মেজর রফিকুল ইসলাম (অব.) বীর-উত্তম, সেক্টর কমান্ডার, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের কথা। পৃথিবীর বহু দেশ তখনো পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। ইংরেজদের দখলে ভারতবর্ষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেছে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। ভারতবর্ষের অজানা ও নিভৃত এক কোণে যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো, একসময় সে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, তার নাম ও যশ ছড়িয়ে পড়বে দূর-দূরান্তে—এতটুকু স্বপ্ন হয়তো বা তার গর্বিত পিতা-মাতার ছিল। অজানা আশঙ্কাও থাকা অসম্ভব নয়। পরাধীন দেশে মানুষের স্বপ্ন কতটুকুই বা পূর্ণতা পায়। আর দূর-দূরান্তে যশ ছড়িয়ে পড়া! সে কত দূরকে বোঝাবে? আজ থেকে ৮৫ বছর আগে ১৯২০ সালের এই অঞ্চলে যখন ঢাকা শহর থেকে দূরের এমন অনেক গ্রাম আছে, যেখানে যেতেই দুই দিনের মতো সময় লেগে যায়, তখন এই সীমানার মধ্যে বড় হওয়াও স্বপ্নের অতীত।
তবে স্কুলজীবনের শেষ দিকেই স্থানীয় কিছু ঘটনায় তাঁর ব্যক্তিগত ভূমিকা দেখে কেউ কেউ হয়তো এমনটি ধারণা করতে পেরেছিলেন যে এই কিশোরের মধ্যে নেতৃত্বের এমন গুণাবলি সুস্পষ্ট, যা তাঁকে অনেক বড়মাপের মানুষ করে তুলবে।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যেসব রাজনীতিবিদ জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারত ও পাকিস্তানে তাঁদের অনেকেই পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনগণের ভিন্নতর প্রত্যাশা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে পারেননি। ক্রমান্বয়ে তাঁরা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং স্বাভাবিকভাবেই সেখানে নতুন নেতৃত্বের সৃষ্টি হয়। এমনই পরিস্থিতিতে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পরিচিত ও প্রবীণ নেতাদের ভিড়ে যে কয়েকজন নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতা আত্মপ্রকাশ করেন, স্বল্প সময়ে সম্ভাবনাময় রাজনীতিবিদ হিসেবে যাঁর নাম এই অঞ্চলে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, সংগ্রামী ও সাহসী নেতৃত্বের ‘ইমেজ’ নিয়ে যিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন সর্বত্র, তিনিই হলেন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার সেই নিভৃত জনপদ—গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সংগ্রামী কর্মময় জীবনের পূর্ণ চিত্র ক্ষুদ্র পরিসরের কোনো লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। সুবিশাল গ্রন্থের কলেবরে সে জীবনের ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করা গেলেও লাখো-কোটি মানুষের জীবনে তাঁর একক জীবনের কর্মময়তা যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে গেছে, তার যথাযথ বিশ্লেষণ অনেকটা দুঃসাধ্য।
তাঁর ৫৫ বছরের জীবনের প্রায় অর্ধেক—শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য আর যৌবনের এক অংশ কেটে যায় ভবিষ্যতের প্রস্তুতিতে, পরাধীন ভারতবর্ষে। তারপর ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ২৪ বছর কেটে যায় নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে বাংলার মানুষের এবং বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। জীবনের এই অধ্যায়ের প্রায় পুরো সময়টাই কেটে গেছে পাকিস্তানিদের হাতে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হয়ে এবং কারা অভ্যন্তরে। আর ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর মধ্যরাত থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত ৯ মাস কেটে যায় সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। মুক্তির পরের সাড়ে তিন বছর সময় অতিবাহিত হয় একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার নিরবচ্ছিন্ন কঠোর প্রচেষ্টায় এবং একই সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত সামলাতে।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির ২৪ বছরই শেখ মুজিবের জীবনের সবচেয়ে কঠোর সংগ্রামের অধ্যায়।
এই ২৪ বছরের প্রায় অর্ধেকের অধিককালজুড়ে পশ্চিমা শাসকচক্র শেখ মুজিবকে আটকে রেখেছে কারা অভ্যন্তরে, একের পর এক মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় তাঁর জীবন-যৌবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টায় কেটে গেছে আন্দোলন-সংগ্রাম আর নিত্যনতুন বহু ধরনের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাগারের জীবনযাপনে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে পাকিস্তান সরকারের পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক; আহত হন অনেকে। সেই শোকাবহ ঘটনার কয়েক দিন পর ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় ফরিদপুর জেল থেকে। তিনি তখন গুরুতর অসুস্থ। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে নিয়ে আসেন গোপালগঞ্জের বাসভবনে। তত দিনে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করার কারণেই অবাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাঁকে বারবার হয়রানি করছে, বন্দি করে রাখছে মিথ্যা অভিযোগে—এ বিষয়টি প্রতিটি বাঙালির মনে গভীর রেখাপাত করে। মানুষের মনে তাই তাঁর এক ভিন্ন অবস্থান—সম্মানের, বিশ্বাসের এবং শ্রদ্ধার। ফলে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি যখন গোপালগঞ্জে এসে পৌঁছেন, তখন তাঁকে স্বাগত জানাতে জনতার ঢল নামে।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি এবং ভবিষ্যতের কঠিন সংগ্রামে সাফল্য অর্জনের কথা মনে রেখেই তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কাউন্সিল অধিবেশনে সবাই দলের সাধারণ সম্পাদকের অতি গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব অর্পণ করেন শেখ মুজিবের ওপর। দায়িত্বপ্রাপ্তির পর থেকে তিনি এই ভূমিকা পালন করেছিলেন নিষ্ঠা ও সাহসের সঙ্গে।
