মঈনুল ইসলাম
পূর্বাভাস: আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার একটি প্রধান বয়ান এখন আমরা পেয়েছি। স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা, স্বাধীনতাযুদ্ধে দেশি ও বিদেশিদের অবদান ইত্যাদি বিষয়ে একটি প্রধান বয়ানের (Grand Narrative) কাছাকাছি আমরা পৌঁছে গিয়েছি।
হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র’ ১৯৭৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৫ খণ্ডে বর্তমানে এই দলিলপত্র আমরা পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও বাংলাদেশের স্থপতির জীবন ও কর্ম নিয়ে এখনো বিস্তৃত অধ্যয়ন ও গবেষণা হয়নি।
এ কারণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে নিয়ে স্বাধীনতার অর্ধশতক ছুঁয়ে দেয়ার এই কালেও মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করতে দেখা যায়। এই অপপ্রচার রাজনীতিবিদ থেকে একাডেমিশিয়ান বা শিক্ষক, সাংবাদিক থেকে গবেষক সকল শ্রেণির মধ্যেই প্রচলিত দেখা যায়।
বঙ্গবন্ধুর আলোচনায় ‘বাকশাল’ আনলেই যেন নেতিবাচক একটি রূপ দাঁড়ায় আলোচনার, বিষয়টি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিষয়টি কি আসলেই তেমন? না, তেমন নয়। বাকশাল কি গণবিরোধী কোন তত্ত্ব? এদেশের বিচ্যুত বাম ঘরানার রাজনীতিক, গবেষক, সাংবাদিক, শিক্ষক বা বামপন্থী গণমাধ্যম বাকশালকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরেছে।
প্রজন্মের পর পর প্রজন্ম ধরে এদেশে এই মিথ্যাচার ডান ও বামপন্থীরা চালিয়েছে যে, ‘বাকশাল মানে সবার রাজনৈতিক অধিকার হরণ’। অথচ বাকশাল ছিল এদেশের আপামর জনসাধারণের জন্য জননায়কের দ্বারা প্রণীত জনবান্ধব শাসনব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু বাকশালকে বলেছিলেন ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’।
এই দ্বিতীয় বিপ্লবের নাম শুনে সে সময়ের পুঁজিবাদী সেনাবাহিনীর একাংশ, সুবিধাবাদী আমলা, ক্ষমতালোভী বাম, পাকিস্তানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল, ব্রিটিশ আজ্ঞাবাহী বিচার বিভাগ প্রভৃতি সন্ত্রস্ত্র ছির। কারণ এ বিপ্লব সংগঠিত হলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা চলে যায় গরীবের হাতে। সমাজে অভিজাত নামের মুনাফাখোরদের কোন অস্তিত্ত¡ থাকেনা।
‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ এক হয়ে যে বাকশাল হয়েছে, দেশের কৃষক-শ্রমিক ও আওয়াম তথা গরীব-দুঃখীকে নিয়েই যে এই দল গঠিত হয়েছে তা নিয়ে কেউ কখনো আলাপ তোলেনি। এমন কি আওয়ামীপন্থী নামে পরিচিত বুদ্ধিজীবী বা গবেষক বা শিক্ষককেও দেখিনি বাকশালের ইতিবাচক কিছু আছে এই আলাপ তুলতে। কিন্তু কেন? কারণ অজ্ঞতা। এদেশের শিক্ষিত সুবিধাবাদী মানুষের মগজ ধোলাই দিয়েছিল বামপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল গণমাধ্যম। সেই কারণেই তারা বাকশালকে বাম ও ধর্মান্ধ শ্রেণির চোখে দেখে থাকে। কিন্তু বাকশাল ছিল গণমানুষের, বাকশাল ছিল বাংলাদেশের। সেই আলোচনা করাই এই নিবন্ধের মূল বিষয়।
বাকশাল নিয়ে দুই ধরনের আলোচনা হতে পারে। একটি হচ্ছে এর তাত্তি¡ক দিক, আরেকটি হচ্ছে এর প্রায়োগিক দিক। যেহেতু বাকশাল গঠনের পর একটি দিনও বঙ্গবন্ধুকে এই নীতি বাস্তবায়নের সময় দেয়নি সা¤্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী বহিঃশত্রæ ও তাদের দেশিয় দালালেরা তাই আমরা এখানে বাকশালের তাত্তি¡ক বিষয় নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করবো। এই আলোচনার জন্য আমরা বাকশাল গঠনের কিছুকাল পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ঐতিহাসিক ভাষণকে প্রামাণ্য ধরবো যেখানে তিনি বাকশালের নকশা মৌখিকরূপে জনতার সামনে উপস্থাপন করেছেন। ভাষণটি এখানে পাবেন https://www.youtube.com/watch?v=y6owlOz6wwY|
