অজয় দাশগুপ্ত
বঙ্গবন্ধু যেখানে থাকার কথা, সেখানেই আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে পঁচাত্তরের পরের যত অপপ্রচার বিভ্রান্তি আর নিন্দা, সব যেন ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। এর কারণ এটা নয় যে, আওয়ামী লীগ আজ সিংহাসনে বলে এসব সম্ভব হয়েছে। তাদের প্রচার-সর্বস্বতা আসলে কতটা কার্যকর সে কথায় পরে আসছি।
নিয়তি অথবা প্রকৃতি যেটাই বলি না কেন, তার বিচারে বঙ্গবন্ধু যেখানে থাকার ঠিক সেখানেই আছেন। সময়ের বিচারে অবিশ্বাসী রাজনীতির দুর্দশাও এখন দেখার মতো। বিএনপি নামের যে রাজনৈতিক দল, তার ভেতরটা আর বাইরের দিক বিবেচনায় না আনলে এ রহস্য উন্মোচিত হবার নয়। বিএনপি আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বটে, তবে জাতীয়তাবাদী নামে পরিচিত এই দল আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী তো নয়ই, আমি বলব, এটি আসলে একক রাজনৈতিক দলও নয়।
চমকে ওঠার কারণ নেই, নেই ভুল বোঝার অবকাশ। অতীতে ফিরে গেলে দেখতে পাব, বিএনপি গঠনের পেছনে কাজ করেছিল বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের ককটেল। নিহত বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার পর দিশেহারা রাজনীতি ও পথভ্রষ্ট জাতির সামনে তখন ঘোর অন্ধকার। মোশতাক ও খুনি গং পারেনি তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে। তাদের প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে বাংলাদেশকে খতম করে দেওয়া। জাতির কাণ্ডারি ও নেতাদের মারলেই বাংলাদেশ ও জনগণ সুড়সুড় করে পাকিস্তানের আদলে নির্মিত কোনো খোলে ঢুকে পড়বে, এই অপ-ধারণা যখন কাজে লাগেনি তখন একদল রাজনৈতিক মুখোশধারী নেতা ও পাকিবন্ধু নেমে পড়ল দেশের চেহারা আদল আর কাঠামো পরিবর্তনের কঠিন কাজে। এদের না চেনার কারণ নেই। এরা কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত প্রান্তের মানুষ।
এরা এমন এক অদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছিল যেখানে বিভেদরেখা প্রায় মুছে যাবার পথে। রাজাকারবান্ধব সমাজ ও দেশে একের পর এক ঘাতক মন্ত্রী, মিনিস্টার, এনজিও, মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু প্রায় নিষিদ্ধ হবার যোগাড়। বিএনপিকে অপছন্দ করার এটাই মূল কারণ। মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিকের গড়া দল হবার পরও তারা জাতীয় মর্যাদা নিয়ে খেলা করেছে। ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে পাকি জামায়াতের হাতের পুতুলে।
তাদের ইচ্ছেমতো খেলতে গিয়ে কখন যে অস্তিত্ব আর পরিচয় হারিয়ে গেছে, নিজেরাই বুঝতে পারেনি। খালেদা জিয়া গোড়ার দিকে খানিকটা আপোসহীন থাকলেও এক সময় তিনিই হয়ে উঠলেন জামায়াতের আশ্রয়। এমন আশ্রয় যে, তার হাতেই সবচেয়ে অধিক নির্যাতিত হল ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর ইমেজ। হঠাৎ কোথা থেকে তার জন্মদিন পালন শুরু হল পনের আগস্ট। বলা নেই কওয়া নেই, তিনি এই দিনটি নিয়ে মেতে উঠলেন।
