স্বাধীনতার ঘোষণা: প্রচারের পটভূমি

মুহাম্মদ শামসুল হক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের একেবারে সূচনা লগ্নে চট্টগ্রামে স্বত:স্ফূর্তভাবে চালু হওয়া স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবময় তা আজ বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু পেশাদার-অপেশাদার মানুষের স্বত:স্ফূর্ত তাৎক্ষণিক উদ্যোগে আবেগ-উদ্দীপনা ও অঙ্গীকারে সংগ্রামী স্পৃহাই ছিল মূল পূঁজি। এ সময় সংশ্লিষ্ট সকলেই যার যার সাধ্য অনুসারে স্বাধীনতার স্বপক্ষে সর্বোচ্চ অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন জন ও গ্রুপের উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় সাধন তখন সম্ভব ছিল না। কার্যক্রমেও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। ফলে অংশগ্রহনকারীদের পক্ষেও সুস্পষ্ট, সঠিক বক্তব্য দেওয়া সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক ভাঙাগড়ার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি শুরু হয়েছে। ঘোষণার দাবিদার, বেতার গঠনের কৃতিত্ব নিয়েও দুর্ভাগ্যজনক বিতর্ক চলছে।

সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে এবং তথ্য উপাত্ত যাচাই করে দেখা যায়, পরিস্থিতি তেমন হলে স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত এবং প্রাথমিক প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিলেন। তবে তিনি চেয়েছিলেন প্রথম আক্রমণটা পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে আসুক যাতে বিশ্ব আমাদের একতরফা বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। ঘোষণাটি চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারের আগেই ২৫ মার্চ দিনগত রাত ১২টার পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

চট্টগ্রাম সংগ্রাম কমিটির শীর্ষ নেতা সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরীর মেজ ছেলে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও আর এক ছেলে হেলাল উদ্দিন চৌধুরী এ লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, ওই দিন রাত ১২টার দিকে তাঁদের পল্টন সড়কের বাসভবনে এক ব্যক্তি ফোন (নং ৮০৭৮৫) করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানান এবং তা লিখে নিতে বলেন। ফোন ধরে তা লিখে নেন জহুর আহমদ চৌধুরীর স্ত্রী ডা. নূরুন্নাহার জহুর। মাহতাব উদ্দিন তখন মাধ্যমিকে প্রথম বর্ষ এবং হেলাল উদ্দিন পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র।

নূরুন্নাহার ঘোষণাটির কয়েকটি কপি করে চট্টগ্রাম সংগ্রাম কমিটির নেতাদের কাছে পাঠান। এছাড়া তিনি চট্টগ্রামের ফৌজদার ক্যাডেট কলেজের কাছে সলিমপুর অয়্যারলেস স্টেশনে তাঁর পরিচিত সহকারী প্রকৌশলী এ কে এস এম এ হাকিমের (পাবনা) কাছেও ঘোষণার কথা জানান ফোনে (নং সিজি ৮৩২০০)। ওই সময় হাকিমের অনুপস্থিতিতে এটি লিখে নেন রেডিও টেকনিশিয়ান জালাল আহমদ (পটিয়া, চট্টগ্রাম)। পরে হাকিমের নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁর সহকর্মীরা ঘোষণাটি তাঁদের জানাশোনা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সাংবাদিকসহ বিশ্বস্ত সূত্রগুলোকে টেলিফোনে জানান। পাশাপাশি সকালে (২৬ মার্চ) সমুদ্রে অবস্থানরত বিদেশি জাহাজগুলোতে জানিয়ে দেন আন্তর্জাতিক মেরিটইম অয়্যারলেসের মাধ্যমে। অপরদিকে স্বাধীনতা ঘোঘণার একটি টাইপ করা কপি মধ্যরাতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ঢাকার মগবাজার ভি এইচ এফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) অয়্যারলেস স্টেশনে পৌঁছে দেন। সেখানে কর্তব্যরত সহকারী প্রকৌশলী আবদুল কাইউম (পরবর্তীতে কাস্টমস কমিশনার) ও ইঞ্জিনিয়ারিং সুপারভাইজার মেজবাহউদ্দিন ভি এইচ এফ স্টেশন থেকে চট্টগ্রামের সলিমপুরসহ সারাদেশের মোবাইল বেইজের আওতাধীন অঞ্চলগুলোতে পাঠান। চট্টগ্রামে ভিএইচ এফ স্টেশনে দায়িত্বরত সহকারী প্রকৌশলী গোলাম রব্বানী ডাকুয়ার সঙ্গে পরামর্শক্রমে ঘোষণাটি তাঁর দুই সহকর্মীও (রেডিও টেকনিশিয়ান) তাঁদের জানাশোনা আওয়ামী লীগ নেতাসহ বিভিন্ন সূত্রগুলোর কাছে টেলিফোনে জানান। পাশাপাশি অয়্যারলেসযোগে জানিয়ে দেন বহির্ণোঙ্গরে অবস্থানরত বিদেশি জাহাজগুলোতে। এই অয়্যারলেসের মাধ্যমে ঘোষণা গ্রহণ ও প্রচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সহযোগী অন্যরা হচ্ছেন আবদুল কাদের (রাউজান, চট্টগ্রাম) মাহফুজ আলী (বাঁশখালী, চট্টগ্রাম), শফিকুল ইসলাম (শাহরাস্তি, কুমিল্লা), আবুল কাসেম খান (পাবনা), জুলহাস উদ্দিন (কাবাড়িয়া, জামালপুর), আবুল ফজল (সেনবাগ, নোয়াখালী)।

