ষড়যন্ত্র, নিষ্ক্রিয়তা ও ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড


নাদির জুনাইদ

একটি ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছিল। এই ষড়যন্ত্র কতদূর বিস্তৃত ছিল সে সম্পর্কে অনেক তথ্য এখনও অজানা। আরও গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে হয়তো আগামীতে এই বিষয়ে নতুন তথ্য জানা সম্ভব হবে।

বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন কথা ১৯৭৫এর আগেই শোনা যেতে থাকলেও, সেই ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত তথ্য কখনও গোপন রাখা হয়েছিল, কখনও সেই সব তথ্যে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যারা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ১৯৭৫এর আগস্টের আগেই তাদের কারও কারও পরিচয় প্রকাশিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়তা ছিল। বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনাকারী চাকুরীরত এবং প্রাক্তন সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে দ্রুত সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা গিয়েছিল একই পরিস্থিতি।

১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে যে লেখালেখি এবং আলোচনা হয়েছে তার আলোকে সেই ষড়যন্ত্র এবং নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে এই লেখায় কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হল।

এই ষড়যন্ত্র কতদূর বিস্তৃত ছিল সে সম্পর্কে অনেক তথ্য এখনও অজানা
 

ঢাকায় ১৯৭৪ সালের শেষভাগ থেকেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের এবং সম্ভাব্য একটি সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব শোনা যাচ্ছিল।

[মাহমুদ আলী, পৃ: ১১০]

মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজ ১৯৭৯ সালে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘গার্ডিয়ান’ এ তাঁর একটি লেখায় উল্লেখ করেন, ১৯৭৪ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ঢাকায় কজন বাংলাদেশি বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাতের ব্যাপারে তাদের তৎপরতা প্রসঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেন। লিফশুলৎজ এই বাংলাদেশিদের পরিচয় প্রকাশ করেননি। তবে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে খন্দকার মোশতাকের জড়িত থাকা প্রসঙ্গে তিনি এই বৈঠকসমূহের উল্লেখ করেন।

নিজের লেখায় লিফশুলৎজ ইঙ্গিত দেন যে, এই বাংলাদেশিরা সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণের প্রধান দুই পরিকল্পনাকারী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন দুই অফিসার মেজর ফারুক এবং মেজর রশিদ পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাসের সঙ্গে সাক্ষাতকারে কোনো বিদেশি মিশনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের কথা অস্বীকার করেছিলেন।

[ম্যাসকারেনহাস, পৃ: ৬৫]

মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগকারী বেসামরিক ব্যক্তিরা বেশ কবার অনানুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ধারণা করা হয় এই বাংলাদেশিরা বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাত করার ব্যাপারে মার্কিন মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৭৫এর জানুয়ারিতে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা এদের সঙ্গে আর আলোচনা না করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে লিফশুলৎজ উল্লেখ করেছেন, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ইউজিন বোস্টারের নিষেধ সত্বেও তখন ঢাকায় ‘সিআইএ’এর স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখতেন।

[আলী, পৃ: ৩৭২]

মার্কিন দূতাবাস এই বাংলাদেশিদের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করেছিল কি না তা জানা যায় না। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এই গোপন বৈঠক সম্পর্কে কতটুকু তথ্য পেয়েছিল তাও অজানা।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৭৫ সালে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেই সময়ের একমাত্র আর্মার্ড রেজিমেন্ট বেঙ্গল ল্যান্সারস্এর সহ-অধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের কদিন পূর্বে ফারুক মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ থেকে কলকাতায় আসেন। যশোর মুক্ত হওয়ার পর ফারুক যশোরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন।

[নীলুফার হুদা, পৃ: ১০৬]

 
মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের কদিন পূর্বে ফারুক মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ থেকে কলকাতায় আসেন
 

যুদ্ধের পর তাকে নবগঠিত একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ১২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ট্যাংক কোরের অফিসার ফারুক কিছুদিন পর ঢাকায় অবস্থিত সেনাবাহিনীর একমাত্র ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারস্-এ বদলী হয়ে আসেন। জানা যায়, অচিরেই তিনি সেনাবাহিনীতে রুশ-ভারত বলয়ের সমালোচনাকারী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তার আওয়ামী সরকারবিরোধী মনোভাবটিও স্পষ্ট হতে থাকে।

[নাসির উদ্দিন, পৃ: ৫০]