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বাঙালির অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো ‘যুক্তফ্রন্ট’ নাম দিয়ে নির্বাচনী জোট গড়ে তোলে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ—প্রধানত শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ করেন। আর এই নির্বাচনী প্রচারণার ফলে শেখ মুজিব বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আরো নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তাঁর সাংগঠনিক শক্তি ও দক্ষতার ব্যাপক বিকাশ ঘটে এই নির্বাচনী অভিযানে। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অবিশ্বাস্য সাফল্য পাকিস্তানি শাসকদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। মুসলিম লীগ সম্পূর্ণ ধরাশায়ী হয় এবং তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হলো ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে। ক্ষমতা নিয়ে নিলেন সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান।
সামরিক আইন জারির পর বহু রাজনৈতিক নেতাকে কারাগারে বন্দি করা হয়। শেখ মুজিবও বন্দি হন।
বেসামরিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবকেও সেই একই মামলায় জড়িয়ে বন্দি করা হয়।
আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলন ব্যাপক বিস্তৃতি লাভের আগেই ১৯৬২ সালের এপ্রিলে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরের বছরের ডিসেম্বর মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় এ দুই প্রবীণ নেতার মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তাঁদের সঙ্গে শেখ মুজিব অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন অনেক বছর। আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁদের সান্নিধ্য ও পরামর্শ শেখ মুজিবের জন্য ছিল এক বিরাট পাওয়া। তাঁদের মৃত্যুতে রাজনীতির জটিল ও সমস্যাসংকুল পথে শেখ মুজিব হয়তো বা হঠাৎ কিছুটা নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব অনুভব করেন। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেন যে বাঙালির স্বার্থরক্ষা ও অধিকার আদায়ের কঠিন সংগ্রামে এখন থেকে তাঁকেই আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঠিক ১৪ বছর পর ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সেই কর্মসূচি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়। এর চার দিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে এক বিশাল জনসভায় সেই ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে উপস্থিত লাখো মানুষ এই কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে।
১৯৬৬ সালের ২১ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবকে সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এরপর এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে শুরু হয় শেখ মুজিবের চূড়ান্ত সংগ্রাম।
ছয় দফার প্রতি জনসমর্থন আদায়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন ঝটিকা সফরে—বাংলার আনাচকানাচে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছয় দফার প্রতি সমর্থন এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আস্থা জ্ঞাপন করে। আন্দোলন হয়ে ওঠে জোরদার। আইয়ুব সরকার অনেকটা বেসামাল হয়ে আশ্রয় নেয় দমননীতির। শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারীদের অনেকেই নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে। আন্দোলন আরো তীব্র হয়। নির্যাতন বেড়ে যায়। আন্দোলনরত মানুষের ওপর গুলিবর্ষণে বহু মানুষ হতাহত হলে পুরো পূর্বাঞ্চলের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাস থেকে শুরু করে পুরো বছরটাই আন্দোলন, মিছিল, বিক্ষোভ আর আইয়ুবের দমননীতির শিকার অসংখ্য বাঙালির আত্মাহুতির বছর।
১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বেশ কিছু বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর সদস্যকে বন্দি করা হয়। পরে ওই একই মামলায় শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হলে প্রথম দিকটায় এক অজানা আশঙ্কায় মানুষ কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে জনগণ অনুধাবন করতে সক্ষম হয় যে এসব মামলার মূল লক্ষ্য হচ্ছে পূর্বাঞ্চলের মানুষের দাবি আদায়ের সব আন্দোলন চিরতরে নস্যাৎ করে দেওয়া।
এ ধরনের ষড়যন্ত্র ও দমননীতির বিরুদ্ধে এবং দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য শুরু হয় নতুন আন্দোলন। আন্দোলনের তীব্রতা এতই ব্যাপক হয় যে আইয়ুব শুধু এই ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন তা-ই নয়, ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে।
