মুস্তাফা নুরউল ইসলাম
বঙ্গবন্ধুকে আমি চিনি অনেক আগে থেকেই। সময়ের হিসেবে যদি বলি আজ থেকে ছেষট্টি বছর আগে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। বয়সে তিনি আমার চেয়ে সাত বছরের বড়। ১৯৪৬ সালে আমি পড়তাম দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। আর তিনি পড়তেন কোলকাতায়, তখনকার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানের মাওলানা আজাদ কলেজ)। তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী, মফস্বলের ছেলেমেয়েরা কোলকাতায় ইসলামিয়া, প্রেসিডেন্সি বা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যেত। তবে সব কলেজের মধ্যে ইসলামিযায় এই বঙ্গের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। যা হোক, বঙ্গবন্ধু তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। থাকতেন বেকার হোস্টেলে। আমি তখন দিনাজপুরের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক সংগঠক। বঙ্গবন্ধু কোলকাতায় বৃহত্তর পরিসরে সংগঠকের ভূমিকায় অবত্তীর্ণ। আন্দোলনের সূত্রেই আমরা মফস্বলের ছেলেরা তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। বাড়ি থেকে পালিয়ে আমি একবার কোলকাতায় গিয়েছি। ক’দিন ছিলাম ওখানে। তখন বঙ্গবন্ধুর রুমেই উঠলাম। এ সময়ই তাঁর সঙ্গে রুম শেয়ারের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
তাঁর ডাইনিংয়ে তাঁর কুপন দিয়ে খাবার খেয়েছি। শুনেছি পশ্চিমবঙ্গ সরকার বঙ্গবন্ধুর ওই রুমটিকে মিউজিয়াম বানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর একটি বড় গুণ ছিল, তিনি যে কাউকে খুব সহজে আপন করে নিতেন, আর ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন। আমার সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ওই পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। আর তিনিও তখনই হয়ে গিয়েছিলেন আমার প্রিয় ‘মুজিব ভাই।’
তারপর থেকে এই ভাবেই তাঁকে সম্বোধন করতে অভ্যস্ত ছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশাসনিক নানা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সরকারপ্রধান শেখ মুজিবর রহমানের কাছে গিয়েছি। বহুবার মুখ থেকে অজান্তে ‘মুজিব ভাই’ সম্বোধনটি চলে আসত। থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিতাম।
যোগাযোগ পরে বেড়েছে আরও। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বঙ্গবন্ধু কোলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন। ১৯৪৮ সালে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। ওদিকে আমিও একই সময়ে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে পূর্ব বাংলার তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ ঘনীভূত হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু এবারও গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। আবারও আন্দোলনের মধ্যে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাত, বন্ধুত্ব।
প্রত্যেক ঘটনার শুরুরও শুরু থাকে। ভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। এই প্রসঙ্গে তরুণসমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সোচ্চার হয়ে উঠছিলেন। এর কারণ ছিল ১৯৪৭ র ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির আগেই ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।’ বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয় তখন থেকেই। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রয়াত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর প্রতিবাদে বললেন, ‘যেহেতু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলা, তাই বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করতে হবে।’
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ এর ৬ সেপ্টেম্বর বিকালে পুরনো ঢাকায় একটি প্রতিবাদ-সভার আয়োজন করা হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের সেখানে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ তাঁর মনে হচ্ছিল, মুসলিম লীগের ছাত্র ফ্রন্টের নেতা শাহ আজিজুর রহমানের পালিত সন্ত্রাসী, ঢাকার নওয়াব বাড়ি ও সরদার বাড়ির গুন্ডারা এবং চকবাজার মসজিদের ইমাম-পক্ষের লোকেরা সভায় হামলা করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর কথা মেনেই আমি সভায় যাইনি। সভায় একমাত্র বক্তা ছিলেন তখনও ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র শেখ মুজিবর রহমান। সেদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। মনে আছে বঙ্গবন্ধু সভা থেকে ফিরে এলেন মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে। ব্যান্ডেজে রক্তের ছোপ দেখা যাচ্ছে। তাঁর কাছে জানতে পারলাম, তিনি যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই সত্যি হয়েছে। সভায় হামলা করেছিল উর্দুর পক্ষের গুন্ডারা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেটাই প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ-সভা।
ভাষার দাবিতে এ ভাবেই বাঙালি তরুণ ও বুদ্ধিজীবীরা ধীরে ধীরে সরব হয়েছেন। ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আয়োজিত এক প্রতিবাদ-মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। প্রেপ্তার করে ক’জন নেতাকে। তাঁদের একজন বঙ্গবন্ধু, আমার মুজিব ভাই। এরপর থেকে প্রতিবছর ১১ মার্চ ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করতাম আমরা। বায়ান্নর পর বদলে গেছে দিনটা। তখন থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিই হয়ে গেল আমাদের প্রাণের ভাষার দিন।
