অসত্যের কাছে কভু নত নহে শির


তোফায়েল আহমেদ
১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট জাতির জনককে পরিবারের ১৭ জন সদস্যসহ নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে পরিবারের সদস্যসহ এরূপ ভয়াবহভাবে হত্যার ঘটনা দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। ঘাতক খুনী-চক্র এমন বর্বর হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতিকে।

ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সকল অর্জনকে- রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি ও সংবিধানকে, আওয়ামী লীগকে, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে। সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে কুখ্যাত “ইনডেমনিটি বিল” চাপিয়ে দিয়ে তৎকালীন সামরিক সরকার এই ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিল। দীর্ঘ ২১টি বছর এর বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম শেষে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার অবৈধ ইনডেমনিটি বিল সংবিধান থেকে অপসারণ করে। বিচারের পথ হয় সুগম। প্রচলিত আইনে একজন বিচার প্রার্থী নাগরিক বিধি-বিধান অনুযায়ী যেসব আইনী অধিকার পেয়ে থাকেন সেভাবেই চলে বিচারিক প্রক্রিয়াটি। বিচারিক প্রক্রিয়ার সওয়াল জওয়াব শেষে বিজ্ঞ আদালত খুনীদের ফাঁসির রায় প্রদান করেন। পরবর্তীতে ২০০১-এর পর বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে বিচারের রায় ভণ্ডুল করতে খুনীচক্রকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য নানারকম টালবাহানা শুরু করে। এর বিরুদ্ধে আমাদের প্রাণপ্রিয় দল, বাংলাদেশের আপামর গণমানুষের দল, জাতির জনকের নিজ হাতে গড়া দল, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কখনো এককভাবে, কখনোবা মৈত্রীজোট গঠন করে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে সমমনাদের ঐক্যবদ্ধ করে রাজপথে-সংসদে কঠিন লড়াই-সংগ্রাম শেষে ২০০৮-এর ২৯শে ডিসেম্বর, বাংলার মানুষের গণরায়ের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে, জাতির জনকের হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে বাঙালি জাতিকে অভিশাপ ও কলঙ্ক মুক্ত করে। সমগ্র জাতি সেদিন কী হারিয়েছিল? জাতির জনককে হারানোর দীর্ঘদিন পর খুনীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় জাতীয় চেতনা থেকে অভিশাপের জগদ্দল পাথর অপসারিত হয়েছে।

মনে পড়ে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের ভোর থেকেই দিনটি কেমন বিভীষিকাময় ছিল। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের পরপরই সকালে আমাকে প্রথমে গ্রেফতার করে গৃহবন্দী করা হয়। ধানমন্ডির যে বাসায় আমি থাকতাম (এখন যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বাস করেন), সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত সেই বাসাটি সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। বাসায় কাউকে ঢুকতে বা বেরুতে দেওয়া হয় নি। আমার সাথে তখন বাসায় অবস্থান করছিলেন ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব শামসুদ্দীন আহমেদ মিয়া। তিনি ভোলা জেলা বাকশালের সেক্রেটারী ছিলেন। তারপর ১৭ তারিখ খুনীচক্রের অন্যতম ক্যাপ্টেন মাজেদের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর একদল উচ্ছৃঙ্খল অভ্যুত্থানকারী আমার বাড়ী তছনছ করে। ঘরের দেওয়ালে সংরক্ষিত বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলো ভেঙে, মায়ের সামনেই হাত-চোখ বেঁধে আমায় রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে খুনীচক্রের সমর্থনে আমার সম্মতি আদায়ে উপর্যুপরি নির্যাতন চালায়। তখনও জেনারেল শফিউল্লাহ সেনাপ্রধান এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল ব্রিগেড কমান্ডার। তাদের হস্তক্ষেপে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা জনাব আমিন আহমেদ চৌধুরী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) আমাকে বাড়ীতে মায়ের কাছে পৌঁছে দেন। এরপর ২৩ তারিখ ই এ চৌধুরী একদল পুলিশসহ এসে আমার বাসভবন থেকে আমাকে এবং জনাব জিল্লুর রহমানকে তাঁর বাসভবন থেকে বঙ্গভবনে নিয়ে যান। বঙ্গভবনে খুনী মোশতাক তাকে সমর্থন করার জন্য আমাদের দু’জনকে প্রস্তাব দেয়। আমরা দু’জনেই খুনী মোশতাকের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করি। এরপর আমাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ জিল্লুর রহমান, আমাকে ও জনাব আবদুর রাজ্জাককে একই দিনে গ্রেফতার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোণে অবস্থিত পুলিশ কন্ট্রোলরুমে ৬ দিন বন্দী রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। আমাদের