১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় সরকার উৎখাতের ব্যাপারে ফারুক নিজের এবং সেনাবাহিনীর অন্যান্য কিছু জুনিয়র অফিসারের চিন্তার কথা সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রকাশ করেন। লক্ষ্যণীয়, ফারুক সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা না করে জেনারেল জিয়াকে আস্থায় নিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা জানান। সরকার পরিবর্তনের এই পরিকল্পনায় ফারুক জিয়ার সমর্থন এবং নেতৃত্ব চান।

অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাসের কাছে পরবর্তীতে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে (https://www.youtube.com/watch?v=UBpkJFtETQ0) ফারুক জানান, জেনারেল জিয়া সরাসরি এই পরিকল্পনায় যুক্ত হতে অস্বীকার করেন; কিন্তু তিনি ফারুককে বলেন, জুনিয়র অফিসাররা এমন কিছু করতে চাইলে তারা অগ্রসর হতে পারে। ১৯৭৬ সালে লন্ডনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান করার সময় ম্যাসকারেনহাস জেনারেল জিয়াকে ফারুকের এই বক্তব্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে জিয়া এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। ফারুকের সঙ্গে তার এমন কথোপকথনের বিষয়টি জিয়া অস্বীকার করেননি, আবার স্বীকারও করেননি।

[ম্যাসকারেনহাস, পৃ: ৫৪]

লক্ষ্যণীয় যে, ১৯৭৫এর মার্চে তার অধীনস্ত সেনা কর্মকর্তা ফারুকের কাছ থেকে এমন একটি পরিকল্পনার কথা শোনার পরও সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জেনারেল জিয়া ফারুককে নিবৃত্ত বা গ্রেফতার করার চেষ্টা করেননি।

[মাহমুদ আলী, পৃ-১১১]

১৯৭৫ সালে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস)। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন মাস পর তার নেতৃত্বেই ফারুক-রশিদ চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর ট্যাংক কোরের অপর একজন অফিসার মেজর নাসির উদ্দিনের একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকেই খালেদ মোশাররফ ফারুকের সরকারবিরোধী অভিযান পরিচালনার ইচ্ছার ব্যাপারে অবহিত হয়েছিলেন।

১৯৭৬ সালে লন্ডনে ম্যাসকারেনহাস জিয়াকে ফারুকের বক্তব্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দেননি
 

মেজর নাসির উদ্দিন একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ৩ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ট্যাংক কোরের অফিসার হিসেবে তিনিও বেঙ্গল ল্যান্সারস্এ কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া তিনটি পুরনো এবং হালকা ধরনের মার্কিন এম-২৪ শেফি ট্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সারস্ যাত্রা শুরু করে। ১৯৭৪ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি ৩০টি টি-৫৪ মিডিয়াম ট্যাংক উপহার দেন। ট্যাংকগুলির সঙ্গে শ’চারেক গোলাও বাংলাদেশে পাঠানো হয়।

১৯৭৫এর মার্চের মাঝামাঝি কোনো এক রাতে গোলাসহ ৬টি ট্যাংক বিশেষ ট্রেনযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে জীবন্ত গোলাবর্ষণ মহড়ার জন্য পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। মেজর ফারুকের ওপর দায়িত্ব ছিল কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্যাংকগুলো বিশেষ ট্রেনে তুলে দেওয়ার কাজটি তদারক করা। ফারুক গভীর রাতে মেজর নাসিরের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তাকে জানান যে, তিনি ট্যাংক ট্রেনে না তুলে সেই রাতেই একটি অভ্যুত্থান ঘটাতে চান। নাসিরকে তার প্রয়োজন; কারণ বেঙ্গল ল্যান্সারস্এ চারশর মতো মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক আছে যারা নাসিরের নির্দেশ মেনে নেবে।

নাসির ফারুকের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে ফারুকের উপস্থিতিতেই টেলিফোন করেন। খালেদ মোশাররফ ফারুকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাকে নিবৃত্ত করেন এবং নাসিরকে নির্দেশ দেন ফারুকের সঙ্গে কমলাপুর রেলস্টেশনে যেয়ে ট্যাংক ট্রেনে তোলা তদারক করার জন্য। খালেদ এও জানান যে, ফারুক অন্য রকম কিছু করলে তিনি ফারুককে গ্রেফতারের জন্য মিলিটারি পুলিশ পাঠাবেন।

[নাসির উদ্দিন, পৃ: ৫৮-৫৯]