পুরো পাকিস্তানে শেখ মুজিব তখন অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা এবং পূর্বাঞ্চলে তিনি প্রায় একক নেতৃত্বের অধিকারী। অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের ফলে ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহূত হওয়ায় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরদিনই, ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ঢাকার রেসকোর্স মাঠে শেখ মুজিবের জন্য এক বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করে। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে সেদিন শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেই থেকে তিনি হয়ে গেলেন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’। বাংলার মানুষের জন্য তিনি দীর্ঘকাল নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করেছেন। নির্যাতিত হয়ে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন মাসের পর মাস, সব প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মৃত্যুর হুমকি উপেক্ষা করে সাহসিকতার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন বছরের পর বছর। এই সম্মান ছিল তার স্বীকৃতি।
ইয়াহিয়ার প্রতিশ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে। নির্বাচনের আগে শেখ মুজিব ব্যাপক গণসংযোগ করেন। তিনি যেখানেই যান, সেখানেই নামে জনতার ঢল।
নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল, জাতীয় পরিষদে মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। ওদিকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদেও ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনই লাভ করে আওয়ামী লীগ। এ বিজয় নিঃসন্দেহে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের স্বাক্ষর বহন করে।
কিন্তু মার্চের ১ তারিখে আকস্মিক এক ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। বেতারে ইয়াহিয়ার বিবৃতি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দল-মত-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ, প্রতিটি বাঙালি গণ-অভ্যুত্থানে শামিল হয়ে পড়ে। শহর, নগর, বন্দরে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত, বিক্ষুব্ধ মিছিলের দৃপ্ত পদভারে পাকিস্তানের ভিত কেঁপে ওঠে। বাঙালি জাতি অপেক্ষা করতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের কী নির্দেশ দেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স মাঠে পূর্বঘোষিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন দশ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল সমাবেশে। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণ, বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল এই ভাষণ তাঁর সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় নিয়ে আজও বাংলার মানুষের মনে গভীর প্রভাব রেখে চলছে। ৭ই মার্চের পর একদিকে যেমন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন জোরদার ও তীব্রতর হয়ে ওঠে, তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের ওপর ভয়াবহ ক্র্যাকডাউনের জন্য সব প্রস্তুতি দ্রুত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।
অবশেষে আসে ২৫শে মার্চের সেই ভয়াল রাত। পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল বঙ্গবন্ধুর বাসভবন আক্রমণ করে তাঁকে বন্দি করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করে। সারা পূর্ব বাংলায় শুরু হয় পাকিস্তানিদের ব্যাপক গণহত্যা। আমরাও ঝাঁপিয়ে পড়ি মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত করে দেশ স্বাধীন করতে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধে আত্মাহুতি দেয় ৩০ লাখ বাঙালি নারী, পুরুষ ও শিশু। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাধ্য হয় আত্মসমর্পণ করতে। হাজার হাজার পাকিস্তানি সেনা বন্দি হয় যৌথ বাহিনীর হাতে। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয় নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লজ্জাজনক এই পরাজয়, হাজার হাজার অফিসার ও সৈনিক বন্দি হওয়া এবং পূর্ব পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হারান। রণাঙ্গনের বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে।
মানবেতিহাসের ক্রমপরিবর্তনশীল ঘটনাপ্রবাহের ধারায় যুগে যুগে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যার প্রভাব শুধু একটি জাতি বা রাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, রাষ্ট্রের সীমানার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।
রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষকে নিয়ে এবং তার পরিপূর্ণ বিকাশ তখনই সম্ভব, যখন সেখানে ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে একজন যোগ্য ও বিশাল ব্যক্তিত্ব একটি জাতিকে তার আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে সক্ষম হন। তেমন ব্যক্তিত্বের সময়োপযোগী সাহসী সিদ্ধান্ত এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ও নিরলস প্রচেষ্টায় সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাসের। বদলে যায় সমাজ ও লাখো-কোটি মানুষের জীবন। নতুন সৃষ্টির স্বপ্নে ঐক্যবদ্ধ হয় সমগ্র জাতি। তেমনই নেতৃত্বের দৃপ্ত পদচারণে দুঃশাসন, শোষণ আর অবিচারের ভিত ধূলিসাৎ হয়ে যায়, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নশ্বর মুজিব অবিনশ্বরতার পথে চলে গেলেন চিরতরে। তাঁর জীবনাবসানে উত্থান হলো চিরন্তন মুজিবের। ইতিহাস তার অনিরুদ্ধ গতিতে মুজিবকে নিয়ে গেল ঊর্ধ্বে—রূপকথার মহানায়কের আসনে, তাঁর যথাযোগ্য অবস্থানে। নশ্বর পৃথিবীর কোনো ষড়যন্ত্র আর কোনো দিন তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না।