সাথে আর একজন বন্দী ছিলেন। তিনি “দি পিপল” পত্রিকার সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক জনাব আবিদুর রহমান। পুলিশ কন্ট্রোল রুমের একটি ছোট্ট ঘরের মধ্যে পাশাপাশি দু’টি চৌকির একটিতে ঘুমাতাম আমি ও রাজ্জাক ভাই এবং অপরটিতে জিল্লুর ভাই ও আবিদুর রহমান। এমনি একদিন রমজান মাসের ৩ তারিখ আমরা রোজা রেখে নামাজ পরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শেষ রাতের দিকে সেনাবাহিনীর একদল লোক আমাদের কক্ষে প্রবেশ করে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকে “হু ইজ তোফায়েল”, “হু ইজ তোফায়েল!” রাজ্জাক ভাই জেগে উঠে আমাকে ডেকে তোলেন। আমি চোখ মেলে দেখি আমার বুকের ’পরে স্টেনগান তাক করা। আমি ওজু করতে চাইলে অনুমতি দেওয়া হয়। কক্ষের সাথেই সংযুক্ত বাথরুম। ওজু করে আসার সাথে সাথেই জিল্লুর ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আবিদুর রহমানের সামনেই আমার চোখ বাঁধে এবং বারান্দায় নিয়ে হাত বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। আমি অনুভব করলাম আমাকে রেডিও স্টেশনে আনা হয়েছে।

এরপর হাত-চোখ বাঁধা অবস্থায়ই চেয়ারের সাথে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে আমাকে অনেকগুলো প্রশ্ন করা হয়। তন্মধ্যে বঙ্গবন্ধু কী করেছেন, তাঁর কোথায় কী আছে এরকম বহু প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের কোনপ্রকার উত্তর না দেওয়াতে আমাকে ভীতি প্রদর্শন করে খুনীরা বলে, ইতিমধ্যে আমার এপিএস শফিকুল আলম মিন্টুকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সে আমার বিরুদ্ধে ৬০ পৃষ্ঠার এক বিবৃতি দিয়েছে। সেই বিবৃতিতে আমার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে। তথাপি আমি নিরুত্তর থাকি। শুধু একটি কথাই বলেছিলাম, “বঙ্গবন্ধু যা ভালো করেছেন আমি তার সাথে ছিলাম, যদি কোন ভুল করে থাকেন তার সাথেও ছিলাম। এর বেশী কিছুই আমি বলতে পারবো না।” তখন তারা চরম অসন্তুষ্ট হয়ে পুনরায় আমার উপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে। ভয়াবহ সেই নির্যাতনের ক্ষত এখনও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। তারপর আজানের সময় অর্ধমৃত অবস্থায় আমাকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদকারীদের মধ্যে খুনী ডালিমের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট চিনতে পেরেছিলাম। আমাকে রুমের মধ্যে একা রেখে তারা মিটিং করছিল আমাকে নিয়ে কী করবে? এখনো মনে আছে অজ্ঞাত একজন আমার মাথায় হাত রেখে শুধু বলছিল “আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন, আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন।” কারণ তার ধারণা হয়েছিল ঘাতকের দল আমাকে মেরে ফেলবে। শেষপর্যন্ত ঘাতকেরা এসে আমাকে বললো, “আমরা যে প্রশগুলো করেছি তার উত্তর দিতে হবে; উত্তর না দিলে আপনাকে আমরা রাখবো না।” বরাবরের মতো এবারও নিরুত্তর থাকায় পুনরায় তারা আমাকে নির্যাতন করতে থাকে এবং একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তখন ঘাতক দল পুলিশ কন্ট্রোল রুমের যে কক্ষে আমরা অবস্থান করছিলাম সেই কক্ষে রাজ্জাক ভাই ও জিল্লুর ভাইয়ের কাছে আমাকে অজ্ঞানাবস্থায় রেখে আসে। সেখানে জ্ঞান ফিরলে যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করতে থাকি।
শারীরিক অসহ্য ব্যথা নিয়ে যখন আর্তনাদ করছি তখন জিল্লুর ভাই ও রাজ্জাক ভাই আমার এ-অবস্থা দেখে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং তাঁরা দু’জনেই আমার সেবা-শুশ্রুষা করেন। এরপর সিটি এসপি সালাম সাহেব ডাক্তার নিয়ে আসেন। এ অবস্থার মধ্যেই রাতে মেজর শাহরিয়ার আমার কাছ থেকে বিবৃতি নিতে আসে। তিনি আমাকে বলেন, “যে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে তার লিখিত উত্তর দিতে হবে।” আমি মেজর শাহরিয়ারকে বললাম, ”আপনারা আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন দিতে পারেন; আমি কোন কিছু লিখতেও পারবো না, বলতেও পারবো না।” ওরা যখন দেখলো আমার কাছ থেকে কোন বিবৃতি আদায় করা সম্ভবপর নয়; তখন তারা উপায়ান্তর না দেখে চলে যায়। পরদিন অর্থাৎ ১২ই সেপ্টেম্বর আমাকে ও আবিদুর রহমানকে ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফাঁসির আসামীকে অন্ধকার নির্জন প্রকোষ্ঠে যেভাবে রাখা হয় ময়মনসিংহ কারাগারে আমাকেও সেইভাবে বন্দী করে রাখা হয়। এরপর ২০ মাস ময়মনসিংহ কারাগারে অবস্থানের পর ’৭৭-এর ২৬শে এপ্রিল আমাকে কুষ্টিয়া কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।

কুষ্টিয়া কারাগারে আটকাবস্থায় ’৭৭-এর ২৭শে এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনৈক সেকশন অফিসার কর্তৃক ব্যাকডেটে স্বাক্ষরিত অর্থাৎ ’৭৫-এর ১০ই সেপ্টেম্বর তারিখে জারি করা আটকাদেশের সত্যায়িত কপি আমার নিকট প্রেরণ করা হয়। আটকাদেশের সত্যায়িত কপি প্রাপ্তির পর আমার স্ত্রী আনোয়ারা আহমেদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আটকাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আমার পক্ষের আইনজীবীগণ সর্বজনাব সিরাজুল হক, এএইচ খোন্দকার, সোহরাব হোসেন, সালাহউদ্দীন আহমেদ এবং শ্রী সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত আদালতে বলেন, “তাঁর আটক সম্পূর্ণ অন্যায় এবং ১৯৭৫ সালের জরুরী ক্ষমতা আইনের আওতায় তাঁর আটকাদেশের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার মতো কোন তথ্য-প্রমাণ সরকারের হাতে নেই। ফলে উক্ত আটকাদেশ অবৈধ ও আইনের এখতিয়ার বহির্ভূত।” বিচারপতি জনাব কে এম সোবহান এবং বিচারপতি জনাব আবদুল মুমিত চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ’৭৮-এর ৯ই জানুয়ারি এক রুল জারি করেন। রুলে বলা হয়, “কারাগারে আটক জনাব তোফায়েল আহমেদকে কেন আদালতের সামনে হাজির করা হবে না এবং কেন তাকে মুক্তি দেওয়া হবে না” সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ও অন্যদের কারণ দর্শাতে বলা হচ্ছে? কুস্টিয়া কারাগারে যখন আমি বন্দী তখন আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। রাজ্জাক ভাই এবং আমার একসাথে রিট হয়। রাজ্জাক ভাই হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেলেও আমি মুক্তি পাই নি। অবশেষে সুপ্রীম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে আমি মুক্তি পেলাম ৪ মাস পর অর্থাৎ ১৯৭৮-এর ১২ই এপ্রিল। কুষ্টিয়া কারাগারে ১৩ মাস সহ সর্বমোট ৩৩ মাস বন্দী থাকার পর আমি মুক্তি লাভ করি। ইতিমধ্যে কারাগারে আটকাবস্থায় আমি আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই।
tofael-mujib
১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেই খুনীচক্র ক্ষান্ত হয় নি; একই বছরের ৩রা নভেম্বর কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা নেতৃত্ব দিতেন বা বারংবার নেতৃত্ব দিয়েছেন, দলের এবং সরকারেরÑ ঐতিহাসিক মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, কামারুজ্জামান সাহেব, যাঁরা জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেনÑ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্য তাঁদেরকে কারাভ্যন্তরে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের আসল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় রাজনীতিতে চরম শূন্যতা তৈরী করা। সেই মুহূর্তে ১৫ই আগস্ট ও ৩রা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের পর ’৭৬-এ দলের হাল ধরেন জনাব মহিউদ্দীন আহমেদ। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি। যখন ’৭৫-এ “বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ” গঠিত হয়, তখন তিনি ছিলেন জাতীয় নির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- ও জেলহত্যার পর ’৭৬-এ যখন দল পুনর্গঠিত করার সুযোগ এলো তখন মহিউদ্দীন আহমেদকে অস্থায়ী সভাপতি আর সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করে করে দল অগ্রসর হলো। আওয়ামী লীগ তখন নিষিদ্ধ। এরপর ’৭৭-এ সেনাশাসক জিয়াউর রহমান দরখাস্ত করে দলের অনুমোদন দিতে আরম্ভ করেন। যেহেতু, আওয়ামী লীগ কোন গুপ্ত সংগঠন নয়, নিয়মাতান্ত্রিক দল তথা কন্সটিটিউশনাল পার্টি। সেহেতু, অবৈধ পন্থায় দাবী আদায়ের দৃষ্টান্ত দলের ইতিহাসে নাই। সুতরাং, আওয়ামী লীগকে চিরাচরিত সাংবিধানিক পথেই এগুতে হয়েছিল। অনেক ষড়যন্ত্র করেছে জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিতে বলেছে, দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে মূলনীতিসমূহ পরিবর্তন করতে বলেছে। কিন্তু নেতৃবৃন্দ বাদ দেন নাই। ’৭৭ সনে জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে সুন্দর কমিটি গঠিত হয়েছিল। তারপর ’৭৮ সনে যখন আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়, তখন প্রয়াত শ্রদ্ধাভাজন সংগ্রামী জননেতা জনাব আব্দুল মালেক উকিল সভাপতি, রাজ্জাক ভাই সাধারণ সম্পাদক এবং আমি সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হই। ’৭৮-এর ১২ই এপ্রিল, কারাগার থেকে বেরিয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করি। রাজ্জাক ভাই, আমি এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যেমন আব্দুল মান্নান, আব্দুল মোমিন, মহিউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ প্রত্যেকেই দলকে পুনসংগঠিত করতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন। শেখ আব্দুল আজিজ, আবদুস সামাদ আজাদ থেকে শুরু করে যারা বরেণ্য নেতৃবৃন্দ তাঁরা তখন কারাগারে। যারা বাইরে ছিলেন সকলেই দলকে সংগঠিত করতে কাজ করেছেন। কারামুক্ত হওয়ার পর আমি ও রাজ্জাক ভাই, মালেক উকিল সাহেবকে সামনে রেখে সংগঠনকে তৃণমূল থেকে মজবুত ও চাঙ্গা করার চেষ্টা করি। মুক্তিযুদ্ধের পর ’৭২ থেকে ’৭৫ কালপর্বে দল ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় সদ্য-স্বাধীন দেশে ষড়যন্ত্রকারী গুপ্তঘাতকদের হাতে পাঁচ জন সংসদ সদস্যসহ চার হাজারেরও বেশি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছে। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার অবর্তমানে নেতা-কর্মীদের মনোবল শক্তিশালী ও সংগঠিত করতে আমরা ছিলাম বদ্ধপরিকর। সারা বাংলাদেশ আমরা চষে ফেলেছিলাম। এমন কোন থানা বা ইউনিয়ন ছিল না এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পর্যন্ত আমরা সাংগঠনিক সভা করেছি। আমার মনে আছে, তখন বছরে ১২ মাসের মধ্যে ৯ মাসই আমরা মফস্বলে থাকতাম।

দেশের এমন কোন স্থান নাই যেখানে আমরা সফর করি নাই। এলাকা ভাগ ভাগ করে নিজদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে আমরা কর্মসূচী ঠিক করে নিতাম। এমনকি রোজার মাসে আমার এখনো মনে আছে, এক রোজায় সেই ’৭৯ সালে পঞ্চগড়ের আমাদের সাবেক এমপি, জনাব সিরাজুল ইসলাম, তাঁর গাড়ীতে করে আমি পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁ, নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, লালমনিরহাট সফর করেছি। প্রতিটি থানায় দিনে ২-৩টা করে মিটিং করেছি। এভাবেই আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করেছি।

আমাদের দৃঢ় মনোবল ছিল ক্ষমতা দখলকারী খুনী মোশতাক ও তার দোসর সেনাশাসক জিয়া উভয়েই সংবিধান লঙ্ঘনকারী এবং অবৈধ। তাদের ক্ষমতার আস্ফালন সাময়িক। এরা মিথ্যাচার করে বিপথগামী সেনা সদস্যদের ব্যবহার করে পেছনের দরোজা দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে। ১৯৭৫-এর ২০শে আগস্ট যে প্রোক্লেমেশন জারী করে, সংবিধান স্থগিত করে খুনী মোশতাক বাণিজ্য মন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি বনে গিয়েছিল তার ভাষ্যটি ছিল,, “I Khandaker Moshtaque Ahmed, …have taken over all and full powers of the Government of the People’s Republic of Bangladesh with effect from the morning of the 15th August, 1975. And whereas I placed, on the morning of the 15th August, 1975, the whole of Bangladesh under Martial Law by a declaration broadcast from all stations of Radio Bangladesh.” অথচ ক্ষমতাসীন হওয়ার আগ পর্যন্ত খোন্দকার মোশতাক ছিল মন্ত্রীসভার সদস্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মাত্র। সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপ্রধানের অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি, সংসদের স্পীকার, প্রধান বিচারপতি তখনও বর্তমান। এতদসত্ত্বেও নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে খুন করে, সাংবিধানিক পন্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে সীমাহীন মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে খুনীচক্র রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিল। একই প্রোক্লেমেশন বলে খুনী মোশতাক ঘোষণা করে যে, …“I have suspended the provisions of article 48, in so far as it relates to election of the President of Bangladesh, and article 55 of the Constitution of the People’s Republic of Bangladesh, and modified the provisions of of article 148 thereof and form I of the third shedule thereto to the effect that the oath of office of the President of Bangladesh shall be administered by the Chief Justice of Bangladesh and that the President may enter upon office before he takes the oath;” তৎকালীন সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদটি ছিল, “রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি” সম্পর্কিত। অনুচ্ছেদ ৪৮-এ বলা হয়েছিল, “বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, যিনি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত হইবেন।” যেহেতু খুনীচক্রের হোতা খোন্দকার মোশতাক জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নন, বরং অস্ত্রের জোরে অবৈধপন্থায় বেআইনীভাবে তার আগমন। সুতরাং, সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের যতটুকু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত ততটুকু স্থগিত করে দিলো। স্থগিত করা হলো ৫৫ অনুচ্ছেদটি। এই অনুচ্ছেদে ছিল, “অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি” শিরোনামে “রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ক্ষেত্রমত