….মোহাম্মদ শাহ্ আলী
১৯৭১ সালের মুক্তি যুদ্ধে ৭ মার্চের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। ৭ মার্চ হয়েছে ৭০ এর নির্বাচনের ফলাফল থেকে আর ৭০ এর নির্বাচন হয়েছে ৬৬ সালের ৬ দফার অনুকুলে। কাজেই ৭ই মার্চ মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এইদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদা সতর্ক ছিলেন যেন তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত না হন। ৭ই মার্চ তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে পাকিস্তানিরা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত করলে দমন করা সম্ভব হতো। ফলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ স্বপ্ন হতো সুদূর পরাহত। তাই তিনি কৌশলী ভূমিকা পালন করেন। একদিনে স্বাধীনতার ঘোষনা করেন অন্যদিকে ৪টি শর্ত জুড়ে দিয়ে (১. মার্শাল ল প্রত্যাহার করতে হবে, ২. সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে দিতে হবে, ৩. জনগনের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, ৪. সকল হত্যার তদন্ত করতে হবে) বিচিন্নতাবাদী আখ্যা থেকে মুক্তি পান। বঙ্গবন্ধুর জানা ছিল যে, ১৯৬৭-১৯৭০ সালে নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা অঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত করে বৃহৎ শক্তির সহযোগিতায় দমন করা হয়। তাই বঙ্গবন্ধু বলেছেন, মেজরিটি (বাঙালীরা) মাইনরিটি থেকে বিচ্ছিন্ন কেন হবে? মাইনরিটিরা আক্রমন কারী এটাই সঠিক হোক। (দ্যা সানডে টাইমস, ৭ মার্চ ১৯৭১ পৃ. ৯ )
তিনি বলেছেন এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। একটি দেশের স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য এর চেয়ে গুরুত্বপূণ, ওজস্বী, সারগর্ব, তীক্ষ্ম, তীর্যক ও দিক নির্দেশনামূলক বাক্য পৃথিবীতে আর নেই। পৃথিবীতে যে কয়টি শ্রেষ্ট ভাষণ আছে তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষনই সেরা কারণ এই ভাষণের মধ্যে দিয়ে একটি জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। বাঙালী জাতি নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র জাতিকে পরিনত হয় চিনিয়ে নেয় তাদের স্বাধীনতা। ১৯ মিনিটের এই অলিখিত ভাষন পৃথিবীর আর কোন নেতার নেই। আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ এর ভাষন (১৯৬৩) ছিল লিখিত (৩ মিনিট), মার্টিন লুথার কিং এর হ্যাভ এ ড্রিম ভাষনটি ছিল লিখিত। পৃথিবীর কোন ভাষন ১০ লক্ষ লোকের সম্মুখে হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ভাষনের ছিল ১০ লক্ষ লোকের সম্মুখে। কোন রাষ্ট্র ১টি ভাষন থেকে সৃষ্টি হয়নি বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি ভাষণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এই দিক থেকে ৭ মার্চের ভাষন পৃথিবীর অন্যান্য ভাষণ থেকে শ্রেষ্ট এবং ভিন্ন মাত্রার।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের মূল বক্তব্য কী হবে তা ঠিক (নির্দিষ্ট) করার জন্য আওয়ামী লীগের কমিটির ৩৬ ঘন্টা বৈঠকের পর কোন সিদ্ধান্ত পৌঁছতে না পারার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় যা বলা প্রয়োজন তাই বলবেন বলে বঙ্গবন্ধু নিজের উপর দায়িত্ব নিলেন। ৭ মার্চ রোববার সকালে যখন বঙ্গবন্ধু পায়চারি করছেন কি বলবেন তখন শ্রদ্ধেয় বঙ্গমাতা তাকে বলেন এত চিন্তার কি আছে তুমি ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর পাকিস্তানের জেলে বন্দি ছিলে একটা লক্ষ্যকে সামনে রেখে (তা হলো স্বাধীন বাংলাদেশ) সেই লক্ষ্য সামনে রেখে যা মনে আসে তাই বলবা। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহ্মেদ সহ অন্য নেতারা দুপুরে ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলে একনেতা বঙ্গবন্ধুকে বলেন লিডার এবার লোকজন স্বাধীনতার ঘোষনা ছাড়া অন্য কিছু মেনে নেবে না। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি জনতার নেতা, আমি তাদের নেতৃত্ব দেই, আমি তাদের চাহিদা সম্পর্কে অবগত আছি। তোমরা তোমাদের দায়িত্ব পালন কর।