এদিকে ২৫ মার্চ এম আর সিদ্দিকীর বাসায় ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি ও এখানকার করণীয় বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে নেতৃবৃন্দ চলে যান জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায়। সেখানে আলাপ আলোচনা চলাকালে রাত ১২টার কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জেনে তাঁরা চলে যান আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর বাসায়।

আওয়ামী লীগ নেতা এম এ মান্নান আন্দরকিল্লা বিনোদা ভবনস্থ সিটি আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে গিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার বাংলা অনুবাদসহ সাইক্লোস্টাইল কপি করিয়ে তা উপস্থিত কর্মীদের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন স্থানে মাইকযোগে বিলি করার ব্যবস্থা করেন।

অয়্যারলেস স্টাফ, সাংবাদিক এবং বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিসহ অনেকেই রাতের মধ্যেই স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জেনে যান। তাঁরা তা পরম আগ্রহে জানিয়ে দেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে। ২৬ মার্চ সকালে আবারো অনেক নেতা-কর্মী জড়ো হন আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাসভবন জুপিটার হাউসে। সেখানে দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় বঙ্গবন্ধুর পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণাটি রেডিও’র মাধ্যমে জনগণকে জানানো প্রয়োজন। তখনো সবাই আদৌ জানতেন না যে, বঙ্গবন্ধু কোথায় কী অবস্থায় আছেন।

খোঁজ নিয়ে যতদূর জানা যায়, আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাসায় আলোচনার সময় এম এ হান্নান, এম এ মান্নান, ডা. এম এ মান্নান এমপি, শাহজাহান চৌধুরী, মীর্জা আবু মনসুর, আতাউর রহমান খান কায়সার, তরুণ কর্মী রাখাল চন্দ্র বণিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় জহুর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও এম আর সিদ্দিকীসহ চট্টগ্রামের তৎকালীন এমপিদের মধ্যে যাঁরা শহরে আছেন তাঁরা একযোগে রেডিও স্টেশনে যাবেন এবং সংসদ সদস্যদের পক্ষে জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে প্রচার করবেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাসা থেকে আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রের দিকে যাবার সময় কয়েকজন নেতা-কর্মী আসেন আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে। তাঁদের সঙ্গে মিরসরাই থেকে এসে যোগ দেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন (পরবর্তীতে মন্ত্রী)। তিনিসহ ডা. এম এ মান্নান, এম এ হান্নান, শাহজাহান চৌধুরী, মীর্জা মনসুর প্রমুখ রওনা দেন আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রে। তখন বেলা প্রায় ১২টা।