শূন্যপদে নির্বাচিত নূতন রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত উপ-রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতিরূপে কার্য করিবেন।” যেহেতু খুনী মোশতাক ছিল বাণিজ্য মন্ত্রী, আর উপ-রাষ্ট্রপতি জীবিত ছিলেন বিধায় খুনী মোশতাকের পক্ষে রাষ্ট্রপতির পদে সমাসীন হওয়ার কোনো সাংবিধানিক সুযোগ না থাকায় সেটি স্থগিত হলো। তারপর ১৪৮ অনুচ্ছেদটি ছিল শপথ-সংক্রান্ত। রাষ্ট্রপতির শপথ-সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধি-বিধানকে ভূলুণ্ঠিত করা হলো। অপরদিকে সেনাশাসক জিয়া বিচারপতি সায়েমকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিল স্রেফ বন্দুকের জোরে। সুতরাং, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকারী খুনী চক্রের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অসাংবিধানিক। খুনীচক্রের এই অবৈধ অবস্থানের মধ্যেই নিহিত ছিল আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংগঠিত করার অমোঘ মন্ত্র। কেননা, বৈধ, নিয়মাতান্ত্রিক সাংবিধানিক নীতিই হচ্ছে আওয়ামী লীগের রাজনীতি। আজ উচ্চ আদালত কর্তৃক ৫ম সংশোধনী বাতিলের মধ্যদিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, মিথ্যার জয় সাময়িক, সত্যের জয়-ই চূড়ান্ত। সেদিন সাংবিধানিক সত্য প্রতিষ্ঠায় আমরা যেখানেই গিয়েছি নেতা-কর্মীদের বুঝিয়েছি এই সরকার অবৈধ-অসাংবিধানিক। আমাদের লক্ষ্য দেশকে আবার সাংবিধানিক-গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে জাতির জনক সহ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করা।
আমাদের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে নানা মহল থেকে ষড়যন্ত্র আর ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করা হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরী নির্বাচনের আগে দল থেকে চলে গেলেন। যারা দলে ছিলেন অথচ ষড়যন্ত্র আর দল ভাঙনে তাল দিলেন না, সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিকে ধ্যান-জ্ঞান করলেন, তাদের উপর নেমে এলো চরম নির্যাতন-নিপীড়ন। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আমি ৩৩ মাস কারাগারে বন্দী ছিলাম। তারপরে যখন মুক্তি পেলাম জিয়াউর রহমান তখন রাষ্ট্রপতি। আমরা তার সামরিক শাসনের মধ্যেই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। এমনকি ঢাকায় ১৯৮০ সনে রাজশাহী কারাগারে জেলহত্যার বিরুদ্ধে আমরা যে হরতাল কর্মসূচী দিয়েছিলাম, সেই মিছিলে আমি আর রাজ্জাক ভাই নেতৃত্ব দিয়েছি। সামরিক সরকার মিছিলের উপর ট্রাক চালিয়ে দিয়েছিল। কোনক্রমে বেঁচে গিয়েছিলাম। জিয়াউর রহমান ছিলেন নীতিহীন স্বৈরশাসক। তিনি প্রকাশ্যে জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন,“I will make politics difficult for politicians” এবং এই নীতিহীন প্রচেষ্টায় তিনি সফল হয়েছেন। ক্ষমতা এবং নীতিহীনতা একত্রিত হলে কী হয়, সেদিন জিয়াউর রহমান তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন! এরপর ’৭৯-এর যে নির্বাচন হলো, আমি সেই নির্বাচনের বিরুদ্ধে ছিলাম। ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোটের মাধ্যমে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান যখন ৯৯% ভোট পক্ষে নিলেন তখন আমরা শহীদ মিনারে শপথ নিয়েছিলাম, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনে আমরা নির্বাচন করবো না। কারণ, আমরা ইঙ্গিত পেয়েছিলাম এই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে জেনারেল জিয়ার প্রয়োজন একটি রাবারস্ট্যাম্প পার্লামেন্ট। এই ঘৃণ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদদের বেচা-কেনার সামগ্রীতে পরিণত করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে কলুষিত করতে জিয়াউর রহমান আরো ঘোষণা করেছিলেন, “Money is no problem” এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দু’হাতে অর্থ ছড়িয়ে বহু রাজনীতিককে ক্রয় করে রাতারাতি তিনি বিএনপি নামক দল খাড়া করলেন। অর্থ দিয়ে রাজনীতিকদের ক্রয় করার অংশ হিসেবে জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে প্রথমে আমার নিকট বিভিন্নরকম অস্বস্তিকর প্রস্তাব আসতে লাগলো। সেগুলি ছিল হীন স্বার্থ-সম্বলিত প্রস্তাব। সমস্ত প্রস্তাব আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমাকে দু’টি আসন দেওয়া হবে যদি আমি নির্বাচনের পক্ষে থাকি। কিন্তু আমি নির্বাচনের পক্ষে থাকি নাই। রাজ্জাক ভাই নির্বাচনের পক্ষে মত দিলেন এবং শেষ পর্যন্ত মেজরিটি ইলেকশনের পক্ষে গেলো। আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলাম। অথচ শুরুতে নির্বাচনের পক্ষে থেকেও শেষে কিন্তু রাজ্জাক ভাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন না। সেই নির্বাচনে আমি দু’টি আসনে বিজয়ী হয়েছিলাম। দু’টি আসনে বিজয়ের পর আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণায় আমাকে পরাজিত করা হলো। প্রথমে একটি আসনে আমাকে ডিক্লেয়ার করলো আমি জয়লাভ করেছি। পরে চারটি ইউনিয়নের ব্যালট বাক্স ভোলা শহরে নিয়ে এসে আটকে রাখা হলো। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার পরাজয় নিশ্চিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত দখলে থাকা ব্যালট বাক্সগুলোর ভোট আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে আমাকে হারানো হলো। যাহোক আমাকে বঙ্গবভনে নেওয়ার জন্য জিয়াউর রহমান বহু চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি তার সঙ্গে কখনো দেখা করি নাই। দেখা না করার বহু কারণ ছিল। আমি যখন বঙ্গবন্ধুর পলিটিকাল সেক্রেটারী (প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায়) তখন তিনি আমার সঙ্গে একরকম ব্যবহার করতেন। এখন তিনি রাষ্ট্রপতি আর আমি একজন সাধারণ মানুষ। তিনি এখন আমার সাথে আরেক রকম ব্যবহার করবেন। এই আরেক রকম ব্যবহার আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আমার ভালো লাগবে না বলেই আমি যাই নাই। এমনকি আমাদের দলের কয়েকজন বাজিতপুরের, তাদের ফাঁসীর আদেশ হয়েছে। জিয়াউর রহমানের কাছে যেতে হবে ফাঁসীর দণ্ডাদেশ মওকুফের জন্য। রাজ্জাক ভাই সহ অন্যরা গেলেন, আমি যাই নাই। রাজ্জাক ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি যাবা না কেন?” আমি বললাম, আমি যাবো না। জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করলে বদনাম হয়। বন্ধুত্ব করলে ফাঁসী হয়। এর কোনটাই আমার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয় নাই। দেখা করার জন্য প্রচণ্ড চাপ ছিল। আমি সেসব উপেক্ষা করেছি, দেখা করি নাই। কারণ জিয়াউর রহমান ছিলেন বিশ্বাসঘাতক এবং নীতিহীন ব্যক্তি। আমি যখন বঙ্গবন্ধুর পলিটিকাল সেক্রেটারী তখন উনি সবসময় আমার দপ্তরে আসতেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার একমাস আগে তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করবার জন্য। আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিলাম। বঙ্গবন্ধুর সামনে কোরান শরীফ ছুঁয়ে শপথ নিলেন ভবিষৎতে তিনি বেঈমানী করবেন না। তারপরে কী হয়েছে বাংলার মানুষ জানে। তাকে বিদেশে দূতাবাসে চাকরী দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এটা যাতে না করা হয় সেজন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে সেই চেষ্টাই তিনি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দয়ালু মানুষের সামনে যখন কোরান শরীফ ছুঁয়ে শপথ করে বললেন, “আমি কোনদিন আপনার সাথে বেঈমানী করবো না। আমাকে বিদেশে পাঠাবেন না। আমি আপনার এখানে আপনার সাথে থাকতে চাই।” বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে সেই আদেশ ক্যান্সেল করে দিলেন। আমিই সেদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে তাকে দেখা করিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিনের সেসব কথা মনে করে আমি কোনদিন এই বিশ্বাসহন্তারক ঘৃণিত লোকটির সঙ্গে দেখা করি নাই।

জিয়াউর রহমানের আমলে আমাদের উপর অনেক নির্যাতন হয়েছে। আমাদের মিছিল-মিটিংয়ে আক্রমণ হয়েছে। যখন জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এলেন তার আগ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের আমলে এই সামরিক শাসনের আমলে আমরা কতো কষ্ট করেছি। কীভাবে আমরা দলকে সংগঠিত করেছি এবং কীভাবে আমরা নেতা-কর্মীদের পাশে দাড়িয়েছি? আজকে সেটা আমি বর্ণনা করতে পারবো না। কিন্তু সেইদিনগুলোর বীভৎস মৃত্যু-উপত্যকা পেরিয়ে আজ যখন দেখি গণমানুষের মধ্যে দলের সাংগঠনিক তৎপরতা কম, তখন আমার অতীত দিনের সেইসব কথা মনে পড়ে যায়। সামরিক শাসনের মধ্যেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আমরা সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছি। চরম দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও আমরা আপোষ করি নাই। ’৭৫-এর পর সেই চরম দুঃসময়ে ’৭৮-এ আমি সাংগঠনিক সম্পাদক, রাজ্জাক ভাই সাধারণ সম্পাদক, মালেক উকিল সভাপতি তখন তো একটা করুণ অবস্থা। সারা দেশ জুড়ে হত্যা, গুম, গ্রেফতার আর ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা। অবর্ণনীয় করুণ অবস্থায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমাদের কেটেছে। নিজের বাড়ীতে থাকতে পারি নাই। পাঠক ক্ষমা করবেন! নেহায়েৎ ব্যক্তিগত বিষয় বলছি। আসলে আমরা যারা জনকল্যাণের রাজনীতি করি তাদের ব্যক্তিগত কোন বিষয় নাই। রাজনীতির সাথে ব্যক্তিগত জীবন একাকার হয়ে আছে। আমি যখন কারাগারে, আমার স্ত্রীকে কেউ বাড়ী ভাড়া দেয় নাই। তোফায়েল আহমেদের স্ত্রীকে বাড়ী ভাড়া দিলে আর্মি ধরে নিয়ে যাবে। আমার ভাগ্নি-জামাই নজরুলের নামে বাড়ী ভাড়া নিয়ে পরিচয় গোপন করে মাসিক দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় সেই বাড়ীতে আমার স্ত্রী থেকেছেন। তিনি একবছর ছিলেন কলাবাগানে। সেই বাসায় কোন ফ্যান ছিল না। পরে আমার স্ত্রী এক এডিসি’র কল্যাণে, অপার মমত্ববোধে তাঁর আজিমপুরের বাসার দোতলায় তিনি আমার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আমি কারামুক্ত হয়ে ফিরে এলে তাঁর সেই আজিমপুরের বাসায় আমাদের ঠাঁই হয়। তিনি বরিশালের এডিসি ছিলেন। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। সেই সময় করুণ অবস্থা গেছে আমার পরিবারের। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র ২১,০০০ টাকা ছিল। স্ত্রীর নামে ছিল ৮,০০০ আর মেয়ের নামে ৪,০০০ টাকা। জিয়াউর রহমান এগুলো ফ্রিজ করেছেন। আমরা ঐ টাকা তুলতে পারতাম না। ব্যাংকে আমার আর কোন টাকা ছিল না। তারপর আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দেওয়ার বহুরকম চেষ্টা করেছেন। কোন দুর্নীতি আবিষ্কার করতে পারেন নাই। কোন মামলা দিতে পারেন নাই। শেষপর্যন্ত কেরাণীগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা বোরহানউদ্দীন গগনকে দলের সাংগঠনিক কাজ করার জন্য আমি সাধারণ একটা গাড়ী দিয়েছিলাম। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি সেই গাড়ী ফেরৎ দিয়েছিলেন। অথচ সেই গাড়ীর জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। জিয়াউর রহমান সাংঘাতিকভাবে ক্ষিপ্ত ছিলেন আমার উপর। কারণ, তিনি অনেককে পাঠিয়েছেন আমার কাছে তার সাথে দেখা করার জন্য। আমি দেখা করি নাই। আমার এই বনানীর বাড়ী, এই বাড়ীর জমি বঙ্গবন্ধু আমাকে দিয়েছিলেন। ’৭৫-এর ৩০শে জুলাই বরাদ্দ করে দিলেন আমার স্ত্রীর নামে। ১৫ই আগস্ট ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমি কারাগারে। আর আমার কোন খবর নাই। ’৭৬-এ আমার স্ত্রী চিঠি পেলেন বরাদ্দকৃত প্লটের জন্য টাকা জমা দিতে হবে। আমার স্ত্রীর নিকট কোন টাকা নাই। তখন তার ২৮ ভরি স্বর্ণ, যার থেকে ইতিমধ্যে ৪ ভরি বিক্রি করে খেয়েছেন। আর ২৪ ভরি বন্ধক দিয়ে ভোলার সোনালী ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু প্রথম কিস্তি পরিশোধে লাগবে ১৭ হাজার টাকা। ১ লাখ টাকা করে বিঘা। এখানে জমির পরিমাণ ১২ কাঠার থেকে একটু কম। তাতে জমির দাম হয় ৫৯ হাজার টাকা। ১৩ হাজার টাকা জোগাড়ের পর ৪ হাজার টাকা দিয়েছিলেন রফিকুল্লাহ চৌধুরী। আজকে যিনি আমাদের প্রতিমন্ত্রী শিরিন শারমীন চৌধুরী, তার বাবা। তিনি ৪ হাজার টাকা দিয়ে আমার স্ত্রীকে সাহায্য করার পর এই বাড়ীর প্রথম কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভবপর হয়েছিল। আমার এপিএস ছিল শফিকুল ইসলাম মিন্টু। আমি তাকে চাকরী দিয়েছিলাম ১৯৭৩ সনে। ১৫ই আগস্টের পর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেওয়ার জন্য খুনীচক্রের ক্যাপ্টেন মাজেদের নেতৃত্বে কতিপয় সেনাসদস্য তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু মিথ্যা স্বাক্ষ্য দিতে রাজী না হওয়ায় মিন্টুকে হত্যা করে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়। তার মৃতদেহটি পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। আমার মেজো ভাইকে ’৭৫-এর ৫ই অক্টোবর গুলী করে হত্যা করা হয়। গ্রামের বাড়ী থেকে ডেকে নিয়ে তাঁকে হত্যা করে সর্বহারা পার্টির লোকেরা। আমার বড় ভাই ’৭৫-এর ১১ই জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। আমি তখন ময়মনসিংহ কারাগারে। এক ছেলে কারাগারে, দুই ছেলে নাই। আমার মায়ের তখন কী ভয়াবহ আর করুণ অবস্থা! আমার ঢাকার বাসায় তখন বড় ভাইয়ের ছেলে টুটুল, বড় ভাইয়ের মেয়ে রোকেয়া, সেজো ভাইয়ের ছেলে মিলন, আরেক ছেলে খোকন, মেজো ভাইয়ের মেয়ে রুজু থাকে। তারা কেউ পড়ে স্কুলে, কেউবা কলেজে। আমি যখন বঙ্গবন্ধুর পলিটিকাল সেক্রেটারী তখন আমার ২ ভায়ের ২ মেয়ে ও ১ বোনের মেয়ে ৩ জনকে আমি ইডেন কলেজে ভর্তি করি। ওরা আমার বাড়ীতে থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করে। এরা তিনজন আমার বাসায় থাকে। আমার মেজো ভায়ের ১ ছেলে রেসিডেনশিয়াল মডেলে পড়ে সে আমার বাসায় থাকে। তার আরেক ভাই খোকন সে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরীতে পড়ে। মেজো ভায়ের মেয়ে রুজু সে উদয়নে পড়ে। আমার স্ত্রীর ভাই হুমায়ুন, আমার বাসায় থাকে। এতোগুলো ছেলে-মেয়ে আর সদস্য নিয়ে আমার স্ত্রীর সংসার পরিচালনা করার সামর্থ্য ছিল না। আমার শ্বশুর বাড়ী থেকে মাসে ৩ হাজার টাকা পাঠাতেন। আমার এক শুভাকাক্ষী মজু ভাই তিনি প্রতিমাসে ২ হাজার টাকা দিতেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তাঁর বেহেস্ত কামনা করি। আমার এক বন্ধু হামিদ, যে চাকরীর বেতনের টাকা থেকে আমার স্ত্রীকে অর্থ সাহায্য করতেন। এইভাবে প্রাপ্ত সর্বমোট ৭,০০০ টাকা, যার মধ্যে ১,৫০০ টাকা বাড়ী ভাড়া দিয়ে বাকী ৫,৫০০ টাকায় আমার স্ত্রী সংসার নির্বাহ করতেন। আমার বাসায় কোন ফ্যান বা তেমন কোন আসবাবপত্র ছিল না। আমি তো সরকারী বাসভবনে ছিলাম। আমার গ্রেফতারের পর যেদিন আমার স্ত্রী বাড়ী থেকে বেরিয়ে যান সেদিন তো তার কিছুই নাই, কপর্দক শূন্য। একটা খাট আর আলমিরা ছিল। ছেলেমেয়েগুলো সবাই ফ্লোরিং করতো। আমি যেই বাড়িটাতে ছিলাম। সেটা ছিল অ্যাবানডন হাউস তথা পরিত্যক্ত বাড়ী। গভর্নমেন্টের বাড়ী। ধানমন্ডীর ৩নং রোডে বর্তমান আওয়ামী লীগ অফিসের পাশের বাড়ীটা। সেখানে এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশিনের চেয়ারম্যান থাকেন। এই বাড়ীটা প্রথমে বরাদ্দ দিয়েছিল “তোফায়েল আহমেদ, পলিটিকাল সেক্রেটারী টু প্রাইম মিনিস্টার” অর্থাৎ আমার নামে। তখন আমার বয়স ৩২। এই অল্প বয়সে আমি চিন্তা করি আমার নামে বরাদ্দপত্র দিবে কেন? তাহলে তো এটা মনে করার অবকাশ থাকবে যে এটা আমার বাড়ী। তখন আমি আমার নাম বাদ দিয়ে বরাদ্দপত্র সংশোধন করে “অ্যালোটেড টু পলিটিকাল সেক্রেটারী টু দি প্রাইম মিনিস্টার” লেখার নির্দেশ দেই। পরবর্তীতে এই বাড়ীর জন্যই জিয়াউর রহমান আমার নামে এই মর্মে মামলা দিয়েছিল যে এই বাড়ী আমি দখল করেছি। যখন আদালত বিশদে কাগজপত্র বিশ্লেষণ করলো তখন প্রমাণিত হলো যে, বাড়ীটি “পলিটিকাল সেক্রেটারী টু দি প্রাইম মিনিস্টার”-এর নামে অ্যালোটেড। ফলে মামলা বাতিল হলো। এইভাবে একের পর এক মামলা দিয়ে আমাকে হেনস্থা করা হয়েছে। যখন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পাশের বাড়ী এখন যেথায় বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিকের পিতা মালেক সাহেব থাকেন তাঁর বাসায় আমি থাকি। প্রধানমন্ত্রীর পলিটিকাল সেক্রেটারী হিসেবে ৭,৫০০ টাকা বাড়ী ভাড়া পেতাম। সে বাড়ীর ভাড়া ছিল ৬০০ টাকা। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বাড়ীটা আমাকে ভাড়া নিয়ে দিয়েছিলেন। এই বাড়ীর মালিক মালেক সাহেবকে আর্মির লোকেরা এসে চাপ দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে এই স্বীকারোক্তি নিতে যে, “আপনি বলেন তোফায়েল আহমেদ জোর করে আপনার বাড়ীতে ছিলেন।” তখন মালেক সাহেব উত্তর দিয়েছেন, “তিনি জোর করে থাকেন নাই। ভাড়া নিয়ে থেকেছেন এবং যেদিন আমি নিজে থাকবো বলে বাড়ীটি ফেরৎ চেয়েছি সেদিনই উনি চলে গিয়েছেন।” জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার এইরকম ক্ষিপ্ত ছিল আমার উপর। এই অবস্থার মধ্যদিয়ে ধীরে ধীরে আমরা সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে আমাদের মূল দলসহ সকল সহযোগী সংগঠনকে শক্তিশালী করে নিজদের মধ্যে সকল ভেদাভেদ ভুলে সমঝোতায় এসে, কেবল দলকেই ধ্যান-জ্ঞান করে, দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ১৯৮১ সনে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে আমরা আওয়ামী লীগের পতাকা তুলে দিয়েছি। তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে দলের সেই পতাকা গৌরবের সাথে সমুন্নত রেখেছেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হবার পর আমরা তাঁকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে যেখানেই গিয়েছি সেখানেই সর্বস্তরের গণমানুষের সমর্থন পেয়েছি। ব্যাপক গণসমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছে সংবিধান ও সত্যের কাছে আমাদের অঙ্গীকার ও দৃঢ় মনোবল। যা গড়ে উঠেছিল ঊনসত্তর আর একাত্তরের মহত্তর চেতনায় তথা জাতির জনকের চেতনার ভিত্তিতে।

পরিশেষে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দীন ও লিয়াকত আলী খান ঘরোয়া-প্রকাশ্য সভাগুলোতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের প্রতিহত করতে গু-া লেলিয়ে নানারকম হুমকি দিয়ে রক্তচক্ষু দেখিয়ে বলতেন, “শির কুচাল দেঙ্গে!” এর বিপরীতে বঙ্গবন্ধু মুজিবের চেতনার মূল মর্মবাণী নিহিত আছে তাঁর সারা জীবনের সংগ্রামের এই অমোঘ কথা কয়টিতে “অসত্যের কাছে কভু নত নহে শির, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর!” বঙ্গবন্ধু মুজিব সারা জীবন শির উঁচু করে বীরের মতো অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। আর ’৭৫-এর মর্মন্তুদ ঘটনার পর থেকে আজ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে শির সমুন্নত রাখার সাহসী অভিযাত্রায় এটা প্রমাণিত সত্য যে আওয়ামী লীগ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের চেতনার সফল ও সার্থক উত্তরাধিকার।

SUMMARY

1280-1.jpg