ইতিহাসের স্রষ্টা যিনি


বিভুরঞ্জন সরকার
আগস্ট শোকের মাস। বেদনার মাস। পনেরই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে তাঁকে সপরিবারে হত্যার শিকার হতে হয়েছিল। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলা এবং বাংলাদেশের রাজনীতি পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ইতিহাসের যিনি স্রষ্টা, বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়ে যিনি এক অসাধারণ ইতিহাসের নির্মাতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ও পরিচিতি অর্জন করেছেন, তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার মতো রাজনৈতিক মূঢ়তা কোনোভাবেই জয়যুক্ত হতে পারে না। হয়নি। হবেও না।

বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি
বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি
বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অনেক বড় বড় নেতা তাঁর সময়ে ছিলেন। কিন্তু সবাইকে পেছনে ফেলে বা অতিক্রম করে কেন তিনি অনন্য ও অসাধারণ হয়ে উঠলেন তা নিয়ে লেখালেখি একেবারে কম হয়নি। তাঁর সাহস, বুদ্ধিমত্তা, দৃঢ়তা, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব, সর্বোপরি তাঁর মানবিক গুণাবলি নিয়ে স্তুতি করার মতো অনেক কিছুই আছে। তিনি আজীবন স্রোতের বিপরীতে চলেছেন, নিজেই সৃষ্টি করেছেন নতুন স্রোতধারা। বিরুদ্ধ পরিবেশ অনুকূলে আনার জন্য তাঁকে কী নিরলস পরিশ্রম করতে হয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা দরকার রাজনীতিসচেতন সবারই। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের। আর এটা জানার পথ সুগম হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশ হওয়ায়।

উল্লেখ্য, শেখ মুজিব ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণাবস্থায় বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অনুরোধে আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন, যা শেষ করতে পারেননি। শৈশব থেকে আরম্ভ করে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক নানা ঘটনা– যার বেশিরভাগের সঙ্গে ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ ও নিবিড় সংশ্লিষ্টতা– তুলে ধরেছেন ‘অসামপ্ত আত্মজীবী’তে। অর্থাৎ এই বইয়ে বিবৃৃত হয়েছে তাঁর মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সকালের ঘটনাবলী।

অথচ ১৯৫৪ সালের পরই বস্তুত শেখ মুজিব ক্রমান্বয়ে এই ভূখণ্ডের রাজনীতির প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি যে এ রকমই হবেন, তাঁকে যে দাবিয়ে রাখা যাবে না– এটা বোঝা যায় ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত নিজের যে জীবনছবি তিনি এঁকেছেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে, তা থেকেই। তিনি উড়ে এসে জুড়ে বসেননি। ইতিহাস দখল করেননি। নিজেই ইতিহাস তৈরি করেছেন।

কৈশোর থেকেই তিনি মানুষের সঙ্গে থেকেছেন, মানুষের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, মানুষের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগের শিক্ষা নিয়েছেন এবং তাঁর জন্যই পর্যায়ক্রমে তাঁর উত্তরণ ঘটেছে– শেখ সাহেব, মুজিব ভাই, লিডার থেকে হয়েছেন বঙ্গবন্ধু, হয়েছেন জাতির জনক। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হত তাঁর জন্ম না হলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে তিনি গ্রেফতার হওয়ায় যারা বলেন যে, জাতিকে অসহায় অবস্থায় ফেলে তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তারা আসলে তাঁর সাহস ও দৃঢ়তা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই সেটা বলেন।

যারা বলেন জাতিকে অসহায় অবস্থায় ফেলে তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাঁরা সাহস ও দৃঢ়তা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই সেটা বলেন  
যারা বলেন জাতিকে অসহায় অবস্থায় ফেলে তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাঁরা সাহস ও দৃঢ়তা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই সেটা বলেন
জেল-জুলুম-অত্যাচার তিনি ভয় পাননি কিশোর বয়স থেকেই। তিনি যা করতে চেয়েছেন তা করা থেকে তাকে বিরত রাখার শক্তি কারও ছিল না। আত্মগোপনের রাজনীতি যে তিনি করেন না সেটাও স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন। স্কুলছাত্র থাকতেই পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। অন্যরা তাঁর কাজকর্ম খুব পছন্দ না করলেও পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন তাঁর বড় ছেলে প্রিয় ‘খোকা’র সব কাজের প্রশ্রয়দাতা।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিব লিখেছেন:

‘‘… গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে যা আরম্ভ করেছে তাতে তার জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাকে এখনই বাধা দেন। আমার আব্বা যে উত্তর করেছিলেন তা আমি নিজে শুনেছি। তিনি বলেছিলেন, দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট না-ও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না।’’

তবে একই সঙ্গে তাঁর প্রতি বাবার পরামর্শ ছিল:

‘‘‘বাবা, রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ। Sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হব না।’

এ কথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই।’’

নিজের জন্ম ও পরিবার সম্পর্কে শেখ মুজিব লিখছেন:

‘‘আমার জন্ম হয় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তারিখে। আমার আব্বার নাম শেখ লুৎফর রহমান। আমার ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ একটা এমই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের অঞ্চলের মধ্যে সেকালে এই একটা মাত্র ইংরেজি স্কুল ছিল, পরে এটা হাইস্কুল হয়, সেটি আজও আছে। আমি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এই স্কুলে লেখাপড়ার পর আমার আব্বার কাছে চলে যাই এবং চতুর্থ শ্রেণি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হই। আমার মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। তিনি কোনোদিন আমার আব্বার সঙ্গে শহরে থাকতেন না। তিনি সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন আর বলতেন, আমার বাবা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন, যাতে তাঁর বাড়িতে আমি থাকি। শহরে চলে গেলে ঘরে আলো জ্বলবে না, বাবা অভিশাপ দেবে।… ’’

এরপর তিনি লিখছেন:

‘‘১৯৩৪ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। … ১৯৩৭ সালে আবার আমি লেখাপড়া শুরু করলাম। এবার আর পুরানো স্কুলে পড়ব না, কারণ আমার সহপাঠীরা আমাকে পেছনে ফেলে গেছে। আমার আব্বা আমাকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। … আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না, তবু স্কুলের টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।… ’’

তাহলে রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ কবে এবং কীভাবে হল?

১৯৩৮ সালে বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে এলে তাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের আলাপ-পরিচয় হয়। শেখ মুজিবকে পছন্দ হয় সোহরাওয়ার্দীর। তিনিও মুগ্ধ হন সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্বে।

শেখ মুজিবকে পছন্দ হয় সোহরাওয়ার্দীর, তিনিও মুগ্ধ হন সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্বে
শেখ মুজিবকে পছন্দ হয় সোহরাওয়ার্দীর, তিনিও মুগ্ধ হন সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্বে
শেখ মুজিব লিখছেন:

‘‘১৯৩৯ সালে কলকাতা যাই বেড়াতে। শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। … শহীদ সাহেবকে বললাম, গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগও গঠন করব। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের। আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগ গঠন হল। একজন মোক্তার সাহেব সেক্রেটারি হলেন, অবশ্য আমিই কাজ করতাম। মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটি একটা গঠন করা হল। আমাকে তার সেক্রেটারি করা হল। আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম। আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না, শুধু বলতেন, লেখাপড়ার দিকে নজর দেবে। লেখাপড়ার আমার একটু আগ্রহও তখন হয়েছে। কারণ কয়েক বছর অসুস্থতার জন্য নষ্ট করছি। স্কুলেও আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম।’’

পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে শেখ মুজিব লিখছেন:

‘‘হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারে বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তাই মুসলমানরা ইংরেজদের সঙ্গে অসহযোগ করেছিল। তাদের ভাষা শিখবে না, তাদের চাকরি নেবে না, এই সকল করেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছিল। আর হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজকে তোষামোদ করে অনেকটা উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। যখন আবার হিন্দুরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল তখন অনেকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে মরতে দ্বিধা করে নাই। জীবনভর কারাজীবন ভোগ করেছে, ইংরেজকে তাড়াবার জন্য।

এই সময় যদি এই সকল নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না। হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ বসু এ ব্যাপারটা বুঝেছিলেন, তাই তাঁরা অনেক সময় হিন্দুদের হুঁশিয়ার করেছিলেন। কবিগুরুও তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে হিন্দুদের সাবধান করেছেন।