এর আগে সকাল ১০টা নাগাদ জিপিও’র সামনে চট্টগ্রাম কাস্টমস্ অফিসের তৎকালীন একজন প্রিভেন্টিভ অফিসার এম এ হালিম (পরবর্তীতে সহকারী কালেক্টর) হান্নান সাহেবকে স্বাধীনতা ঘোষণার একটি কপি পাওয়ার কথা জানান এবং বেতার কেন্দ্রের কিছু লোকের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। হান্নান সাহেব হালিম সাহেবকে কিছুক্ষণ পর আগ্রাবাদ আসার কথা বলে চলে যান সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের কাছে। এর পর অন্য নেতাদের নিয়ে আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রে আসেন। কিন্তু কর্মীরা ততক্ষণে কাজ বন্ধ করে চলে গেছেন। হান্নান ও তাঁর সঙ্গীরা বেতার কেন্দ্রে কাউকে না পেয়ে বেতারের আঞ্চলিক প্রকৌশলী মীর্জা নাসির উদ্দিনকে ডেকে আনার জন্য তাঁর আগ্রাবাদ সরকারি কলোনির বাসায় লোক পাঠান। তিনি প্রথমে ইতস্তত করলেও কাস্টমস কর্মকর্তা হালিমসহ স্থানীয় লোকজন তাঁকে নিরাপত্তার আশ্বাস হান্নান সাহেবের কাছে নিয়ে যান। আবদুস সোবহান নামে একজন রেডিও ইঞ্জিনিয়ারকেও নেওয়া হয় সঙ্গে। কিন্তু কর্ণফুলী নদীর কাছে অবস্থিত হওয়ায় আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠান প্রচার চালানো মীর্জা নাসিরসহ অনেকের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। পরে সবাই রওনা দেন কালুরঘাটস্থ বেতার সম্প্রচার কেন্দ্রের দিকে। যাবার পথে চকবাজারের বাদুরতলা এলাকায় অবস্থানরত দেলোয়ার হোসেন নামে একজন বেতার প্রকৌশলীকেও সঙ্গে নেওয়া হয়। একই এলাকায় অবস্থানরত মোসলেম খান নামে অপর বেতার প্রকৌশলী যান রাতের পালায়। প্রায় দেড়টার সময় সবাই পৌঁছান সম্প্রচার কেন্দ্রে। বেতার প্রকৌশলীদের দেখে বেতার কর্মীরা ট্রান্সমিটার অন করার ব্যবস্থা করেন।

এদিকে সেখানে কি বলা হবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তা ঠিক করেছিলেন এম এ হান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, ডা. এম এ মান্নান, শাহজাহান চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন প্রমুখ। অনুষ্ঠান ঘোষক হিসেবে ঠিক করা হয় রাখাল চন্দ্র বণিককে।

প্রায় ১০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানটি প্রচার শুরু হয় বেলা প্রায় দুইটায়। রাখাল চন্দ্র বণিক ঘোষণা করেন ‘চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র। একটি বিশেষ ঘোষণা, একটু পরেই জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ হান্নান। আপনারা যাঁরা রেডিও খুলে বসে আছেন তাঁরা রেডিও বন্ধ করবেন না।’ বেতার কেন্দ্রের নাম ‘চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র’ ছাড়াও ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ বলেও উল্লেখ করেছিলেন রাখাল চন্দ্র বণিক।

এভাবে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে সর্বপ্রথম প্রচারের গৌরব অর্জন করেন সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা এম এ হান্নান। ঘোষণা প্রচার শেষে নেতৃবৃন্দ আন্দরকিল্লা চলে আসেন।

ঘোষণাটি নানাভাবে প্রচারিত হয় একাধিকবার। এর মধ্যে নিজের নাম উল্লেখ না করে প্রচার করেন ডা. এম এ মান্নান এমপি।

উল্লেখ্য, এই বেতার অধিবেশন চট্টগ্রাম বেতারের প্রচার ফ্রিকোয়েন্সি ৮৭০ কিলোহার্জ এ প্রচারিত হয়েছিল। লক্ষ্য করার বিষয় যে, ২৬ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এম এ হান্নানের স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচারের অনুষ্ঠানটি ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বতঃউৎসারিত দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফল। এটি বেতার কর্মীদের উদ্যোগে সংগঠিত অনুষ্ঠান ছিল না। সূচনার দিক থেকে প্রথম অধিবেশন হলেও এটি ছিল অবিন্যস্ত খন্ডকালীন অধিবেশন।

বেতার কর্মীদের ভূমিকা :
এদিকে বেতার কর্মীদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থেকে কাজ করার ব্যাপারে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকে। তাঁদের কেউ কেউ পরস্পর এমনও আলোচনা করেন যে, একটা গোপন বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা গেলে তা আন্দোলনকে গতিশীল করতে সহায়ক হতো। এই ধরনের আলোচনায় বেলাল মোহাম্মদ (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন পান্ডুলিপিকার), আবুল কাসেম সন্দ্বীপ (ফটিকছড়ি কলেজের উপাধ্যক্ষ), আগ্রাবাদ হোটেলের ফারুক চৌধুরী, চট্টগ্রাম বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক আবদুল্লাহ আল ফারুক, চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠান তৈরি করতে আসা মাহমুদ হোসেন প্রমুখ সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