যে সূর্যপ্রদীপ সহস্র বছরের এক জাতিসত্তাকে একটি রাষ্ট্র দিয়েছিলেন আজ তাঁর কথা বলবো। ৩০৫৩ দিন তিনি বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য জেল খেটেছেন, সহ্য করেছেন অমানষিক নির্যাতন, বঞ্চিত হয়েছেন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈকট্য থেকে। যে মহান নেতা কৃষক থেকে শিক্ষক; শ্রমিক থেকে ব্যবসায়ী, শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলকে একটি প্রাণে বেঁধেছিলেন আজ তার কথা বলবো। যে মানুষপ্রেমী উৎসর্গ করেছিলেন নিজের যৌবন, মেধা ও প্রজ্ঞা কেবল মানুষেরই কল্যাণে আজ তার কথা শোনাবো। তিনি শ্লোগান, তিনি কবিতা, তিনি সুরের ঝংকার, তিনি গল্প, তিনি উপন্যাস, তিনি স্বপ্ন ও বাস্তবতা, তিনি কোটি প্রাণের একপ্রাণ। তিনি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিনি ধাঁনসিঁড়ি আর মধুমতি।
তিনি নতুন ধানের গন্ধ, তিনি সোনালী আঁশের দ্রষ্টা, তিনি সুশাসনের প্রবক্তা। তিনি গরীবের বন্ধু, তিনি শোষকের যম, তিনি জাতির ত্রাতা। তিনি বজ্রকন্ঠাধিকারী, এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার তিনি, তিনি সবুজের বুকে একমাত্র রক্তিম সূর্য, তিনি পথহারা জাতির শ্রেষ্ঠ প্রদর্শক। তিনি বাংলাদেশ। তিনি বাঙালি। তিনি তীব্র জাতীয়তাবাদী, আবার তিনিই মানবতার অদ্বিতীয় কাণ্ডারি।
তিনি মানুষ, মানুষের ভালবাসার প্রাবল্যে তিনি আবার অতিমানবও। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ মাটির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাঙালি জাতির পিতা। আজ শুধু তাঁর ও তাঁর নীতির কথা বলবো। আজ কালি, কলম ও পৃথিবীর সব শব্দ সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁর কথা স্মরণ করবে। আজ বাঙালির হৃদয়ের হাহাকারের প্রস্ফুটন হবে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির সঙ্গে।
এক নজরে স্বাধীনতার মহানায়ক
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ যে মহামানব গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অসাধারণ মানবদরদী।
তার পিতার নাম শেখ লুৎপর রহমান এবং মাতার নাম সাহেরা খাতুন। তার স্ত্রীর নাম বেগম ফজিলাতুন্নেসা, যিনি আমাদের বঙ্গমাতা নামে অধিক পরিচিত। তাঁর আদরের কন্যার নাম শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তিন পুত্রের মধ্যে শেখ কামাল ও শেখ জামালের চেয়ে অধিক স্নেহ করতেন শেখ রাসেলকে। কিন্তু তিনি এত বেশি জেল খেটেছেন বাঙালির মুক্তির জন্য যে শেখ রাসেল তাঁকে ‘হাসু বুবুর বাবা’ বলতেন বলে অসামাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাইয়ের নাম শেখ নাসের। বঙ্গবন্ধু সাঁতার কেটেছেন মধুমতুর শাখা নদী বাঘিয়ায়। তিনি যখন স্থানীয় গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন তখন ঘরের গোলা থেকে ধান নিয়ে গরীব পরিবারকে দিয়ে আসতেন। ছোটবেলার সেই খোকা চিরকাল শুধু দিয়েই গিয়েছেন বাঙালি ও বাংলাদেশকে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ৫৪ এর নির্বাচন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের মুক্তি সনদ ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর ঐতিহাসিক নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর অসামান্য এবং অদ্বিতীয় অবদানের জ্বলজ্বলে ফসল।
বাংলাদেশের স্থপতি এবং বাঙালি জাতির পিতা হতে বাঙালি ও বাংলাদেশের জন্য যা যা করার দরকার তার চেয়ে অধিক কিছু করেছেন বঙ্গবন্ধু।
রাজনৈতিক জীবনে পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র নেতা বঙ্গবন্ধু যিনি কৃষক-শ্রমিক কর্মীদের নাম ধরে ডাকতেন, অজপাঁড়া গ্রাম থেকে লুঙ্গি পরে বা খালি গায়ে আসা সাধারণ মানুষকে পরম ভালবাসায় বুকে টেনে নিতেন।
এমন অনেক কথা শুনেছি যে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মীদের দীর্ঘদিন পর গিয়েও নাম ধরে ডাকতেন তিনি। কিভাবে মনে রাখতেন বাংলার লাখ লাখ মানুষের নাম সেটি ভেবে সবাই অবাক হতো। বলতো, মুজিব আল্লাহর অশেষ কৃপা নিয়ে ধরায় এসেছে। জনতাকে উদ্বেলিত করার এই ক্ষমতা পৃথিবীর হাতে গোনা কিছু সংখ্যক মানুষের রয়েছে।
বাংলার মুজিব তাঁর একজন। এখানেই মুজিব অনন্যসাধারণ। যা পারেননি এদেশের আর কোন নেতা তা করেছেন মুজিব। বজ্রকণ্ঠে সাত কোটি বাঙালির রক্ত কাঁপিয়ে দেয়ার সাধ্য তাই মুজিব ছাড়া আর কারো ছিল না, নেই এবং কোনকালে হবেও না।
লেখক: মঈনুল ইসলাম
গবেষক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর. সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর ব্শি^বিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা