রিকার প্রথম পাতায় নতুন দিলী থেকে তাদের সাংবাদিক ডেভিড লোমাক এর পাঠানো সংবাদের ভিত্তিতে Civil War in East Pakistan. Sheikh a traitor, says Presidentশিরোনামে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনার কথা লিখা হয়। সুতরাং ২৫-২৬ মার্চ ৭১ এর রাতে স্বাধীনতা ঘোষনার জন্য বঙ্গবন্ধুকেই পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট দোষারূপ করেছিলেন। এছাড়াও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং ইতিহাসবিদ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষনা নিজ কানে অথবা অন্যের মারফত শুনেছেন এবং তা তাদের বইতে, প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করেছেন।
৬)২৫-২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর ”স্বাধীনতা ঘোষনা” বিশ্বের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ২৭ মার্চ ১৯৭১ এ তাদের পত্রিকার হেড লাইনে প্রকাশ করেন। নিচে লন্ডন থেকে প্রকাশিত কয়েকটি জনপ্রিয় পত্রিকা/সংবাদ মাধ্যমের উদ্ধৃতি দেয়া হলো।
ক) The Times পত্রিকার ২৭ মার্চের হেড লাইন ছিল ((Heavy fighting as Sheikh Mujibur Rahman declares E Pakistan independence” (অর্থ্যাৎ শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষনা করায় সেখানে প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে)
খ)Financial Times পত্রিকার ২৭ মার্চের হেড লাইন ছিল ““Civil War after East Pakistan declare independence” ” এ শিরোনামে নিচে লিখা ছিল শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষনা দিলে সেখানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
গ)The Guardian, The Daily Telegram, BBC সহ বিশ্বের প্রায় সকল পত্র পত্রিকা এবং খবর মাধ্যমে ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষনার খবর প্রকাশিত এবং প্রচারিত হয়। সুতরাং ২৫-২৬শে মার্চ ৭১ এর রাতের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষনা দিয়েছিলেন তা বিশ্ববাসীর কাছেও সত্য বলে প্রমানিত।
৭) বঙ্গবন্ধুর ”স্বাধীনতার ঘোষনা” সম্বলিত টেলিগ্রাম পেয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন মাধ্যমে সে নির্দেশ বিভিন্ন বাহিনী/সংস্থা এবং সকল স্তরের জনগণের নিকট তা পৌছে দেন এবং পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। একই ধারায় ২৬শে মার্চ বিকেল এবং ২৭শে মার্চ সকালে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম জিলা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ বিকেল এবং ২৮ মার্চ সকালে তৎকালীন ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহ অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানও বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চ ৭১ এ প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষনার নির্দেশের আলোকে এবং চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের অনুরোধে কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পুনরায় স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠ করেন যা ছিল নিæরুপ :“The Government of the Sovereign State of Bangladesh on behalf of our Great Leader, the Supreme Commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman. We hereby proclaim the independence of Bangladesh and that the Government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur is the sole leader of the elected representatives of Seventy Five Million People of Bangladesh, and the Government headed by him is the only legitimate government of the people of the Independent Sovereign State of Bangladesh, which is legally and constitutionally formed, and is worthy of being recognized by all the governments of the World. I therefore, appeal on behalf of our Great Leader Sheikh Mujibur Rahman to the Governments of all the democratic countries of the World, specially the Big Powers and the neighboring countries to recognize the legal government of Bangladesh and take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan…………..the legally elected representatives of the majority of the people ………………. The guiding principle of a new state will be first neutrality, second peace and third friendship to all and enmity to none. May Allah help us. Joy Bangla” (মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস, মেজর জেনারেল এম এস ভূইঁয়া) । মেজর জিয়া কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠ চট্টগ্রাম অঞ্চলের সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার এবং জওয়ানদের মধ্যে সাহসের সঞ্চার করেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্ধুদ্ধ করেছিল। এসবই ঐতিহাসিক সত্য। সুতরাং স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই।