বৃটিশ ঐতিহাসিক জাকব এফ ফিল্ড খিষ্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ সালে প্রদত্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোলান্ড রিগ্যানের ভাষণসহ মোট ৪১টি বিশ^সেরা ভাষণ তালিকাবদ্ধ করে এবং ঐসব ভাষনের মূল্যায়ন নিয়ে রচনা করেন We shall fight on the Beach : The speech of independent History শীর্ষক একটি গ্রন্থ। বইটিতে ৭ মার্চের ভাষনের নাম হলো The Struggle : This time is the struggle for Independence. পৃথিবীতে আর কোন ভাষন নেই যা এত বেশি সংখ্যক বার মানুষ শুনছে। এত বছর পরও (৪৮ বছর পর) এর গুরুত্ব সাধারণ মানুষের কাছে একটুও কমে না। প্রতিদিন বাংলাদেশের কোন না কোন স্থানে এখনও এই ভাষন বাজানো হয়। দিন যত যাবে এই ভাষনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে সাধারণ মানুষের কাছে।
৭ মার্চের ভাষন সম্পর্কে সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলছেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে ততদিন ৭ মার্চের ভাষনটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরূক থাকবে। এ ভাষনে শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয় সারা বিশে^র মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা।
লন্ডন রয়টার্স (১৯৭১) এ লিখা হয়েছে, বিশে^র ইতিহাসে এরকম আর একটি পরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত্য ভাষন খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেয়া হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশ পরিচালনার দিক নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বলছে, শেখ মুজিব খুবই চতুর লোক তিনি সু কৌশলে ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন আমরা কিছুই করতে পারলাম না শুধু দর্শক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
তোফায়েল আহ্মেদ (আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক মন্ত্রী) বলেছেন, শেখ মুজিব ৭ মার্চ ১৯৭১ এমন সুকৌশল স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন যাতে পাকিস্তানীরা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলতে না পারে। ফ্রান্সের সংবাদ সংস্থা এ.এফ.পি (১৯৭১) তে ছাপা হয়েছে, ৭ মার্চের ভাষনের মধ্যে দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওই দিনই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। মার্কিন ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা (১৯৭১) ওয়াশিংটন পোস্ট প্রকাশ করে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষন হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা পরবর্তীতে স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছে ওই ভাষনের আলোকে।
অমত্য সেন বলেছেন, তার সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবী স্বীকার করে।
পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা (১৯৭২) বলেছে উত্তাল জন¯্রােতের মাঝে এরকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ দিক নির্দেশনামূলক ভাষণেই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।
মার্কিন সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিন (১৯৯৭) এ ছাপা হয়েছে শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষনের মাধ্যেেম আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ওই ভাষণে গোরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল। একান্তই আপন ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ভাষায় বলেছেন, আমাদের আর দাবায়া রাখতে পারবা না। নিউজ উইকে ম্যাগাজিনের ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি বলা হয়। মার্কিন নেতা লুথার কিং যেমন বলছেন আই হ্যাভ এ ড্রিম। বঙ্গবন্ধু বলছে আর আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না। ৭ মার্চের পর তার ৩২ নং সড়কের ধানমন্ডির বাড়িটি পরিনত হলো বৃটিশ ১০ রং ডাইনিং স্ট্রিটে (বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর আফিস কাম বাসভবন) এর অনুরূপ। বস্তুত