এদিকে ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর আক্রমণ এবং ২৬ মার্চ ভোর থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে বেলাল মোহাম্মদ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে সমমনা লোকদের নিয়ে বেতার কেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নেন এবং বিভিন্ন জনের সঙ্গে দুপুর থেকে যোগাযোগ শুরু করেন। বিকেলের দিকে তারা আগ্রাবাদ বেতার ভবনে পৌঁছে সেখান থেকে পুনরায় রওনা হন কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রের দিকে।

এ পর্যায়ে ২৬-২৯ মার্চের মধ্যে বিভিন্ন সময় বেলাল মোহাম্মদের সঙ্গে যুক্ত হন মাহবুব হাসান, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ, বেতার প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, আবদুল্লাহ আল ফারুক, ডা. আনোয়ার আলী, ডা. সুলতান-উল-আলম, আবদুস সোবহান, কবি আবদুস সালাম, কাজী হোসনে আরা, ফজল হোসেন প্রমুখ। পরে আরো যুক্ত হন ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলাম, বেতার প্রকৌশলী আমিনুর রহমান, অনুষ্ঠান প্রযোজক কবি মুস্তাফা আনোয়ার, বেতার প্রকৌশলী এ এইচ এম সরফুজ্জামান, রেজাউল করিম চৌধুরী, রাশেদুল হোসেন (কারিগরি সহকারী), দিলীপ চন্দ্র দাশ, মেকানিক আবদুস শুক্কুর প্রমুখ।

বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীরা প্রথমে চেয়েছিলেন আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠান ঘোষণা করে কালুরঘাট সম্প্রচারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচার করতে। কিন্তু নিরাপত্তার অভাববোধ হওয়ায় তা আর হয়নি।

এ অবস্থায় বেলাল মোহাম্মদ ফোনে যোগাযোগ করেন বেতারের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আবদুল কাহ্হারের সঙ্গে। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী আগ্রাবাদ বেতার ভবন বাদ দিয়ে কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রের ইমার্জেন্সি স্টুডিও থেকে অনুষ্ঠান প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে গিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয় সন্ধ্যা প্রায় ৭-৪০ মিনিটে।

সন্ধ্যাকালীন এই অনুষ্ঠানটিকে বেলাল মোহাম্মদ অভিহিত করেন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের’ প্রথম অধিবেশন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, বেতার কেন্দ্রের নাম হবে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। ‘বিপ্লবী’ শব্দটি যোগ করতে বলেছিলেন আবুল কাসেম সন্দ্বীপ। ঘটনা প্রবাহের এক পর্যায়ে পরিচিত কণ্ঠস্বর হওয়ায় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে আশঙ্কায় অনুষ্ঠান ঘোষণা থেকে বিরত রাখা হয় বেতারের নিজস্ব অনুষ্ঠান ঘোষক ফজল হোসেন ও কাজী হোসনে আরাকে।

২৬ মার্চের সান্ধ্য অধিবেশনটি চলে প্রায় আধঘণ্টা ধরে। এ সময়ে এম এ হান্নান আবারো আসেন কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রে ডা. আবু জাফরকে সঙ্গে নিয়ে এবং স্বকণ্ঠে প্রচার করেন বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি। আবুল কাসেম সন্দ্বীপ এবং আশিকুল ইসলামও ঘোষণাটি পাঠ করেন। কোরান তেলাওয়াত করেন কবি সাংবাদিক আবদুস সালাম। অনুষ্ঠান ঘোষণায় ছিলেন বেতার ঘোষক সুলতান-উল-আলম।

২৬ মার্চের সান্ধ্য অধিবেশন শেষে বেলাল মোহাম্মদ ও তার সঙ্গীরা চলে আসার পর মাহমুদ হোসেন-আগ্রাবাদ থেকে আবদুস সোবহানকে (রেডিও ইঞ্জিনিয়ার) জোর করে নিয়ে যান কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রে। রাত প্রায় ১০টায় সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, রঙ্গলাল দেব চৌধুরী, আগ্রাবাদ হোটেলের ফারুক চৌধুরী ও অনুষ্ঠান ঘোষক কবির প্রমুখ। এঁরা সবাই আগ্রাবাদ হোটেলে বসে বেলাল মোহাম্মদের সান্ধ্য অধিবেশন শুনছিলেন। পরে আবেগের বশে ও দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্বেচ্ছায় ছুটে গিয়েছিলেন কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রে। এটা হচ্ছে ২৬ মার্চের তৃতীয় অধিবেশন।