এ কথাও সত্য, মুসলমান জমিদার ও তালুকদাররা হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে একই রকম খারাপ ব্যবহার করত হিন্দু হিসেবে নয়, প্রজা হিসেবে। এই সময় যখনই কোনো মুসলমান নেতা মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার দাবি করত, তখনই দেখা যেত হিন্দুদের মধ্যে অনেক শিক্ষিত, এমনকি গুণী সম্প্রদায় চিৎকার করে বাধা দিতেন। মুসলমান নেতারাও ‘পাকিস্তান’ সম্বন্ধে আলোচনা ও বক্তৃতা শুরু করার পূর্বে হিন্দুদের বিরুদ্ধে গালি দিয়ে শুরু করতেন।…’’

এরপর তিনি আরও লিখছেন:

‘‘অখ– ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না, এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা খেপে গেছেন কেন? ভারতবর্ষেও মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে।…’’

নিজের অসাম্প্রদায়িক অবস্থান সম্পর্কে শেখ মুজিব লিখছেন:

‘‘আমি মানুষকে মানুষ হিসবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’’

রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই
রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই
শেখ মুজিব ছিলেন একজন অকপট মানুষ। চালাকি ও ফাঁকিবাজি একদম পছন্দ করতেন না। স্পষ্টবাদিতা ছিল তাঁর অন্যতম গুণ। নিজের সম্পর্কে তাঁর নিজের মূল্যায়ন:

‘‘আমি খুব রাগী ও একগুঁয়ে ছিলাম, কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও বেশি ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেওয়া হত, আমি নিষ্ঠার সাথে সে কাজ করতাম। কোনোদিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেই জন্যই আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম। কোন ছাত্রের কী অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালোবাসত।’’

অন্য প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখছেন:

‘‘আমি মুখে যা বলি তাই বিশ্বাস করি। আমার পেটে আর মুখে এক কথা। আমি কথা চাবাই না। যা বিশ্বাস করি বলি। সে জন্য বিপদেও পড়তে হয়। এটা আমার স্বভাবের দোষও বলতে পারেন, গুণও বলতে পারেন।’’

এই দোষ-গুণ নিয়েই তো তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাধারণ থেকে অসাধারণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘মানুষকে ব্যবহার, ভালোবাসা, প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়। অত্যাচার, জুলুম, ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না।’ এই বিশ্বাস তিনি আমৃত্যু লালন করেছেন।

যে পাকিস্তানের জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন, সেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখতে পান, রাজনীতিটা সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র আরম্ভ হয়।

শেখ মুজিব লিখছেন:

‘‘পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে জনাব সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে দিল্লিতে এক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। কারণ, বাংলাদেশ ভাগ হলেও যতটুকু আমরা পাই, তাই সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের মিলিতভাবে লোকসংখ্যার চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বেশি। সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ রাজনৈতিক জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও কর্মক্ষমতা অনেককেই বিচলিত করে তুলেছিল। কারণ ভবিষ্যতে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন এবং বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারও থাকবে না। জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে ভালোবাসতেন। তাই তাকে আঘাত করতে হবে। …

পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন প্রকাশ্যে কেউ সাহস পায় নাই। যেদিন মারা গেলেন, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পুরোপুরি প্রকাশ্য শুরু হয়েছিল।’’

পাকিস্তান হওয়ার অল্প দিনের ব্যবধানে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের খ্যাতনামা প্রার্থীকে পরাজয় বরণ করতে হয় তরুণ প্রার্থী আওয়ামী মুসলিম লীগের শামসুল হকের কাছে।

এ সম্পর্কে শেখ মুজিবের ব্যাখ্যা:

‘‘১৯৪৭ সালে যে মুসলিম লীগকে লোকে পাগলের মতো সমর্থন করেছিল, সেই মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয়বরণ করতে হল কী জন্য? কোটারি, কুশাসন, জুলুম, অত্যাচার এবং অর্থনৈতিক কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না করার ফলে। ইংরেজ আমলের সেই বাঁধা-ধরা নিয়মে দেশশাসন চলল। স্বাধীন দেশ, জনগণ নতুন কিছু আশা করেছিল, ইংরেজ চলে গেলে তাদের অনেক উন্নতি হবে এবং শোষণ থাকবে না। আজ দেখছে তার উল্টা, জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছিল।’’

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যিনি সব কিছু উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তিনিই কেন পাকিস্তান রাষ্ট্রে স্বস্তির জীবন পেলেন না?

