মো. জাহিদ হাসান
১৭ মার্চ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুভ জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের জন্মদিনটিকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালনের সরকারি সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রশংসনীয়। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর জন্মদিনটিও সেদেশে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৯৬ সালে ১৭ মার্চ’কে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৯৭ সাল থেকে দিনটি দেশের বঞ্চিত শিশুদের অধিকারের পক্ষে নানা প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হতে থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় ২০০১ থেকে জোট সরকার দিবসটি পালনে আগ্রহ দেখায় নি। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ১৭ মার্চ’কে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন বন্ধ থাকে। ঐ সময় বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রিয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের পক্ষ হতে এবং বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা দিবসটি পালন অব্যাহত রাখে। ২০০৯ সালে বাাংলাদেশ আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসলে সরকারিভাবে আবারও দিবসটি পালন শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের এই দিনে নিপেড়িত বাংলার বঞ্চিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সেদিন হয়তো কেউ ভাবেনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করা এই শিশুটিই একদিন এদেশের মানুষকে তার পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি লাভের পথ দেখাবেন। কিন্তু তিনি সেটিই করেছেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শীতা আর অপার দেশপ্রেমের গুণে কর্মী থেকে নেতা, নেতা থেকে জননেতা, আর জননেতা থেকে হয়েছেন দেশনায়ক। পৌছে গিয়েছিলেন এ দেশের সাত কোটি মানুষের চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বঙ্গবন্ধুর মাধ্যে দেশ আর দেশের মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা পরিলক্ষিত হয় তাঁর কিশোর বয়স থেকেই। গ্রামের দুর্ভিক্ষাবস্থা, বেশিরভাগ মানুষের অর্ধহারে-অনাহারে দিন কাটানো, শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দু:খ, হাসি-কান্না তাঁকে প্রভাবিত করতো। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের উপর প্রজাপীড়ন, জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের শোষণ আর অত্যাচার তাঁকে শুধু ব্যথিতই করেনি, নির্যাতিত এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানবিক মূল্যবোধটাও জন্ম দিয়েছিল। তাঁর জীবনী থেকে জানা যায়, বর্ষাকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাবার কিনে দেয়া ছাতা বঙ্গবন্ধু তাঁর এক বন্ধুকে দিয়েছিলেন, শীতকালে তার গায়ে দেয়ার জন্য কিনে দেয়া চাদরটি তিনি গ্রামের এক অসহায় বৃদ্ধকে দিয়েছিলেন শীত নিবারণে। এমনকি বাবার অনুমতি না নিয়ে বঙ্গবন্ধু গ্রামের ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুধা নিবারণে নিজের ঘরের গোলার ধান বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। কিশোর বয়সে ধারণ করা এমন মানবীয় গুণাবলী বঙ্গবন্ধু সারাজীবন লালন করেছেন। আর সেজন্যই তিনি জনসাধারণের কাজে হয়ে উঠেছেন ‘শেখ মুজিব’ আবার ‘শেখ সাহেব’ আর ‘বঙ্গবন্ধু’তে।
তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান। মায়ের নাম সায়রা খাতুন। চার কন্যা আর দুই ছেলের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। ৭ বছর বয়সে তিনি গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল ও গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইন্সটিটিউট মিশন স্কুলে মাধ্যমিক পড়াশুনা করে ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৪৭ সালে সেখান থেকে বিএ পাস করেন। এখানে অধ্যয়নকালীন সময়ে তিনি প্রত্যক্ষ ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন এবং এ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র যুব নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী , আবুল হাশেমের মতো বড় বড় নেতাদের সান্নিধ্যে এসে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে রাজনীতির উত্তম শিক্ষাটিও গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিকে আজ জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালনের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে এটা বিশ্বাস করতেন যে, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামীতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব একদিন শিশুরাই দিবে। বঙ্গবন্ধু শিশুদের অনেক ভালোবাসতেন, আদর করতেন। সংগ্রামী জীবনে শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি শিশুদের জন্য ভাবতেন। তিনি শিশুদের আনন্দ ও হাসি-খুশি রাখার উপর গুরুত্ব দিতেন। তিনি সব সময় চাইতেন শিশুরা যেন সৃজনশীল মুক্ত মনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক। কিশোর বয়স থেকে তিনি যেমনি মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন তেমনি শিশুদেরকেও সচেতন, সংগ্রামী ও অন্যের জন্য দরদী হতে বলতেন। রাজনীতি কিংবা অন্য কোন প্রয়োজনে তিনি যখন গ্রামে যেতেন তখন যাওয়ার পথে শিশুদের দেখলে তিনি গাড়ি থামিয়ে তাদের সাথে গল্প করতেন, খোঁজ খবর নিতেন। দুঃস্থ ও গরীব শিশুদের দেখলে তাদেরকে ভালোবেসে কাছে টানতেন। কখনও কখনও নিজের গাড়িতে করে দুঃস্থ পিতাদের অফিস ও বাড়িতে পৌছে দিতেন। কাপড়-চোপরসহ নানা উপহার দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতেন।
যে শিশুদের সুরক্ষার জন্য আমাদের দেশে আজ শিশু দিবস পালিত হচ্ছে, সেই শিশুরা খুব একটা সন্তোষজনক পরিবেশে নেই। দেশে ০-১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৩২.৩ শতাংশ। এদের মধ্যে প্রায় ৭৯ লক্ষ শিশু অনাকাঙ্খিত ভাবে ৪’শ ৩০ ধরণের অর্থনৈতিক কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এর মধ্যে ৪৫ ধরণের কাজ অধিক ঝুঁকিপূর্র্ণ হিসেবে বিবেচিত। ২০১৩ সালের জড়িপ মতে, দেশের প্রায় ১২ লক্ষ শিশু অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে করছে। বিশ্ব জড়িপে শিশু শ্রমের দিক দিয়ে ২০১৫ সালে বাংলাদেকে সাড়া বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে দেখা যায়। এ থেকে আমাদের দেশে শিশু শ্রমের প্রকৃত অবস্থা জানা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৩ সালের তথ্য মতে দেশে শিশু শ্রমের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব শ্রম সংস্থার নিয়ম কানুন মেনে চলা, পোষাক শিল্পে শিশু শ্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করায় এমনটা সম্ভব হয়েছে বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
শিশু শ্রম আজ আমাদের জাতীয় সমস্যা। সরকারের একার পক্ষে এ সমস্যার সমাধান কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। অসাধু চক্রের কম মজুরি দিয়ে শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর মানসিকতার পরিবর্তন শিশু শ্রম রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সেই সাথে শিশুদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করানো এবং আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করানো গেলে শিশু শ্রম অনেকাংশে কমে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ সমস্যার সমাধানে আমাকে-আপনাকেও এগিয়ে আসতে হবে। নিজ নিজ অবস্থানে থেকে আগামী দিনের কা-ারী এসব শিশুদের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার অংশীদার হতে হবে। শিশ্র শ্রম বন্ধে সরকার কঠোর হওয়ার পাশাপাশি নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা এ প্রেক্ষিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করলে শিশু শ্রম রোধে আমরা কাঙ্খিত ফলাফল পেতে পারি। জাতির জনকের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসে এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক পরিচিতি:
মো. জাহিদ হাসান
প্রভাষক (হিসাববিজ্ঞান)
হাজীগঞ্জ মডেল কলেজ
মোবাইল: ০১৮১১১৭৫৭৩০