বলা বাহুল্য ২৬ তারিখের দুপুরে ও সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে নেতা কর্মী ও সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড রকমের উৎসাহ উদ্দীপনা ও মনোবল জেগে উঠেছিল। মানুষের মনে ধারণা জন্মায় যে, জনগণের পক্ষে তথা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দখলে একটা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র রয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু এই বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে যুদ্ধের দিক নিদের্শনা দিয়ে চলেছেন।

২৬ মার্চ রাতে বিবিসির খবরেও বলা হয়, বাংলাদেশের কোনো এক জায়গা থেকে গোপন বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সে সময় পাকিস্তান রেডিওর ওপর আস্থা না থাকায় সর্বস্তরের মানুষ রেডিও সেটের কাছে জড়ো হয়ে মনোযোগ সহকারে শুনতো বিবিসি ও আকাশবাণী কলকাতার খবর। এই দু’টি বেতার অনুষ্ঠানের সময় (সংবাদ ও পর্যালোচনা) ছাড়া বাকি সময়ে নব ঘোরাতো স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শোনার আগ্রহে।

বেতার কেন্দ্রে ছাত্রনেতৃবৃন্দ :
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগের পাশাপাশি পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও ছাত্র কর্মীরাও স্ব স্ব অবস্থান থেকে অবদান রাখার চেষ্টা করেছিলেন। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করেছেন।

এমনি পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ছাত্রলীগ ও মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মাথায় চাপে বেতার কেন্দ্রে গিয়ে কিছু বলার ইচ্ছে। তাঁরাও জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে চান বেতারের মাধ্যমে। মেডিকেলের কেউ কেউ অবশ্য ইতিমধ্যে এম এ হান্নানের বেতার ঘোষণার কথা শুনেছেন। বিশিষ্ট প্যাথলজিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাকেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান তখন মেডিকেলের সিনিয়র ছাত্রনেতাদের অন্যতম। তাঁর নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্রনেতা-কর্মী ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে বেতার কেন্দ্র চালু করতে যান। এরমধ্যে সেখানে পৌছেন ডা. এম এ মান্নান এমপি। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল হারুন, ইঞ্জিনিয়ার আজিজ, ডা. বেলায়েত হোসেন এবং ডা. আবু ইউসুফ সহ ১০/১২ জনের একটি দল ১০-১১টার মধ্যে গিয়ে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করেন। বেতার মেকানিক আবদুস শুক্কুর ও আবুল কাসেম সন্দ্বীপ উপস্থিত ছিলেন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে। ধারাবাহিকতার দিক থেকে এটি ছিল ৪র্থ অধিবেশন। অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল ৮৭.০ কিলোহার্জএ। সেই অধিবেশনের বক্তব্য বিষয় সম্পর্কে ডা. মাহফুজুর রহমান লিখেছেন- ‘বেতারে পৌঁছেই বেতার চালু করা হয়। প্রথমেই ডা. মান্নানের ভাষণের একটি ক্যাসেট বাজান হয়। তিনি এটা সাথে করেই এনেছিলেন। এরপর আমাকে তুলে দেয়া হয় সংবাদ পড়তে। সংবাদ পড়ার উচ্চারণ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় ভাষণের মত সংবাদ পড়া শুরু করে দিই এবং এক পর্যায়ে সংবাদে টিক্কা খানকেও মেরে ফেলি। ডা. বেলায়েত ইতোমধ্যে ইংরেজীতে একটি সংবাদ লিখে ফেলেন। তার লেখা শেষ হলে আমি মাইক ছেড়ে দেই। ডা. বেলায়েতের পড়া শেষ হলে ডা. ইউছুপ একটি সুন্দর ভাষণ দেন। এর ফাঁকে ফাঁকে শাহ-ই-জাহান চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। অল্পক্ষণ থেকে আমরা সবাই শহরে চলে আসি।’

মেজর জিয়ার ঘোষণা প্রচার :

ধারাবাহিকতার দিক থেকে পঞ্চম এবং বেতার কর্মীদের সংঘটিত দ্বিতীয় অধিবেশনটি প্রচারিত হয় ২৭ মার্চ সন্ধ্যায়। এই অধিবেশনেই অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এতে সে সময় বেসামরিক জনতার পাশাপাশি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইতস্তত সৈনিকদেরও নিরুদ্বেগে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণে অনুপ্রাণিত হন।

জিয়াউর রহমানের বেতারে আসা ও তাঁর দেওয়া বিবৃতি নিয়ে পরস্পর বিরোধী নানা কথা শোনা যায়, বিশেষ করে ৭৭ সালের পর থেকে। জীবদ্দশায় জিয়াউর রহমান এবিষয়ে নিজে কোনো দাবি প্রকাশ্যে করেন নি।

সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে এবং তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে জানা যায়, রাজনৈতিক নেতারা ভাবছিলেন যে, একজন সামরিক অফিসার যদি বেতারের মাধ্যমে জনগণ বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্যে নিজেদের বিদ্রোহের ঘোষণা দেন তা’হলে আইনের শৃঙ্খলায় আবদ্ধ এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় সাধারণ সৈনিকেরা দ্বিধা সংশয় ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়বে পাক-হানাদার বাহিনীর মোকাবেলায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে ক্যাপ্টেন রফিক আগে থেকেই যোগাযোগ রাখছিলেন। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন সিনিয়র বাঙালি অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। ২৬ মার্চ সকাল থেকেই চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ নেতারা খুঁজতে থাকেন মেজর জিয়াউর রহমানকে।

২৬ মার্চ ভোররাতে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে জিয়াউর রহমান তাঁর দলবল নিয়ে বোয়ালখালী থানার করলডাঙ্গা পাহাড়ি এলাকায় চলে যান। ২৬ ও ২৭ মার্চ একাধিকবার তিনি পটিয়া-বোয়ালখালী যাতায়াত করেন।

বিষয়টি জানতে পেরে এমএ মান্নান, এম এ হান্নান, ডা. এমএ মান্নান এমপি, আতাউর রহমান খান কায়সারসহ একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা করলডাঙ্গা পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে জিয়াউর রহমানকে অনুরোধ করেন বেতারকেন্দ্রে এসে ঘোষণা দেওয়ার জন্য।

জিয়া তাঁদের জানালেন, সবাই পরিশ্রান্ত, রণকৌশল ঠিক করে তিনি আগামীকালের মধ্যে (২৭ মার্চের মধ্যে) যোগাযোগ করবেন।

বোয়ালখালী ও পটিয়ার বিভিন্ন এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়, জিয়াউর রহমান ও তাঁর সঙ্গী কয়েকজন অফিসার ২৬ ও ২৭ মার্চ একাধিকবার পটিয়া ও বোয়ালখালীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং রণকৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত থাকেন। ২৬ তারিখ সকালে পটিয়া থানায় এসে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে কথা বলে তিনি আবার চলে যান বোয়ালখালী। সম্ভবত ওই সময়টাতে করলডেঙ্গা পাহাড়ের কাছে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় এম এ মান্নান, এম এ হান্নান ও আতাউর রহমান কায়সার প্রমুখের।

পটিয়ায় তখন স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে শত্রুবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ২৬ মার্চই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে রাস্তায় রাস্তায় মাইকিং করা হয় এবং মরিচের গুঁড়া, বন্দুক, দা ছুরিসহ যার যা আছে তাই নিয়ে আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জড়ো হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। স্থানীয় পুলিশ, আনসার বাহিনী ও আবদুল বারিক মিয়ার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রায় ১৫০ সদস্য জড়ো করে কালুরঘাট সেতুর দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে নিয়োজিত করা হয় শত্রুপক্ষের আগমণ প্রতিরোধের জন্য। এ ব্যাপারে থানার ওসিকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন মেজর জিয়া। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যক্ষ নূর মোহাম্মদ, হামিদুর রহমান প্রমুখের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পূর্ণ সহায়তা দেন তাঁদেরকে। মেজর জিয়া পটিয়া থানার একটি কক্ষে বসে তাঁর কার্যক্রম শুরু করেন ২৬ মার্চ বিকেল থেকে।

২৭ মার্চ চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি এসে পৌঁছে যায় পাক সামরিক বাহিনী। বন্দর এলাকা থেকে নগরীর কেন্দ্রস্থলে এসে পড়েছিল বিক্ষিপ্ত গোলা বারুদ। এই অবস্থায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তার কথা ভাবছিলেন কেউ কেউ। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মুখ্য সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ। চন্দনপুরা এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি তাহের সোবহানের কাছে জিয়াউর রহমানের পটিয়ায় অবস্থানের কথা জানতে পেরে বেলাল মোহাম্মদ তাঁর পূর্ব পরিচিত মাহমুদ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ সকাল প্রায় ১১টার পর পটিয়া থানায় যান। সঙ্গে ছিলেন আরো চার জন- ফারুক চৌধুরী, ওসমান গণি, কাজী হাবিব উদ্দিন ও এয়ার মোহাম্মদ। বেলাল মোহাম্মদ জিয়াউর রহমানের কাছে বেতারের প্রচার ভবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেন। ইতিপূর্বে এম এ মান্নান, এম.এ. হান্নান, আতাউর রহমান কায়সার এবং সবশেষে বেলাল মোহাম্মদের আহ্বান বিবেচনায় আনেন মেজর জিয়া। তিনি সম্মতি দেন এবং অল্প কিছু দূরত্ব বজায় রেখে তিনটি লরিতে করে একদল সৈন্য কালুরঘাট বেতারের দিকে পাঠিয়ে দেন। পরে সঙ্গী কয়েকজন ক্যাপ্টেনসহ একটি জিপে যান তিনি নিজে। সেদিন সন্ধ্যায় মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রচার করেন স্বাধীনতার ঘোষণা।