তিনি লিখেছেন:

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়
‘‘পাকিস্তান হবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান নাগরিক অধিকার থাকবে। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান আন্দোলনের যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, এখন পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার ধুয়া তুলে রাজনীতিকে তারাই বিষাক্ত করে তুলেছে। মুসলিম লীগ নেতারাও কোনো রকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রোগ্রাম না দিয়ে একসঙ্গে যে শ্লোগান দিয়ে ব্যস্ত রইল তা হল, ‘ইসলাম’। পাকিস্তানের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ যে আশা ও ভরসা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন তথা পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে, তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে কোনো নজর দেওয়াই তারা দরকার মনে করল না। জমিদার ও জায়গীরদাররা যাতে শোষণ করতে পারে সে ব্যাপারে সাহায্য করতে লাগল।’’

অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছিল শেখ মুজিবের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন প্রতিষ্ঠাপূর্ব অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে থাকল, তখন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হলেন তিনি। যেমন ছিলেন প্রতিবাদী, তেমনি ছিলেন যুক্তিবাদী। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। জিন্নাহর বক্তব্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে তৎকালীন একজন ছাত্রনেতা বক্তৃতা করেছিলেন।

শেখ মুজিব লিখছেন:

‘‘তার নাম (ঐ ছাত্রনেতা) আমার মনে নেই। তবে সে বলেছিল, জিন্নাহ যা বলবেন তাই আমাদের মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন তখন উর্দুই হবে। আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম। আজও আমার এই একটা কথা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন হযরত ওমরকে (রা:) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষা শতকরা ৫৬ জন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।’’

এই যে সাহস করে সত্য বলা, নেতা অন্যায় করলে প্রতিবাদ করা এটা কি আমাদের দেশের আজকের রাজনীতিতে একটুও দেখা যাচ্ছে? এমনকি শেখ মুজিবের হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগেও কি নেতার সামনে সত্য উচ্চারণের সৎসাহস দেখা যাচ্ছে?

শেখ মুজিব ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ ভক্ত ও সমর্থক। আজীবন তিনি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি নিজেই লিখেছেন:

‘‘তাঁর (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) স্নেহ থেকে কেউই আমাকে বঞ্চিত করতে পারে নাই।’’

কিন্তু সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গেও একদিন কথা কাটাকাটি শেখ মুজিব দ্বিধা করেননি। কারণ নিজের অবস্থানের ন্যায্যতা নিয়ে তাঁর মনে সংশয় ছিল না। তিনি লিখছেন:

এই বিশ্বাস বুকে ধারণ করেই দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ-- নিজের জীবন দিয়ে গেছেন
এই বিশ্বাস বুকে ধারণ করেই দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ-- নিজের জীবন দিয়ে গেছেন
‘‘শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, Who are you? You are nobody.

আমি বললাম, If I am nobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you sir.’’

শেখ সাহেব কিছুটা রাগের মাথায় তাঁর নেতার কাছে নিজের সম্পর্কে যা বলেছিলেন সেটা পরবর্তী সময়ে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সত্যিই somebody হয়েছিলেন।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিব লিখেছেন:

‘‘যে-কোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারে নাই, আমার বিশ্বাস।’’

এই বিশ্বাস থেকে তিনি কোনো দিন এক চুল বিচ্যুত হননি; এই বিশ্বাস বুকে ধারণ করেই দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ– নিজের জীবন দিয়ে গেছেন। তাঁর ত্যাগ ও সাধনার ফসল বাংলাদেশ। এই দেশে যারা এখনও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করছে, স্বার্থের জন্য যারা অন্ধ হয়ে পড়ছে, তাদের বিরুদ্ধে একাগ্রতা ও সততার সঙ্গে লড়াই করে যাওয়া মুজিব-আদর্শে বিশ্বাসী সবারই ব্রত হওয়া উচিত।

জয়তু মুজিব। মুজিব চিরঞ্জীব।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

SUMMARY

1274-1.jpg