শেখ মুজিবর রহমানের জীবনের সবচেয়ে বড় ত্যাগ তাঁর করুণ মৃত্যু। এর ভেতর দিয়ে তিনি তাঁর সকল দায় চুকিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন অবিনশ্বরে। খালেদা জিয়ার মতো সাধারণ মাপের নেতার সেটা বোঝার কথা নয়। যারা তার উপদেষ্টা বা যারা তাকে এই জ্ঞান দিতে পারতেন তারাই দায়ী এর জন্য। তারা সুবুদ্ধি দেওয়ার পরিবর্তে তাকে নিয়মিত উস্কে দিতেন। তাকে এমন একটা ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে, তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মেধার রাজনীতির বিপরীতে সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশ নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও উন্নতির জন্য রাজনীতির বারোটা বাজানোর পাশাপাশি দেশের ও দলের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন।
কথায় বলে মিথ্যার পতন তার ঘর থেকেই শুরু হয়। মিথ্যা আবেগ আর কথিত সরলতা পুঁজি করে বিএনপির রাজনীতি এগুতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে জুটেছিল ভারত-বিরোধিতা আর সাম্প্রদায়িকতা। বাঙালি মুসলমানের চরিত্রের একটা দিক ধরতে পারলেও বাকি দিকটা বুঝতে পারেননি বহুদলের জগাখিচুড়িতে তৈরি বিএনপির নব্য নেতারা। ধরাকে সরা জ্ঞান করা তারেকের আগমন, বেগম জিয়ার কেক কাটা সব মিলিয়ে তাদের বিকৃতি যখন চরমে, মানুষ রুখে দাঁড়াতে শুরু করল। এই দাঁড়ানো যতটা না আওয়ামী লীগের জন্য, তার চেয়ে অধিক দেশ ও দেশের জনগণের স্বার্থে।
প্রকৃতির বিচার চিরকাল এমন। কখন যে সে রুখে দাঁড়াবে কেউ বলতে পারে না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘গড নেভার স্লিপ’। ঈশ্বর নির্ঘুম বলেই যাবতীয় অনাচার আর অবিচার হিসাব করে রেখেছিলেন। সে বদমুসিবত আজরাইল হয়ে দেখা দিল ওয়ান ইলেভেনে। বলাবাহুল্য, সে ফাঁকে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িবে ফিরতে লাগল নিজের অস্তিত্বে। যখন উত্তেজনার বুদবদ আর মিথ্যার চক্রান্ত ব্যর্থ, বিএনপিও পড়ল চরম বিপদে।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য উঠে আসার এই দিনগুলিকে আওয়ামী লীগ ভাবছে নিজেদের অর্জন। আবারও পঁচাত্তরের মতো ভুলের পথে চলছে তারা। অন্তত প্রচারের নামে যে জৌলুস ও বাড়াবাড়ি সেটা সময়ের গায়ে আঘাত করছে। প্রকৃতি নিজেই যেখানে তার দায় মিটিয়েছে, প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে, সেখানে অবিরল প্রচার আর নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর ইমেজ ব্যবহারের চেষ্টা ভালো ইঙ্গিত বহন করে না। বাংলাদেশের মানুষ আগাগোড়া এ জাতীয় বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে। তারা নিজেরাই জানে কাকে কোথায় রাখতে হয়। সে জায়গাটা নিয়ে হুলুস্থূল বাধানোই বরং সংকট ত্বরান্বিত করে।
আওয়ামী লীগ সেটা জানলেও মানতে পারছে না। জানি, বলা হবে, দল নয়, দলের নাম ভাঙিয়ে একদল অসাধু মানুষ এসব করে বেড়াচ্ছে। সেটা মিথ্যা নয় যদিও, তার চেয়ে বড় সত্য দলের লোকদের বাড়াবাড়ি। মন্ত্রী মিনিস্টার এমপি বা নেতারা যা বলেন তা তো টিভিতেই প্রকাশ্য। সেটা কি অস্বীকার করা যাবে? এভাবে কি আসলেই বঙ্গবন্ধু বড় হচ্ছেন? না কোথাও আবারও তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজগুলো হচ্ছে?