বেতার সম্প্রচার কেন্দ্রের অফিস কক্ষে সে সময় মেজর জিয়ার সঙ্গে ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ। বাইরে ছিলেন ক্যাপ্টেন (পরে কর্ণেল ও মন্ত্রী) অলি আহমদ ও অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। ঘোষণার বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রথম আলোচনা হয় মেজর জিয়া ও বেলাল মোহাম্মদের মধ্যে। পরে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন মমতাজ উদ্দিন আহমদ । ঘোষণার বাংলা অনুবাদে সহায়তা করেন মমতাজ উদ্দিন আহমদ (নাট্যকার লেখক)। ট্রান্সমিটার কক্ষে ছিলেন প্রকৌশলী আমিনুর রহমান ও আবদুস শুক্কুর।
২৬-৩০ মার্চ পর্যন্ত যে সব ঘোষণা প্রচারিত হয়েছে তার কোনো কোনোটি প্রচার হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু সব লোক, সব নেতা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সবগুলো ঘোষণা হয়তো শোনেননি ধারাবাহিকভাবে। কাজেই কে কোন ঘোষণা ঠিক কয়টার সময় দিয়েছেন এ নিয়ে থাকতে পারে বিভ্রান্তি। কিন্তু বেলাল মোহাম্মদ যেহেতু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পেশাজীবী বেতার সংগঠক হিসেবে জড়িত ছিলেন তাই তাঁর বক্তব্য সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নেওয়া যায়। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃতিঃ “প্রকৃতপক্ষে ঘোষণাটি প্রচারের পরিকল্পনা এবং পাণ্ডুলিপি রচনায় মেজর জিয়া এবং আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। এটি ছিল তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত। ঘোষণার প্রথম বাক্যটি ছিল ঃ
I Major Zia, on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, do hereby declare independence of Bangladesh….. ‘খোদাহাফেজ’ জয় বাংলা দিয়ে ঘোষণাটি শেষ হয়। পরদিন (২৮ মার্চ) সকালের অধিবেশনে মেজর জিয়া অপর একটি ঘোষণা প্রচার করেন। এতে নিজেকে তিনি ’Provisional head of Bangladesh’ বলে উল্লেখ করেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশ-বিদেশের কাছে গুরুত্ব পেতে হলে এই দাবী প্রয়োজন।”

এই ঘোষণা শুনে প্রবীণ নাগরিক এ.কে খানসহ রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাঁরা টেলিফোনে মেজর জিয়াকে বাস্তব অবস্থা বুঝিয়ে বলেন যে, বিনা পটভূমিতে অনুরূপ প্রাধান্য দাবি করা বিপজ্জনক। তাঁর ঘোষণা হবে বিচ্ছিন্নতার দাবি। স্বাধীনতা ঘোষণার দায়ভাগ বহনের ক্ষমতা সে মুহূর্তে শেখ মুজিব ছাড়া আর কারো ছিল না। এ.কে খানের দাবী অনুযায়ী, তাঁর দেয়া বক্তব্যের ভিত্তিতে মেজর জিয়ার তৃতীয় ঘোষণাটি প্রচারিত হয় ২৯ মার্চের তিনটি অধিবেশনে।