তখন তিনি সরকার প্রধানে পরিনত হন। এই অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। তখন সমগ্র বেসামরিক প্রশাসন শেখ মুজিবুরের অধীনে চলে যায়। ৭ মার্চ তিনি জনগণকে আহবান জানান ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবিলা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি জনগণকে শান্তিপূর্ণ ভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য নির্দেশ দেন এবং দেশবাসীর প্রতি কতগুলি নির্দেশনা জারি করেন। এই নির্দেশনা গুলি হলো:-১. বাঙ্গালি ও বাংলার মুক্তি না আনা পর্যন্ত সকল প্রকার খাজনা ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। ২. সেক্রেটারিয়েট, সরকারি, আধাসরকারি, হ্ইাকোট, সুপ্রিমকোর্ট ও অন্যান্য আদালত বন্ধ থাকবে। ৩. যানবাহন ও বন্দরের কাজ চলবে। তবে সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলের ক্ষেত্রে সহযোগীতা চলবে না। ৪. রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের আমাদের খবর ও বিবৃতি প্রকাশ করতে হবে। ৫. টেলিফোন, টেলিগ্রাম শুধু বাংলাদেশের ভেতরই চালু থাকবে। ৬. স্কুল- কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ে হরতাল চলবে। ৭. সকল গৃহেই কালো পতাকা উড়ানো থাকবে। ৮. ব্যাংক সমূহ ২ঘন্টা লেনদেন করবে কিন্তু কোন ব্যাংকের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান একটি পয়সা ও পাচার হবে না। ৯. আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব অবিলম্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর আদেশে সারাদেশে পুরোদনে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এমন কি ঢাকা হাইকোটের তৎকালীন বিচারপতি বি.এ সিদ্দিকী টিক্কা খানের শপথ গ্রহন পরিচালনায় অস্বীকৃতি জানান।
৭ মার্চ থেকে ২৫মার্চ সকল বেসামরিক প্রশাসন ও নির্দেশনা বঙ্গবন্ধু নির্দেশই পরিচালিত হয় ২৫মার্চ
জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে অপারেশন সার্চল্ইাট নামে নিরস্ত্র বাঙ্গালিকে গণহত্যা শুরু করলে ২৬মার্চ (২৫মার্চ রাত ১২টার পর) প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এ ঘোষনাটি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট দলিলেও উল্লেখ আছে। ১৯৭১খ্রি. ঢাকায় নিয়োজিত পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ অফিসার সিদ্দিক সালিক witness to surrender গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার সম্পকে লিখেছেন- পূর্বে রেকর্ড করা শেখ মুজিবের কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা পাকিস্তানের রেডিওতে ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে শুনা যায়। (২৫মার্চ) ৭১ যেখানে তিনি বলেছেন যে আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তান হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। তিনি জনগনকে বলেছেন গা ঢাকা দিতে এবং সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি আক্রমন করার জন্য।
সর্বশেষ ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কো ২৪-২৭ অক্টোবর ২০১৭ খ্রি. ১৩০ টি ভাষন থেকে ৭৮ টি ভাষন বাছাই করে memory of the world Register এ অন্তর্ভূক্তির জন্য সুপারিশ করে আন্তজার্তিক পরামর্শ কমিটি। এরপর ইউনেস্কোর ডিজি ইরিনা বোকাবো ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ঘোষণা দেন যে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণসহ ৭৮টি ভাষণ memory of the world Register এ অন্তর্ভূক্তি করা হয়। ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত এ পর্যন্ত ৪২৭ টি প্রামান্য ঐতিহ্যের মধ্যে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি প্রথম অলিখিত ভাষণ। ৭ মার্চের ভাষন এ যাবত ইউনেস্কো প্রামান্য ৪২৭টি ঐতিহ্যের মধ্যে স্বীকৃত ভাষন থেকে ৭ মার্চ ভাষনটি প্রথম অলিখিত ভাষন। এই ভাষন বাংলাদেশ নয় সারা পৃথিবীর নিপিড়িত মানুষের প্রেরণার উৎস।
লেখক পরিচিতি
প্রভাষক, রসায়ন
দেশগাঁও ডিগ্রি কলেজ
হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।
মোবাঃ ০১৮১৭৫১২৮৭৫