শীর্ষ নেতৃত্ব এর দায় এড়াতে পারেন না। কারণ তাদের মনোরঞ্জন ও মনতুষ্টি হবে জেনেই এসব করা হয়। এত যে বাড়াবাড়ি, কেউ কোনোদিন এগিয়ে এসে একবারও বলল না যে, বন্ধ করুন। দয়া করে জাতির জনকের কাজগুলো করে দেখান। কাজ টাজ বড় নয়, বড় হচ্ছে শোরগোল আর কে কত মিথ্যা বন্দনার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে পারেন সেটা দেখানো। এটা এখন প্রায় মহামারীর আকার ধারণ করেছে। হাটে মাঠে ঘাটে এমনকি জীবনের প্রায় সর্ব অনুষঙ্গে তাঁকে এভাবে নামিয়ে আনার কোনো কারণ নেই। তিনি আমাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সবচেয়ে বড় জায়গা।
আমরা বারবার ভুলে যাই যে, আমাদের শত্রু বা দুশমন বলয় অনেক শক্তিশালী। সত্যি বলতে কী, আদর্শ ও চেতনার দিকটা সবল আর দ্যূতিময় না হলে অ্যাদ্দিনে আমাদের খুঁজে পাওয়া যেত না। বারবার তারা নানাভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে কতটা মজবুত আর শক্ত তাদের ঘাঁটি। দেশে বিদেশে অর্থ পেশি অস্ত্র আর ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার বলে এরা দানবতুল্য। তবু আমরা জেগে ঘুমাতে ভালোবাসি। সিংহাসনে যেতে পারলে আমাদের চোখের সামনের সব কিছু তুচ্ছ নগণ্য মনে হয়। ভুলে যাই অন্যের অস্তিত্ব।
আজকের বাংলাদেশে বিপন্ন বিএনপি, আত্মগোপনে থাকা জামায়াত আর কোনঠাসা প্রতিক্রিয়াশীলতা। সেখানে সংহত হবার আর শক্তি ফিরে চাওয়ার বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধু সে শক্তির এক বিপুল আধার। তিনি সারা দেশের সারা বাঙালির সকল জীবনের এক অনুপম রক্তমাখা ইতিহাস। তাঁকে নিজেদের করে আগলে রাখার নামে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ভেতর যে দুর্ভাবনা আর শঙ্কা, সেটাই তাড়িয়ে ফিরছে আমাদের।
এবার ভুল করলে পরিণাম কী হতে পারে জানার পরও এত বড় শক্তির উৎস নিয়ে এমন ছেলেখেলা, বালখিল্য শোক আর উচ্ছ্বাস বন্ধ করে তাকে সত্যিকারভাবে তুলে আনবার কাজ কি আদৌ করবে তার দল বা অনুগামীরা? সেটাই এখন দেখার বিষয়। ড্রইংরুম থেকে বাহ্যিকতা, সব জায়গায় কেন তাঁকে নিয়ে এই টানাহেঁচড়া? কী কারণে সব স্বপ্নের মালিক হবেন তিনি?
তিনি ছিলেন কর্মবীর। জীবনে এত স্ব্প্ন দেখার সময়ও পাননি। অথচ তাঁর নামে চলছে স্বপন্-দর্শনের ঘোর অপপ্রচার। যে যেভাবে পারছে, স্বপ্নের দায় তুলে দিচ্ছে তাঁর ইমেজে। যে সব কাজ বা যে সব বিষয় তাঁর জীবদ্দশায় মানুষের অধরা ছিল, ছিল অনাবিস্কৃত তা নিয়েও এমন রটনা কি তাঁকে বড় করছে?
এই মানুষগুলোর হাত থেকে তাঁকে মুক্ত করতে না পারলে তিনি কখনও মান্দেলা বা গাঁধী হতে পারবেন না। সেটা যদি তাঁর কথিত ফলোয়াররা না বোঝেন, তাদের যতটা লোকসান তার চেয়ে ঢের বেশি ভুগবে এই জাতি। পরিবার ও সমাজের ঊর্ধ্বে থাকা নেতার মূল্যায়ন যেন অবমূল্যায়নে পরিণত না হয় এটাই এবারের শোক দিবসের প্রার্থনা। এছাড়া শোক কি কখনও শক্তিতে পরিণত হতে পারে?