৮) জিয়াউর রহমানবাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ব্রিগেড অধিনায়ক, সহকারী সেনা প্রধান ছিলেন। ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুসতাক সরকার তাকে সেনা প্রধান নিযুক্ত করেন। ১৯৭৫ এর শেষে দেশে সামরিক শাসন জারী হলে তিনি প্রথমে সহকারী প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। শেষে তিনি ’গণ ভোটের’ মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৮১তে এক ব্যর্থ সামরিক অভুত্থানে নিহত হন। তার জীবদ্দশায় তিনি স্বাধীনতার ইতিহাস, জাতির জনক, স্বাধীনতার ঘোষক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কোন বিতর্কের সৃষ্টি করেন নাই বরং ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ ”দৈনিক বাংলা” পত্রিকায় তার লিখিত ”একটি জাতির জম্ম” প্রবন্ধে তিনি বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক, স্বাধীনতার স্থপতি, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে তার মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। অবাক লাগে জেনারেল জিয়া নিজে যা স্পষ্ট ভাবে লিখে এবং বিশ্বাস করে গেছেন, তার আদর্শে প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি আজ তা অস্বীকার করে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে এবং জেনারেল জিয়াকেও বিতর্কিত করেছে।
৯)আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের জনগণ এবং ১৯৭০ এ নির্বাচিত সংসদ সদস্যবৃন্দ ১৭ই এপ্রিল ৭১ এ যে প্রবাসী সরকার গঠন করেন তাতে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করা হয় এবং তার নেতৃত্বেই এ সরকারের সকল কর্মকান্ড এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় যা ঐতিহাসিক সত্য। আমাদের ”স্বাধীনতার ঘোষনা পত্রে”ও (যা আমাদের সংবিধানের একটি অংশ) ২৬শে মার্চ ৭১ এ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঢাকায় স্বাধীনতা ঘোষনা এবং মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কথা দৃঢ়ভাবে উলেখ করা হয়েছে। ”স্বাধীনতার ঘোষনা পত্রের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করছি – ”যেহেতু ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সনের ১৭ জানুয়ারী পর্যন্ত একটি শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্যে বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৬৭ জনই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত করেছিলেন এবং যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্যে ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহŸান করেন এবং যেহেতু আহুত এ পরিষদ স্বেচ্ছাচার ও বেআইনীভাবে অনিদ্দির্ষ্টকালের জন্যে স্থগিত ঘোষনা করা হয় এবং যেহেতু পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্র“তি পালনের পরিবর্তে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলাকালে একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষনা করে এবং যেহেতু উলেখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভুত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষনা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে বাংলাদেশের জনগণের উদাত্ত আহŸান জানান………………………………..” (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল পত্র)। বিগত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মরহুম ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ১৯৯৫ সালের ২৬শে মার্চ দৈনিক বাংলা বাজার পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ’বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষনাকারী হিসেবে অস্বীকার করা সংবিধান লংঘন। স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র স্বাধীন বাংলাদেশের মূলভিত্তি। একে শুধু সংবিধানের অংশ বললে খাটো করে দেখা হবে। মূলত: এই ঘোষনাপত্রকে অস্বীকার করা স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্বীকার করার সামিল। ঘোষনা পত্রে স্পষ্টভাবে লেখা আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক। এই ঘোষনা অস্বীকার করা স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রকে অবমাননার তুল্য। এটি একটি দন্ডনীয় অপরাধ। ”সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন একইভাবে বলেছেন ’বঙ্গবন্ধুুই যে স্বাধীনতার ঘোষক এ সত্য সাংবিধানিক, এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। এটা কেউ অস্বীকার করলে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১২৩ক(১) অনুসারে তার জরিমানাসহ ১০ বছর কারাদন্ড হতে পারে।”
