এড. মোঃ মনতেজার রহমান মন্টু :
শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী শাসকেরা দু’টি মামলায় ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করেছিল। এক মামলায় যদি ফাঁসি কার্যকর হতো তাহলে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হতে পারতেন না। আবার দ্বিতীয় মামলায় যদি ফাঁসি কার্যকর হতো তাহলে শেখ মুজিব জাতির পিতা হতে পারতেন না। শেখ মুজিব জাতির পিতা হওয়ায় ১৭ মার্চ তাঁর জন্মদিনে জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস ঘোষণা করে সরকারি ছুটি পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের তালিকায় পৃথিবীতে ২০৩টি দেশের মধ্যে ১৩টি দেশে জাতির পিতা আছে। বাঙালি জাতি সৌভাগ্যবান জাতি যে, আমরা জাতির পিতা পেয়েছি। শেখ মুজিবের পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মাতা শেখ সাহেরা খাতুন শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা বলে ডাকেননি। এ নাম তাঁরা রাখেননি। তাঁরা ডাকতেন খোকা বলে। সেই দিনের সেই শিশু খোকা আজ আমাদের বঙ্গবন্ধু আমাদের পিতা। আর এই উপাধিগুলো পেতে বাঙালি জাতিকে দিনের পর দিন ঐক্যবদ্ধ করতে হয়েছে। জেল-জুলুম, অত্যাচার নির্যাতন, দ কারাভোগ খাটতে হয়েছে।
তুরস্কের জাতির পিতা কামাল আতাতুর্ক। ১৯শে মে তার জন্মদিন হওয়ায় এদিন ছুটি থাকে। জাতীয় যুব ও ক্রীড়া দিবস পালিত হয়। ছাত্র-যুবক গোটা জাতি আনন্দ উৎসব করে। আমেরিকার জাতির পিতা জর্জ ওয়াশিংটন। তাঁর জন্মদিন ২২শে ফেব্রুয়ারি হওয়ায় এদিন আমেরিকার টেক্সাসে আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন বিমান উড়ে। আতশবাজি হয়। মাসব্যাপী আনন্দ মেলা চলে। প্রায় ৪ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এই পৃথিবীতে কলমের খোচায় অথবা গোল টেবিলের বৈঠকে অনেক দেশ ভাগ হয়েছে, নতুন দেশের সৃষ্টি হয়েছে। ঘুম থেকে উঠে জাতির পিতা হয়েছেন। কেউ কেউ এক সেকেন্ড হাজত না খেটে জাতির পিতার মর্যাদা পেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। ৩০ লক্ষ শহীদ আর আড়াই লক্ষ নারীর নির্যাতনে এই বাংলাদেশ। জীবনের মূল্যবান সময় যৌবনকাল, সেই যৌবনকালের বেশির ভাগ সময় জেল হাজত খাটতে হয়েছে মুজিবকে।
পাকিস্তানীরা দু’বার বাঙালি জাতির কাছে পরাজিত হয়েছে। ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে এবং ’৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে। ভাষা আন্দোলনে যদি হেরে যেতাম তাহলে উর্দুতে কথা বলতে হতো আবার স্বাধীনতা যুদ্ধে হেরে গেলে পাকিস্তানে বসবাস করতো হতো। অথচ এই দুই আন্দোলনেই বঙ্গবন্ধু মুজিব কারাগারে বন্দি ছিলেন।১৯৭১ সালের ৭ মার্চে প্রায় ১০ লক্ষ জনসমক্ষে এবং ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে লিখিতভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করার কারণে ওই রাতেই শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের লায়ালপুর সামরিক জেলে দ বিধি ১২১ ধারামতে রাষ্ট্রদ্রোহীর মামলায় বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার করে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয় এবং সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নেই তাকে বন্দি করে রাখার। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বহু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ফলে বিশ্ব চাপে শেষ পর্যন্ত ৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়।
এর আগে ৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে এবং ১৭ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়। ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবকে মুক্তি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, ৬ দফা ও ১১ দফার দাবিতে ছাত্র-জনতা দেশব্যাপী আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ, কার্ফু ভঙ্গ, পুলিশ ইপিআর-এর গুলিবর্ষণে বহু লোকের হতাহতের মধ্য দিয়ে গণ-অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে সবাইকে মুক্তি দেয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি লক্ষ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেদিন থেকে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে যান।
১৯৫৪ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের নির্বাচন হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শের-ই-বাংলা, মওলানা ভাসানি, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। ৩৪ বছর বয়সে কনিষ্ঠ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন শেখ মুজিব। ওই নির্বাচনের পর বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য নব্য পাকিস্তানের শাসকেরা ‘পূর্ব বাংলা’ নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এবং জাতীয়তা পাকিস্তানি করার জন্য গণ পরিষদে বিল নিয়ে আসে। ১৯৫৫ সালের ২৫শে আগস্ট এই বিলের বিরোধিতা করে শেখ মুজিব গণপরিষদে দাঁড়িয়ে বলেন ‘স্পীকার মহোদয়, এই পরিষদে ওরা বাংলার নাম বদল করে পূর্ব পাকিস্তান রাখতে চায়। আমরা বারংবার দাবি জানাচ্ছি আপনারা বাংলা এই নাম ব্যবহার করুন। বাংলা নামের ইতিহাস আছে। আছে নিজস্ব ঐতিহ্য ট্রাডিশন। এই নাম পরিবর্তন করতে হলে বাংলার জনগণের কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে, তারা এই নাম বদল মানতে রাজি আছে কিনা?
কিন্তু শেখ মুজিবের এই বক্তব্য কর্ণপাত না করে বাঙালিদের মতামত না নিয়ে ‘পূর্ব বাংলা’ মুছে দিয়ে সংবিধানে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ লেখা হয় এবং আমাদের জাতীয়তা পাকিস্তানি করা হয়। শুধু তাই নয় পাকিস্তানি সংবিধানে বাংলা বাঙালি শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এই শব্দগুলি ব্যবহার ছিল দেশদ্রোহীতামূলক দ যোগ্য অপরাধ। শুধুমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া বাংলা শব্দ বিলুপ্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কঠিন আন্দোলনের চাপে ১৯৫৬ সালে সংবিধানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হয়।
১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবসে স্মরণসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, ‘বাংলার মানুষের পক্ষ হতে আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নাম বদলে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’ হবে’। এটা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির নব অভ্যুদয়েরও ঘোষণা। এ জন্য বাংলা, বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শব্দগুলো এক ও অভিন্ন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা আমাদের বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তানের পক্ষে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল বাঙালিদের নিধন করার জন্য। ’৭১-এর আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার উপহাস করে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সেই আমেরিকা সেই হেনরি কিসিঞ্জারের দুর্ভাগ্য যে- বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই মাসের মধ্যে জাতিসংঘের জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান হেনরি কিসিঞ্জার, শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের জাতির পিতা ঘোষণা করে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার উপর বঙ্গবন্ধু মুজিবের ছবি ছাপানোর অনুমতি প্রদান করেন। যে সকল শর্তাবলির উপর জাতির পিতা ঘোষণা দেওয়া হয় এবং এ পর্যন্ত ১৩ জন জাতির পিতার মধ্যে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর যোগ্যতার নম্বর সবচেয়ে বেশি। আজকে শিশু-কিশোরেরা বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা মুজিবের আদর্শ থেকে সংগ্রামী চেতনা নিয়ে সততা দিয়ে আগামী দিনে দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত থাকবে বলে জাতি আশা করে।
লেখক ঃ আইনজীবি-প্রাবন্ধিক
সাবেক স্পেশাল পিপি
০১৭১১-৪২৫৯৮১