এভাবেই আন্দোলনে-সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ তথা এস্টাব্লিশমেন্ট-বিরোধী শক্তিগুলোকে একত্র করে। বঙ্গবন্ধু হলেন ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা। আর আমরা তখন কর্মী।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রাম ঘিরে অনেক সময় কাটালেও, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তিনি যে বিবাহিত বা ইতিমধ্যেই পুত্র-কন্যার বাবা হয়েছেন তা জানা হয়নি। বায়ান্নর পর জানতে পারলাম সেটা। এমনই আন্তরিক ছিলেন তিনি আন্দোলনের প্রতি যে নিজের ব্যক্তিগত সুখ-শান্তি নিয়ে ভাবতেন না।
আসলে অকস্মাৎ কিছু হয়ে যায় না। ইতিহাসের ধারায় একেকজন একেকটা সময়ের দাবি পূরণ করে হয়ে উঠেন জননেতা বা জাতির জনক। আজ যে বিবিসি’র বিচারে বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন সেটা এমনি হয়নি। হঠাৎ করেই তিনি রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হননি। টুঙ্গিপাড়ার নদীঘেঁষা এক অখ্যাত গ্রামের গৃহস্থ শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবর রহমান হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। আজ পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাই, কীভাবে ধীরে ধীরে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এক মহানায়কের আবির্ভাব হয়েছে। আমার চোখে তাঁর শুরুটা দেখিছি। তারপর তাঁর শুধুই এগিয়ে চলার ধারাবাহিকতা।
পঞ্চাশের দশকের আরও কিছু ঘটনা উল্লেখ করলে শেখ মুজিবুর রহমানের জাতির পিতা হয়ে ওঠার চিত্রটি পরিস্কার হবে। ১৯৪৯ র সেই ভাষা-আন্দোলনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছাত্রনেতাকে বহিষ্কার করা হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাদের একজন। ছ’জন মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পেলেও বঙ্গবন্ধু আপোষ করেননি। ফলে আর ছাত্রত্ব ফিরে পাননি। নানা আন্দোলনের ফলে জেলে যেতে হয়েছে তাঁকে একাধিকবার। বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারিতেও তিনি ছিলেন জেলে। বাইরে যখন ছাত্রহত্যা হচ্ছে, ভেতরে তখন তিনি অনশন ধর্মঘট করছেন। এভাবেই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন তিনি পুরো সময়।
বায়ান্নতে যুক্তফ্রণ্টের নির্বাচন। সেখানেও গ্রাম-পর্যায়ে সংগঠক তিনি। ততদিনে একজন তরুণ নেতা হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিত। মন্ত্রীসভায়ও জায়গা পেলেন ওই বয়সেই। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রতিটি আন্দোলনে প্রধান সংগঠক। ইতিমধ্যে বাঙালির স্বাধিকা- চেতনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন পুরোপুরি। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন নিয়ে পূর্ব বাংলা জুড়ে তোলপাড়। ওদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু। তারা যেন কীভাবে বুঝে গিয়েছিলেন, আমরা যে আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে গড়ে উঠছি, তার প্রাণ হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই ওরা চাচ্ছিল আমাদের জাতীয় গণমাধ্যমে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া বন্ধ করতে। এরই মধ্যে সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বলে, রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো এখন থেকে নিষিদ্ধ থাকবে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, চল্লিশ জন বুদ্ধিজীবী এ সিদ্ধান্ত সমর্থন করে বক্তব্য দিলেন। প্রায় একই সময়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই। আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাহিবই।’ এভাবে ইতিহাসের ধারায় তিনি সবসময় সাহসী উচ্চারণের মাধ্যমে অনন্য হয়ে উঠেছেন। পড়েছেন মানুষের মনের কথা। এই যে বলতেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক’, এটা শুধু কথার কথা নয়– তাঁর কাজ, তাঁর আদর্শ তাঁকে সাধারণের কাতার থেকে সাধারণের নেতা বানিয়ে দিয়েছে।
পঞ্চাশের দশকে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি পার্লামেন্টেই বলেছিলেন, ‘আমরা আমাদের দেশকে পূর্ব পাকিস্তান নয়, পূর্ব বাংলা বলতে চাই।’ বঙ্গবন্ধুর মতো এভাবে আর কে বলতে পেরেছিলেন? উনিশশ’ একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেব, দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্।’ অথবা ‘আর আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না’। ৭ মার্চের ভাষণই তো একটি জাতির মুক্তির মহাবার্তা। আর কী দরকার?
আমি দেখেছি একজন মহান সংগ্রামীকে। দেখেছি সংগ্রামে-সংগ্রামে রক্ত ঝরে গড়ে ওঠা এক নেতাকে। জাতিকে তার সত্তাকে চিনতে সাহায্য করা এক পিতাকে। তিনিই আমার মুজিব ভাই।
পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর একটাই। যারা চায়নি এ জাতি গড়ে উঠুক, খুঁজে পাক সার্বভৌম ঠিকানা — তারাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। কে জড়িত ছিল তাদের সঙ্গে? কারা বেনিফিসিয়ারি? খন্দকার মুশতাক তো খুব বেশিদিন ক্ষমতায় ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক ঘন্টার মধ্যে মুশতাকের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হলেলেও পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন অন্যরা। তাই ‘পুতুল’ মুশতাককে তারা সরিয়ে দিয়েছে কয়েক মাস পরই। ক্ষমতায় এসেছেন জিয়াউর রহমান। তিনিই কি তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন?
যেহেতু তিনিই প্রধান বেনিফিরিয়ারি, তাহলে তাকেই দায়ী করতে হয়। আজ এই কথাগুলোও বলতে হবে। একটু একটু করে বলা হচ্ছেও। একসময় বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে জিয়ার ভূমিকা নিয়ে নিরব ছিলাম আমরা অনেকেই। এখন অন্তত কথাগুলো উঠে আসছে। এটাই দরকার ছিল।
আমি বলব, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে জড়িতদের চেহারাও উন্মোচিত হোক। আর অসাম্প্রদায়িক, মুক্তবুদ্ধির চেতনার লালনভূমি হিসেবে আরও বিকশিত হোক আমাদের এই দেশ।
মুস্তাফা নুরউল ইসলাম: লেখক, সম্পাদক ও জাতীয় অধ্যাপক।