১০)১৯৭৫ এ গৃহিত আমাদের সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর ৩৪ (খ) অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুকে ”জাতির পিতা” হিসেবে উলেখ করা হয়েছে। ১৯৭৫ হতে আজ পর্যন্ত অনেকগুলো নির্বাচিত, অনির্বাচিত এবং সামরিক সরকার এবং নির্বাচিত জাতিয় সংসদ গঠিত হয়েছে। এ সব সরকার জাতিয় সংসদের মাধ্যমে আমাদের সংবিধানে পঞ্চম থেকে চতুর্দশ অর্থ্যাৎ দশটি সংশোধনী এনেছেন। এ সব সংশোধনীর মাধ্যমে ৪থ সংশোধনীর অনেক বিধানই রহিত করা হলেও ৩৪(খ) অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে উলেখ করার বিধান রহিত করা হয় নাই। এ রহিত না করার মাধ্যমে প্রমানিত হয় যে ১৯৭৫ থেকে আজ পর্যন্ত সকল সরকার এবং জাতিয় সংসদ বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করেছেন।
১১)সরকারীভাবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা ও মুদ্রন এবং এ সংক্রান্ত দলিলপত্র সংরক্ষনের জন্য ১৯৭৮ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় ”মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস লিখন এবং মুদ্রন” নামক একটি প্রকল্প গ্রহন করেন। নয় সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রো ভাইস চেন্সেলার প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর মফিজুলাহ কবির এবং সদস্য সচিব ছিলেন জনাব হাসান হাফিজুর রহমান। গবেষনা শেষে সরকার কর্তৃক ১৯৮২’র নভেম্বর মাসে ”বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল পত্র” নামে ইতিহাস ষোল খন্ডে প্রকাশিত হয়। অর্থ্যাৎ জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময় থেকে শুরু করে জেনারেল এরশাদের সময় পর্যন্ত এ প্রকল্পের কার্যক্রম অব্যাহত থাকার পর এ ইতিহাস প্রকাশিত হয়। এ দলিলেও বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক এবং স্বাধীনতার ঘোষক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
১২)১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনও প্রধানমন্ত্রী এবং কখনও রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যগণ বক্তব্য রেখেছেন। তাদের সকলেই বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক এবং স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ১৯৭২ এ আমাদের সংবিধান প্রণীত হয় এবং ০৪ই নভেম্বর ১৯৭২ তা তৎকালীন গণপরিষদ কর্তৃক গৃহিত হয়। এ সংবিধান পাশ করা উপলক্ষে দেয় বিভিন্ন সংসদ সদস্যদের ভাষনও আমি সংসদ পাঠাগারে পড়েছি। তারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক এবং স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আমি আশা করি উপরোক্ত এক ডজন তথ্য পাঠের পর আর কেও বাঙ্গালী জাতির জনক, স্বাধীনতার ঘোষক ইত্যাদি বিষয়ে অযথা অসত্য বিতর্কে জড়াবেন না ।
আমাদের গর্বের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে আজ ৪৫ বছর। স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক কারো কাম্য নয়। এ কথা সবারই জানা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক এবং অভিন্ন। একে আলাদা করার কোন উপায় বা পথ নেই। যতদিন পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের দেশটি থাকবে ততদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটিও জড়িত থাকবে। এটা কোন কাঠ পেন্সিলের লেখা নয়, যে রাবার দিয়ে মুছে ফেলা যায় বা যাবে। আজ যারা ইতিহাস বিকৃতির মত জঘন্য কাজে লিপ্ত তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ইংরেজরাও এক সময় নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নানা অপবাদ দিয়েছিল, জনগণের কাছে হেয় করতে চেয়েছিল, তার দেশ প্রেমকে অবজ্ঞা করাতে চেয়েছিল – কিন্তু পারে নাই। সিরাজ উদ দৌলা সমহিমায় জনগণের হৃদয়ে এবং ইতিহাসে ঠাই করে নিয়েছেন।পাকিস্তানের শাসক গোষ্টিও এ দেশের অনেক দেশ প্রেমিক ত্যাগী নেতাকে সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল কিন্তু তাদের কুচক্রান্তও সফল হয় নাই। তেমনি আজও যারা বঙ্গবন্ধুকে, আমাদের স্বাধীনতাকে, স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিতর্কিত করতে চায়, দেশপ্রেমিক ত্যাগী নেতাদের দেশদ্রোহী আখ্যা দেয় তারা কোন দিন সফল হতে পারে নাই, পারবে না। ইতিহাস সত্য বলবেই। বীর বাঙ্গালী জাতি সত্য থেকে বিচ্যুত হবে না। চলুন আমরা সকলে বাংলাদেশ এবং বাঙ্গালী জাতির সঠিক ইতিহাস রক্ষা করি। বিকৃত ইতিহাসের হাত থেকে আমাদের অবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করি।
লেখক: প্রেসিডিয়াম সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক মন্ত্রী বাণিজ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।