অবশ্য প্রকৌশলী আমিনুর রহমানের মতে, জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ রাত ১০টায় এক অনুষ্ঠানে নিজেকে স্বাধীন বাংলা সরকারের অস্থায়ী প্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সান্ধ্য অনুষ্ঠানের পর সংশ্লিষ্ট সবাই কালুরঘাট ট্রান্সমিটার কেন্দ্র থেকে চলে যান। রাত সাড়ে নয়টায় তিনি (আমিনুর রহমান) এবং আবদুস শুক্কুর ট্রান্সমিটার ভবনে আসেন। মেজর জিয়াসহ কয়েকজন সেনা সদস্য সেখানে অবস্থান করছিলেন। মেজর জিয়ার সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে তাঁরা রাত ১০টায় ট্রান্সনিটার অন করেন। তখনই জিয়া নিজেকে অস্থায়ী প্রধান উল্লেখ করে বক্তব্য দেন। প্রসঙ্গত, আমিনুর রহমান ও শুক্কুরের বাড়ি ট্রান্সমিটার কেন্দ্রের কাছাকাছি।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম পর্যায় অর্থাৎ কালুরঘাটের সম্প্রচার কেন্দ্রটি চালুর শুরু থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে আরো যাঁরা উপদেশ, পরামর্শ ও সাহস যুগিয়েছেন তাদের মধ্যে ছিলেন ডা. আবু জাফর, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাহবুব হাসান, বেগম মুশতারী শফি, আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী, ডা. আনোয়ার আলী, সুলতান আলী, খন্দকার এহসানুল হক আনসারী, এয়ার মাহমুদ, অধ্যাপিকা তমজিদা বেগম প্রমুখ।

২৬ থেকে ২৮ তারিখের মধ্যে যোগ দেওয়া বেতার কর্মী ও অন্যান্য উৎসাহী সহযোগিদের কেউ কেউ পরবর্তীতে আর সম্পৃক্ত থাকেননি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে। তবে দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর পর্যন্ত বেতারে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেন-বেলাল মোহাম্মদ (উক্ত বেতারের তৎকালীন নিজস্ব শিল্পী এবং দল নেতা), আবুল কাশেম সন্দ্বীপ (ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন উপাধ্যক্ষ), সৈয়দ আবদুস শাকের (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন প্রকৌশলী), আবদুল্লাহ আল ফারুক (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুল হোসেন (তৎকালীন টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট), কবি মুস্তাফা আনোয়ার (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), আমিনুর রহমান (তৎকালীন টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট), শারফুজ্জামান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর) এবং কাজী হাবিবুদ্দিন (ইনি বেতার কর্মী ছিলেন না)।

সবশেষে যাঁরা বলেন, বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় কিছু বলেননি, তাঁদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর দুটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করে এ লেখা শেষ করছি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকায় দলীয় কাউন্সিলে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, তিনি ২৫ মার্চ রাতে ইপিআর অয়্যারলেস নেটওয়ার্ক হতে তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচারের জন্য বলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আমি তাঁকে (জহুর আহমদ চৌধুরীকে) বলি যে, এটাই হয়তো আমার শেষ বাণী। আমি সে সময় দলীয় কর্মীদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমি জহুরকে বলেছিলাম, স্বাধীনতা ছাড়া উপায় নেই। পাঞ্জাবীকে দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাও।’ ৭৩ সালে গণভবনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলার মানুষকে যাতে শেষ ডাক দিয়ে যেতে পারি তার জন্য আমি গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল্লাহকে ছাত্রদের মারফত আমার বাসায় ডেকে পাঠাই এবং তাঁকে একটা ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিতে বলি। সে ট্রান্সমিটার তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তা আর ব্যবহার করা যায়নি। তখন বাধ্য হয়ে আমাকে চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়েছিল।’ অধ্যাপক নুরুল্লাহও বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

তথ্যসূত্র :
ইদরিস আলমের কলাম, পূর্বকোণ, ২৩.৭.৯৮
বাংলাদশের স্বাধীনতা ঘোষণার গোড়ার কথা : এম.এ হালিম,
সংবাদ. ৭.৪.৯২,
ভোরের কাগজ ১৬.০৪.৯৮
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র : পৃষ্ঠা-৮৭,
সাপ্তাহিক অনুবীক্ষণ ১৪.১২.৯৭
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়: পৃষ্ঠা-১৩,
আজকের কাগজ : ২.১২.৯১
মুক্তিযুদ্ধে মুজিব নগর : পৃষ্ঠা ৩৪,
দৈনিক আজাদী, ৮.৪.১৯৭২,
রক্ত আগুন অশ্রুসজল স্বাধীনতা, (মাহবুব-উল আলম)
লেখকের সঙ্গে এম.এ. মান্নান, বেলাল মোহাম্মদ, ডা. সুলতান উল আলম. মিসেস ডা. হাসিনা মান্নান, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন, আমিনুর রহমান, ফজল হোসেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ২৫-২৬ মার্চ কর্মরত সংশ্লিষ্ট অয়্যারলেস কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ পটিয়া-বোয়ালখালী এলাকার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার।

মুহাম্মদ শামসুল হক : লেখক, সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী

SUMMARY

1271-1.jpg