কেবল শোকদিবস নয়


মুর্শিদ আনোয়ার
১৫ই আগস্ট দিবসটিকে কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ দিবস বলেন, তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। যে মানুষটি সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্যে জীবন দিলেন, জগৎ-সভায় তাদেরকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মর্যাদা দিলেন, সেই মানুষটির এ রকম মর্মান্তিক সমাপ্তিকে যারা কেবল একটি ব্যাক্তির মৃত্যু ভাবতে চান, তারা কেবল নিজের বিবেকের সঙ্গে প্রতারণা করেন।

কেননা বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কলঙ্কময় অধ্যায় আর একটিও নেই। বাঙালি হিসেবে আত্মপরিচয় দিতে যিনি গর্বিত, তিনি কখনো এরকম ভাবতে পারেন না। বঙ্গবন্ধু বাঙালির কাছে জাতির পিতা এই একটিমাত্র কারণে যে, তিনিই বাংলাদেশ নামক এই সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের আপোষহীন স্থপতি। আর যিনি জাতির পিতা, জাতির জীবনে তাঁর কোনো মৃত্যু নেই। আসলে বঙ্গবন্ধু মুজিবের শারীরিক অবসান হয়েছে, তার কিন্তু জীবনশিখা জাতির জীবনে অনির্বাণ জীয়নকাঠি হয়ে সদাজাগ্রত। যতদিন বাংলা ও বাঙালি থাকবে, ততদিন থাকবেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু।

কেন এমন হলো? – এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-সামরিক ইতিহাসে। অভ্যুদয়ের অব্যবহিত পরেই নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও সামরিক অবকাঠামো বিন্যাস করা হলো। সেইসঙ্গে নিয়োগ দেয়া হলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রধান পদে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ কাউকে ডিঙিয়ে অন্য কাউকে দেওয়া হলো সর্বোচ্চ আসন। আবার নতুন পদ তৈরি করে বিন্যাস করা হলো উপ-প্রধান জাতীয় পদও।

অথচ যে মানুষটি একাজগুলো সুচিন্তিতভাবে করলেন, তিনি তার সুফল পেলেন না। নিয়তির নির্মম পরিহাসের শিকার হলেন তিনি। তারপরের ইতিহাসও কারো অজানা নয়। সরকার প্রধানের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারলো না সেনাবাহিনী, বিডিআর, রক্ষিবাহিনী বা কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। অথচ প্রিয়লোকগুলোই ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান। বিচ্ছিন্ন কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না বিশাল বিশাল পদধারী প্রধান ব্যক্তিরা। অর্থাৎ তারা তাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন। অথচ সরকারি দায়িত্বে অবহেলার দায়ে যথোপযুক্ত শাস্তি হলো না কারো। আর এই অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকারি চাকুরির নিয়ম গত চল্লিশ বছর ধরে তাদের জন্য যেন স্থগিত রয়েছে। আমরা দেখছি, এই মানুষগুলোর অনেকেই পরবর্তী সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কেউকেটা বা উপদেষ্টা ইত্যাদি হয়ে আদায় করেছেন নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা।

আসলে পনেরই আগস্ট কেবল শোকদিবস নয়, শপথ নেবার দিন। এ দিনটিকে শোকের আবহে নিষ্ক্রিয় করা উচিত নয়। এই দিনটিতে নতুন করে শপথ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে কর্মী তৈরির আনুষ্ঠানিক প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। যে রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেলেন সেই রাষ্ট্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থেই গণতন্ত্রপ্রিয় সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আর গণমানুষের আর্থসামাজিক ও নৈতিক উন্নয়ন, এবং সর্বোপরি মানুষের কল্যাণ করার ব্রত দিয়ে সামনের দিনগুলোতে কাজ করার শপথ নিতে হবে।

প্রগতিশীল সুশীল সমাজের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বিশ্বাস করেন, তারা কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে নাগরিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা ভোগেই লিপ্ত থাকবেন না; বরং তাদেরও উচিত দলবদ্ধ হয়ে মাঠে নামা, সাধারণ মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে তাদেরকে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোকিত করা। এদেশ একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হবে, নাকি সকলে মিলে সুখে শান্তিতে বসবাস করবো – এ প্রশ্নের স্থায়ী সমাধান করা। আজ যারা ভাবেন সময়ই সব সমাধান করে দেবে (!), তারা নিতান্তই অচেতন, অদূরদর্শী।

বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসহীন ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে আমাদেরকে এই বিলাসী রাজনীতি ও বিবেকহীনতা থেকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন সমাজ-দেশ যদি স্বাভাবিক না থাকে তাহলে বিত্তবৈভবে কোন শান্তি আসে না, শারীরিকভাবে সুস্থ জীবনেও মৃত্যুঝুঁকি ক্রমশ বাড়তেই থাকবে। চাই ত্যাগের রাজনীতি, যে ত্যাগের এক পরম দৃষ্টান্ত আত্মদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, আমরা তোমার দেহ ছেড়ে যাওয়া আত্মার অমরতা কামনা করি। এখনো তোমাকে স্মরণ করে কোটি কোটি বাঙালি, স্মরণ করবে অনন্তকাল। তোমার যৌবনে আমরা কিশোর ছিলাম, যৌবন পার হয়ে এখন আমরা বয়সের পরিণত পর্বে এসে পড়েছি। আমরা দেখেছি তোমার চিরউন্নতশির, আমরা তোমাকে ভালোবেসেছি। এখনো আমরা তোমার বিরহে চোখের জল ফেলি। ভালো থেকো বঙ্গবন্ধু, হে বন্ধু আমার, হে বন্ধু সবার। প্রতি মুহূর্তে এই বাংলার ধূলিকণায় পুনর্জন্ম হোক তোমার সংগ্রামী চেতনার।

SUMMARY

1279-1.gif