সেই রাতে ফারুকের এমন আচরণ দেখার পরও ফারুকের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ বা মেজর নাসির কেউ সরকার, সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ বা দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে ফারুকের পরিকল্পনার কথা আদৌ জানিয়েছিলেন কী না তা জানা যায় না। এছাড়া ঢাকা সেনানিবাসে আগে থেকেই এ কথা জানা ছিল যে, ফারুক ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে সেনাবাহিনীর তখনকার তিনটি ট্যাংক নিয়ে একবার অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন। তার সমর্থনে কুমিল্লা থেকে একটি সৈন্যদলও ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই দল ঢাকায় পৌঁছায়নি বলে ফারুকের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

[জামিল, পৃ: ১১৭]

 
১৯৭৫এর শুরুর দিকেই খালেদ মোশাররফ ফারুকের সরকারবিরোধী অভিযান পরিচালনার ইচ্ছার ব্যাপারে অবহিত হয়ে ছিলেন
 

ট্যাংক ব্যবহার করে একটি অভ্যুত্থান করার ব্যাপারে ফারুকের এমন আগ্রহ এবং তৎপরতা সম্পর্কে সেনাবাহিনীর উর্দ্ধতন অফিসাররা অবহিত থাকার পরও ফারুকের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং ফারুক সেনাবাহিনীর ট্যাংক ইউনিটেই সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করতে থাকেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫এর ১৫ আগস্ট এই রেজিমেন্টের ট্যাংকগুলির সাহায্যেই তার ভয়াল এবং নির্মম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন যার ফলে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেকে।

বঙ্গবন্ধুর ওপর হামলা হতে পারে এমন আভাস ১৯৭৫ সালের বিভিন্ন সময় পাওয়া যেতে থাকে। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসের এক রাতে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরী রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে এসে জানান যে, সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুর ওপর হামলা হতে পারে এমন সংবাদ তিনি পেয়েছেন। সেই রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি এবং শেখ মণির বাড়ির ওপর সতর্ক নজর রাখা হয়। এর মাস দেড়েক পর একদিন রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান প্রাপ্ত গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করেন যে, রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা হতে পারে। আবারও রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা রাতে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।

[আলম, ১২৮-২৯]

সেই সময় রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের প্রেস উইংয়ে কর্মরত ছিলেন মাহবুব তালুকদার। ১৯৭৫এর আগস্টের অল্পদিন আগে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত তার একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয় উদ্বেগের সঙ্গে তাকে জানান যে, বঙ্গবন্ধুকে সরানোর গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং কদিনের মধ্যেই খারাপ কিছু ঘটবে। তিনি মাহবুব তালুকদারকে অনুরোধ করেন বঙ্গবন্ধুকে দ্রুত এই কথা জানানোর জন্য। সেই কর্মকর্তা অবশ্য তখন তার দাবির সপক্ষে প্রমাণ দেখাতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে না জানালেও, মাহবুব তালুকদার শেখ মণিকে কথাটি জানান। কিন্তু মণি গোয়েন্দা কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য ‘আজগুবি খবর’ বলে উড়িয়ে দেন।

[তালুকদার, পৃ: ১৪২-৪৪]

বোঝা যায়, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন খবর কোনোভাবে আঁচ করা গেলেও কারা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের কাছে ছিল না। ষড়যন্ত্রকারীরা দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের পরিচয় ও তৎপরতা গোপন রাখতে পেরেছিল।

সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এমন ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সরকারকে আগাম তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭৫ সালে ডিজিএফআইএর মহাপরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফ। তিনি ছিলেন একজন পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসার। ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করা হয় সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট, বেঙ্গল ল্যান্সারস্ আর মেজর খন্দকার আবদুর রশিদের নেতৃত্বাধীন টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট। দুটি ইউনিটই ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের অধীনে ছিল। এই ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। আগস্ট হত্যাকাণ্ডের মাস দুয়েক আগে অজ্ঞাত কারণে ৪৬ ব্রিগেডের একমাত্র গোয়েন্দা ইউনিট প্রত্যাহার করে সেনা হেডকোয়ার্টারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।

[জামিল, পৃ: ১১৯]

ফলে ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডারের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট থেকে তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ ছিল না। হত্যাকাণ্ড পরিচালনায় ফারুক-রশিদের অন্যতম সহযোগী তৎকালীন মেজর বজলুল হুদা নিজেই সেনাসদরে সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন।

সেদিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের প্রহরায় নিয়োজিত ছিল কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আগত ১ম আর্টিলারি রেজিমেন্টের সৈনিকরা। সেনাসদরের নির্দেশে কুমিল্লা থেকে এই রেজিমেন্টের সৈন্যদের বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রহরার জন্য আনা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণ পরিকল্পনায় জড়িত মেজর বজলুল হুদা আর মেজর ডালিম দুজনই ছিলেন ১ম আর্টিলারি রেজিমেন্টের পুরনো অফিসার। ফলে, এই রেজিমেন্টের অনেক সৈন্যই ডালিম আর হুদার অনুগত ছিল। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলায় হুদা অংশ নেয়।

ধারণা করা হয়, আক্রমণকারীদের মধ্যে হুদার উপস্থিতি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রহরারত আর্টিলারির সৈনিকদের আক্রমণকারীদের প্রতিরোধ করার ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় করে তোলে।

[হোসেন, পৃ: ২৫]

ধানমন্ডিতে আক্রমণে ব্যবহার করা হয় বেঙ্গল ল্যান্সারস্এর কিছু বাছাই করা সৈনিককে যারা ছিল বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত এবং ফারুকের প্রতি বিশ্বস্ত। ফারুক ট্যাংক নিয়ে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয় ঘিরে ফেলে। যদিও এই ট্যাংকগুলিতে গোলা ছিল না। কিন্তু ট্যাংক দেখেই রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা প্রতিরোধে অগ্রসর হয়নি।

ট্যাংকগুলোতে গোলা না থাকলেও রশিদের টু ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিট থেকে প্রচুর গোলাবারুদসহ ৬টি ১০৫ মি.মি. হাউইটযার আক্রমণে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে যখন গোলাগুলি চলছিল, তখন একটি হাউইটযার দিয়ে বেশ কয়েক রাউন্ড গোলাবর্ষণও করা হয়, যার কিছু গোলা মোহাম্মদপুর অঞ্চলে যেয়েও ক্ষতিসাধন করে।

মেজর রশিদ এই হামলার আগে ভারত থেকে গানারী স্টাফ কোর্স শেষ করে দেশে ফেরেন। এই কোর্স শেষ করার কারণে স্বাভাবিকভাবে আর্টিলারি ইন্সট্রাকটর হিসেবে তার পোস্টিং হয় যশোরে কম্বাইন্ড আর্মস স্কুলে। কিন্তু হঠাৎ তার পোস্টিং পাল্টে তাকে ঢাকায় বদলি করে নিয়ে আসা হয়। এর পেছনে কার ভূমিকা ছিল তাও নিশ্চিতভাবে জানা যায় না।

[হোসেন, ১১-১২]

মেজর রশিদকে যশোর থেকে ঢাকায় বদলি করে নিয়ে আসার পেছনে কার ভূমিকা ছিল তা জানা যায় না
 

৪৬ ব্রিগেডের অধীনস্ত সেনাবাহিনীর পদাতিক ইউনিটগুলিকে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবার পর সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়। কিন্তু সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক শাফায়াত জামিলকে অভ্যুত্থানকারী ল্যান্সারস্ ও টু ফিল্ড আর্টিলারির সৈনিকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার আদেশ দেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের প্রতিরোধ না করায় তৎকালীন রংপুর ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা (যাকে পরবর্তীতে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে ৭ নভেম্বর হত্যা করা হয়) সেনাপ্রধান এবং সেনা সদরের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। নাজমুল হুদা তখন বলেছিলেন, রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান দেশে থাকলে হয়তো তিনি এই হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধের চেষ্টা করতেন।

[নীলুফার হুদা, পৃ: ১১০]

উল্লেখ্য, ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান এবং কর্নেল নাজমুল হুদা দুজনই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ছিলেন। ১২ আগস্ট বিদেশ গিয়েছিলেন নুরুজ্জামান। তার অনুপস্থিতিতে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা তাদের করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। সে সময় ঢাকায় রক্ষীবাহিনীর অস্ত্র-গোলাবারুদ থাকত পিলখানায় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের কার্যালয়ে। রক্ষীবাহিনীর তৎকালীন উপপরিচালক আনোয়ার উল আলমের বক্তব্য থেকে জানা যায়, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর রক্ষীবাহিনী পিলখানা থেকে তাদের অস্ত্র আনতে গেলে, তাদেরকে সেই অস্ত্র-গোলাবারুদ দেওয়া হয়নি।

[আলম, পৃ: ১৪৬]

রক্ষীবাহিনীকে তাদের অস্ত্র নিতে দেওয়া না হলেও হত্যাকাণ্ডের পর অভ্যুত্থানকারীদের গোলাবিহীন ট্যাংকগুলোর জন্য রাজেন্দ্রপুর অর্ডন্যান্স ডিপো থেকে গোলা প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জানা যায়, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ সিজিএস খালেদ মোশাররফকে ট্যাংকগুলোর জন্য অ্যামুনিশন ইস্যু করার ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।

[জামিল, পৃ: ১০৭]

সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান করার ব্যাপারে মেজর ফারুকের ইচ্ছা এবং পরিকল্পনার কথা জানার পরও তার বিরুদ্ধে তৎকালীন উর্দ্ধতন সেনা কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা না নেওয়া, এই আসন্ন আক্রমণ সম্পর্কে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে না পারা, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা হওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গ্রহণে ব্যর্থতা, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা প্রদানের ব্যাপারে বিশ্বস্ত সৈন্যদল নিয়োগ না করা প্রভৃতি কারণেই ১৯৭৫এর আগস্ট হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল।

সেনাবাহিনীর যে দুটি ইউনিট অভ্যুত্থানে অংশ নেয়, তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনী থেকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজরদের ট্যাংক ও কামানের বিরুদ্ধে পদাতিক বাহিনী ও বোমারু বিমান দিয়ে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়। সে প্রস্তুতি দেখে ফারুক-রশিদ-ডালিম-নূর চক্র সংঘাতের সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। ফারুকের ল্যান্সারস্ বাহিনীর সদস্যরা সেদিন পদাতিক বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে বঙ্গভবনে তাদের অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে।

[তালুকদার, পৃ: ১৬৪]

দুদিনের মধ্যেই ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সেনা অফিসাররা দেশত্যাগে বাধ্য হয়। প্রতিরোধের মুখে তাদের টিকে থাকার ক্ষমতা কত কম ছিল, ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থানের পরই তা বোঝা যায়। তাই ট্যাংক বা কামান দখলে রাখার কারণে ফারুক-রশিদ বাহিনীর অল্প কিছু সৈন্যের বিরুদ্ধে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণের পর সেনানিবাস এবং রক্ষীবাহিনীর দপ্তর থেকে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে না তোলার যুক্তি গ্রহণযোগ্য হয় না। কেন বঙ্গবন্ধুর ফোন পাওয়ার পরও সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ তার অধীনস্ত সেনা ইউনিটসমূহকে দ্রুত আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশ দিতে পারলেন না, সেই ব্যাপারটি প্রশ্ন তৈরি করে।

 
কেন বঙ্গবন্ধুর ফোন পাওয়ার পরও সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ সেনা ইউনিটসমূহকে অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশ দিতে পারলেন না, সেটি প্রশ্ন তৈরি করে
 

সেনাবাহিনীতে শফিউল্লাহর প্রভাবও কম ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বাধীন ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন ঢাকাতেই ছিল। অভ্যুত্থানকারীদের দমন করার জন্য যুদ্ধ-বিমান ব্যবহার করার বিষয়টিও বিবেচনা করা হয়নি। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিল নতুন সেনাপ্রধান জিয়াকে বন্দি করে ফারুক-রশিদ চক্রের বিরুদ্ধে যেভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন, একই রকম শক্ত অবস্থান ১৫ আগস্ট তারা গ্রহণ করেননি। কেন এই দুজন উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ এবং তাদের প্রতি অনুগত অন্যান্য অফিসার ও সেনা ইউনিটগুলো নিয়ে ধানমন্ডিতে হত্যাকাণ্ড ঘটার পরই ফারুক-রশিদ চক্রকে প্রতিরোধ করলেন না, এটিও প্রশ্ন তৈরি করে।

এ কথাই স্পষ্ট হয় যে, একটি গভীর ষড়যন্ত্রের জন্য এবং দায়িত্ব পালনে অনেকের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডসমূহ সংঘটিত হয়েছিল।

সহায়ক গ্রন্থসমূহ:

১. S. Mahmud Ali. “Understanding Bangladesh”

[New York: Columbia University Press, 2010]

২. Anthony Mascarenhas. “Bangladesh: A Legacy of Blood”

[London: Hodder and Stoughton, 1986]

৩. মেজর নাসির উদ্দিন, “গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী”

[ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৭]

৪. কর্নেল শাফায়াত জামিল, “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর”

[ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮]

৫. মাহবুব তালুকদার, “বঙ্গভবনে পাঁচ বছর”

[ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০৫]

৬. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন, “বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১”

[ঢাকা: পালক পাবলিশার্স, ২০০৭]

৭. আনোয়ার উল আলম, “রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা”

[ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩]

৮. নীলুফার হুদা, “কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ”

[ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১১]

SUMMARY

1276-1.png